২০২৪ সালের বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি ।। মাসুম খলিলী

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

২০২৪ সালে ভূ-রাজনীতি হবে অস্থির ও উত্তেজনাপূর্ণ। চলতি বছর ব্যবসা-বিনিয়োগ, ভূ-রাজনৈতিক ইভেন্ট ও ঘটনা পরম্পরার গভীরতর প্রবণতা এক অসাধারণ পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী, অনেক ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়ন উন্মোচিত হলেও ২০২৩ সালের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে এক ধরনের ‘স্থিতিশীল অস্থিরতা’ বজায় ছিল। এ সময় ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির রাশ টেনে ধরা এবং অর্থনীতিতে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য হস্তক্ষেপ সক্রিয় ছিল। তবে চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা আবার বাড়তে শুরু করে; বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে এটি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

২০২৩ সালের শুরু থেকে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো বাণিজ্যনীতি কৌশল নিয়ে নানা ধরনের স্থবিরতার মুখোমুখি হয়েছিল। সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও গতিশীল নীতির ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি নিরাপত্তার উদ্বেগ। জলবায়ুনীতি অনেক সরকারের জন্য আলোচ্যসূচির শীর্ষে ছিল, যা ২০২৩ সালের শেষ দিকে ইউএইতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ-২৮) চূড়ান্ত হয়েছে। এ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাজস্ব নীতিনির্ধারকরা মুদ্রাস্ফীতি-মন্দা প্যারাডক্সকে প্রত্যাশার চেয়ে ভালোভাবে পরিচালনা করেছেন। এ সময়ে দ্রুত জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অগ্রগতি আলোচনার শীর্ষে উঠে গেছে।

অনেক কিছুর ধারাবাহিকতা চলবে

২০২৩ সালের অনেক কিছুর উন্নয়ন ২০২৪-এ চলতে থাকবে। ২০২৪ সালে ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশের একটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হবে বহুমুখিতা। বৃহত্তরসংখ্যক শক্তিশালী অভিনেতা একটি ক্রমবর্ধমান জটিল বিশ্বব্যবস্থাকে গঠন করবে। বড় শক্তি হিসেবে ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশ্বব্যাপী অপারেটিং পরিবেশকে রূপ দিতে থাকবে। ভূ-রাজনৈতিক সুইং স্টেট ভারত, সৌদি আরব, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় আরও বেশি প্রভাব ফেলবে। এসব দেশ বিশেষভাবে কোনো বড় শক্তি বা ব্লকের সাথে সংযুক্ত নয়।

নতুন বছরের আলোচিত থিম হিসেবে ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে বহুমুখিতার ক্রমবর্ধমান ভৌগোলিক আপেন্ডেড হতে পারে। এর মধ্যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিরূপণে বৃহৎ শক্তির (মার্কিন, ইইউ এবং চীন) ভূমিকায় যে কিছু মাত্রায় অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, সেটিকে নির্দিষ্ট অবয়ব দেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে। ভূ-রাজনৈতিক সুইং দেশগুলোর বিষয়গুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করবে গ্লোবাল এজেন্ডা এবং কীভাবে এ সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়, সে বিষয়টি। উদীয়মান ও সীমান্তবর্তী বাজারগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে সোচ্চার হবে। আর ছোট অভিনেতা- সরকার ও নন-স্টেট অ্যাক্টর উভয়ই স্থানীয় ও আঞ্চলিকভাবে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করবে। বৈচিত্র্যের প্রবণতা ও সরবরাহ চেইন স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ বহুমুখিতা বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে শক্তিশালী করতে পারে।

