জাকির আবু জাফর
মৃত্যুর ঠিক দুদিন আগে কথা হয়েছে কবির সাথে। শেষ বিকেলে, মুঠোফোনে। আমিই ফোন দিয়েছিলাম। দিয়েছি আগের দিন অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর। একাধিকবার! বেজে বেজে নীরব হয়ে গেলো ফোনের বুক। রিসিভ করতে সমর্থ হননি তিনি। কিছুটা হতাশ হয়েছি বৈকি। ভাবলাম- নিশ্চয় অসুস্থতা কাবু করে ফেলেছে তাকে। একধরনের শংকা বেড়ে উঠলো মনের কোনে। পরের দিন ১১ডিসেম্বর ফিরতি ফোন দিলেন কবি। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই ভালো লাগলো যাক অন্তত ফোন করার মতো অবস্থায় আছেন তিনি। কথা হলো বেশ কমিনিট। তার কষ্ট হচ্ছিল কথা বলতে। তবুও বললেন। আমি কষ্টের কথা বলে ফোন রাখতে চাইলে বললেন- ‘এটিই এখন আমার জীবন। বেঁচে আছি কষ্ট নিয়েই। ফোন রেখো না। কথা বলো। অনেক দিন তো কথা হয় না। কি আর হবে দুচারটি কথা বললে। হয়তো কষ্ট বাড়বে খানিকটা, এর বেশি কিছু তো নয়।’ এ সময় তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম তার একটি কবিতার কথা। কষ্ট নিয়েই কবিতাটি। কবিতার নাম- ফেরীঅলা।
শুনে মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন- ‘হ্যাঁরে কবি, আমার সেই কষ্ট কেউ তো নিলো না।’ কষ্ট তো দিতে চাইলাম, কবিতায় বিজ্ঞাপন দিলাম কষ্টের, নিলো না কেউ।
শারীরিক কষ্টের সাথে মানসিক কষ্ট যোগ হতে দেখে আমি চুপ হয়ে গেলাম। তিনিও চুপ। আবার শ্বাস ফেলে বললেন- ‘সেই কবিতাটি কি আমি আমার জন্য লিখেছিলাম!’ স্বগোতক্তির মতোই বললেন। আমি তখনও নীরব। এর কোনো জবাব তো আমার কাছে নেই । তিনিই বললেন- কেনো যে লিখেছিলাম কবিতাটি জানি না। তবে সত্যি হলো কষ্ট কখনও আমার পিছু ছাড়েনি। এখন তো কষ্টের ওপর কষ্ট! তার কণ্ঠ বেদনার ভারে এতটাই ভারী, যার স্বর আমার শ্রবণেন্দ্রিয় ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছিলো মর্মে। তার কষ্টের কাতরতা আমাকে বিষণ্ণ করে দিলো! হায়রে জীবন! এভাবে জীবন চেপে বসে জীবনের ওপর আমি দোষী ভাবছিলাম নিজেকে। কেনো এ কবিতার কথাটি তুললাম! একটি কবিতার সঙ্গে কবির এতো বেদনা জড়িত যা মথিত করছে কবির মন! হায় জীবন! হায় সময়! আরও কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলেন তিনি। মনে হচ্ছিলো- ফোনের ওপাশে ঝরছে বুঝি কবির অশ্রু! না, তিনি কবিতা নিয়ে আর কিছুই বললেন না। কবিকে ফোন করার যে কারণ ছিলো সে গল্পটি বলছি পরে। তার আগে যে কবিতা নিয়ে মুঠোফোনে এত কথা, কবিতাটি পাঠ করা যাক-
কষ্ট নেবে কষ্ট/হরেক রকম কষ্ট আছে/ কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট/ নীল কষ্ট/ কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট/
পাথর চাপা/ সবুজ ঘাসের/ সাদা কষ্ট,/
আলোর মাঝে/ কালোর কষ্ট/‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট ।
ঘরের কষ্ট/ পরেরর