রাজনৈতিক ঝুঁকিগুলো বিশ্বব্যাপী বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ উভয়ই তৈরি করছে। এটি রাজনৈতিক ঝুঁকি পরিচালনার জন্য আরও কৌশলগত পদ্ধতির বিকাশের জন্য একটি অপরিহার্যতা তৈরি হয়েছে। ছোট দেশ ও অ-রাষ্ট্রীয় অভিনেতারাও সীমানা পুনর্নির্মাণ বা ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে তাদের আকাক্সক্ষার অবয়ব দেয়ার চেষ্টা করবে। ইউক্রেনের যুদ্ধ ও ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত যা বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে, তা সামনে আরো এগোতে পারে।

এ প্রবণতাগুলো ভূ-রাজনৈতিক ব্লক বা জোট নেটওয়ার্কের মধ্যে উচ্চতর প্রতিযোগিতার দ্বারা বৃহৎ অংশে চালিত হবে। একই সময়ে বহুমুখিতা সম্ভবত বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে থাকবে। নীতিগত সমন্বয়, অনিশ্চয়তা ও তীব্রতা বাড়ায় আন্তর্জাতিক সংকট প্রসারিত হতে পারে।

সব জায়গায় একযোগে নির্বাচন

২০২৪ সাল বিশ্বের জন্য হবে একটি নির্বাচনের বছর। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার প্রায় ৫৪ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাপী জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটার ভোটের বাজারে যাবে। এটি স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদে নিয়ন্ত্রক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক নীতির জন্য প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক পরিবেশকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করবে।
এর মধ্যে এমন দেশগুলোয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে ইতোমধ্যেই সরকারগুলোয় অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাচন ঘিরে অস্থিরতা জাতীয়তাবাদিতার সাথে মিলিত গতিশীলতা, পপুলিস্টপ্রবণতা ও মেরূকরণ সামাজিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশ্বব্যাপী এ নির্বাচন সুপারসাইকেল শিল্প কৌশল, জলবায়ুনীতি এবং এর প্রভাব হিসেবে চলমান সামরিক সংঘর্ষে দীর্ঘমেয়াদি নীতি অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

ভারতে সবচেয়ে বড় নির্বাচন হবে মে ও জুন মাসে। এ সময় ১৪০ কোটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী নাগরিকরা ভোট দেবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বিরোধী ২০টির বেশি দলের সমন্বয়ে গঠিত জোটের মুখোমুখি হবে। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে অর্থনৈতিক নীতি এবং জাতীয়তাবাদী মনোভাব ও কর্মসূচি ঘিরে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গঠিতব্য পরবর্তী সরকার নির্ধারণ করবে ভারতের পরিকাঠামোকে সমর্থনকারী নীতির গতি, সুযোগ ও উৎপাদন খাত। ফলে এ নির্বাচন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে।

এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে তাইওয়ানে আগামী জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এর ফলাফল মূল ভূখণ্ডের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে। চীন ও তাইপের ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতাকে এটি প্রভাবিত করবে। ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহ শৃঙ্খলের সাথে যুক্ত দেশ হিসেবে ভূমিকার কারণে বিশ্বব্যাপী জাকার্তার তাৎপর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার আইনসভা নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল থাকবেন কিনা, তা নির্ধারণ করবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকরা জুনে ভোট দেবেন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে। এর ফলাফল ইইউ’র নীতিকে প্রভাবিত করবে। বিশেষত জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও অভিবাসনের জন্য সহায়তা, ইউক্রেনের জন্য সমর্থন এবং চীনের প্রতি কৌশল কী হবে, তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে। যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানুয়ারি ২০২৫-এর মধ্যে। এটি বাণিজ্য, জ্বালানিনীতি ও ব্রেক্সিট-পরবর্তী কর বিষয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশেই ২০২৪ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, যদিও চলমান যুদ্ধ উভয় নির্বাচনে বিলম্ব বা অনিয়মের কারণ হতে পারে।

আফ্রিকার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকানরা সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেবে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে। আফ্রিকার এসব দেশে রয়েছে দুর্নীতি নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ, অর্থনৈতিক সুযোগ ও অবকাঠামোর চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া অন্য যেসব আফ্রিকান দেশে নির্বাচন নির্ধারিত রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সেনেগাল, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক, বতসোয়ানা, ঘানা ও দক্ষিণ সুদান। এর মধ্যে অনেকগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিধায় তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে।

আমেরিকা মহাদেশে মেক্সিকান ভোটাররা জুনে ক্ষমতাসীন পার্টি ও বিরোধী জোটের একটিকে বেছে নেবেন। পরবর্তী সরকারের জ্বালানিনীতি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণসহ দেশের গতিপথকে প্রভাবিত করবে এটি। মে মাসে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এটি দেশটির কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে। এর মধ্যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের শর্তে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে।

২০২৪ সালের শেষ নির্বাচনগুলোর একটি আগামী নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে ভোটারদের মধ্যে মেরূকরণ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। এ নির্বাচনে জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা রয়েছে। এ নির্বাচনে যিনিই জয়ী হবেন, তার প্রভাব পড়বে বিশ্ব পরিস্থিতিতে। এখন পর্যন্ত জনমত জরিপের ধারায় বাইডেন পিছিয়ে আছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন যুদ্ধের নিষ্পত্তির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি এ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে নির্বাচন সামনে রেখে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রচারাভিযানের গতিশীলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তা আরো চাঙ্গা হতে পারে। এ নির্বাচনের ফলাফল হতে পারে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি নীতির বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রবিধান এবং বৈশ্বিক জোটের ওপরও এর প্রভাব থাকবে।

নতুন বছরের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু

২০২৪ সালে ভূ-কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হবে গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনকে ঝুঁকিমুক্ত করা। কোভিড-১৯ মহামারি ও ইউক্রেনের যুদ্ধ দেশগুলোর বৈশ্বিক নির্ভরতা এবং সঠিক সময়ে বিশ্বায়িত সাপ্লাই চেইনের সাথে স্থিতিস্থাপকতা অর্জনের চ্যালেঞ্জগুলোকে হাইলাইট করেছে। এ সময় বিশেষভাবে দেখা গেছে উৎপাদন অল্পসংখ্যক বাজারে কেন্দ্রীভূত ছিল।

সরকারগুলো শিল্পনীতিতে তাদের নির্ভরতা পুনর্নির্ধারণ বা নিজস্ব উৎপাদনকে প্রসারিত করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা জটিল পণ্যের বৃহত্তর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আরো প্রসার করতে চাইছে। কিছু বাজারে, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ইতোমধ্যেই এ শিল্পনীতিগুলোর সাথে একীভূত করা হয়েছে। সামনের বছরে অর্থনৈতিক নীতি এবং পররাষ্ট্র বা জাতীয় নিরাপত্তানীতির মধ্যে এ সুস্পষ্ট সংযোগ দেখতে পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই ) উদ্ভাবন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করবে। ২০২৩ সালে এর গতিবেগ তৈরি হয়েছে আর ২০২৪ সালে এআই-এর উন্নয়ন ভূ-রাজনীতির জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সরকারগুলো আর্থ-রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এআই নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিযোগিতায় দৌড়াবে। তবে নীতিনির্ধারকরা একইসাথে ভূ-রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য দেশীয় এআই উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করবেন। ফলস্বরূপ মার্কিন-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এআই একটি কেন্দ্রীয় ডিনামিক্স হবে। ২০২৪ সালে এআই উদ্ভাবন ও নিয়ন্ত্রণের দ্বৈত দৌড় স্বতন্ত্র ভূ-রাজনৈতিক ব্লকের দিকে স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করবে।

মহাসাগর ভূ-কৌশলগত ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করবে। তবে ২০২৪ সাল নানা কারণে বেশ কিছুটা ভিন্ন হবে। মহাসাগরের ভূ-রাজনীতি গ্লোবাল ইস্যুতে আরও বিশিষ্টভাবে প্রদর্শিত হবে। মহাসাগরগুলো পৃথিবীর সব প্রাণের ৯৪ শতাংশ আবাসস্থল। একইসাথে এটি একটি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থান। বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্য পণ্যের ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক রুটের মাধ্যমে পাঠানো হয়। তবে বিশ্বের অনেক ব্যস্ততম সামুদ্রিক ট্রানজিট করিডোর ভূ-রাজনৈতিক ব্যাঘাতের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর গভীর-সমুদ্রে খনি থেকে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহের অন্তত এক-তৃতীয়াংশের সরবরাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলোকে তাদের সাপ্লাই চেইন ও টেকসই কৌশল নির্ধারণ করার সময় সমুদ্রের ভূ-রাজনীতিকে বিবেচনায় নিতে হবে।

২০২৪ জিও স্ট্র্যাটেজিক আউটলুক

বিশ্বের চলমান ঘটনাবলি ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বেশ খানিকটা ঘোলাটে করেছে এবং সামনের বছরে সংঘাত আরও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করেছে। তবে এর মধ্যে যা স্পষ্ট, তা হলো ভূ-রাজনীতি একটি বহুমুখী রূপ নিতে শুরু করেছে। এটি হয়ে উঠেছে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং অন্যান্য ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীগুলোর ওভারল্যাপিংসহ জোট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিল মিশ্রণ। এই গতিশীলতা সাম্প্রতিক ইতিহাসের যেকোনো বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে আরও বেশি দেশকে জটিল নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪-এ ভূ-রাজনৈতিক বিস্ময়ের সম্ভাবনাকে নেতিবাচক ও উল্টোদিকে নিয়ে যাচ্ছে।

২০২৪ সালের শীর্ষ ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে এআই এবং মহাসাগরের আশপাশের ভূ-রাজনীতি হলো দুটি। যারা ভূ-রাজনৈতিক ব্যাঘাতের জন্য পূর্বাভাস এবং পরিকল্পনা করতে চান, ২০২৪ সালে দুটি মূল থিম মনে রাখা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রথম থিমটি হলো বহুমুখিতা। কারণ ব্লক বা জোট নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক শক্তি আরও ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়টি হলো ঝুঁকিমুক্ত দেশগুলো নীতিগতভাবে বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক বিবেচনার ওপর জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশ্বব্যাপী নির্ভরতা কমাতে চাইছে।

মধ্যপ্রাচ্যের জন্য গাজা যুদ্ধ

২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধ ২০২৪ সালের পরিস্থিতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনাবলি এ বছরের শুরুতে বৈশ্বিক সম্পর্ককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে, যা একদিকে বিশ্বকে বহুমুখীকরণের প্রবণতাকে চাঙ্গা করেছে; অন্যদিকে অনেক দেশকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখনো বন্ধ না হওয়া গাজা যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের পরিস্থিতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ইসরাইলের ইচ্ছা অনুসারে এর নিষ্পত্তি হলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর এর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আর বিদ্যমান স্থিতাবস্থা বজায় থেকে ইসরাইল ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের মতো দুই রাষ্ট্রভিত্তিক কোনো সমাধান সূত্র এলে তা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিকে বাড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলের পশ্চিমা মিত্ররা প্রথমোক্ত উপায়ে যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে চাইছে আর মুসলিম দেশগুলো শেষোক্ত সমাধানের পথে হাঁটছে।

মধ্যপ্রাচ্যের এ বিষয়টি ২০২৪ সালের শুরুতে নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি না হয়ে এই যুদ্ধ আরো প্রলম্বিত হলে এ অঞ্চলে এর বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যুদ্ধের বিস্তৃতি এবং এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে মধ্যপ্রাচ্যে চীন রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এ সময়ে সব পক্ষের বিজয়ের মতো একটি আবহে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলে তাতে পশ্চিমা প্রভাব বজায় থাকতে পারে। তবে গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিষয়টি অনেক সময় ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচনা ও নীতি প্রণয়নে প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে।

* মাসুম খলিলী সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *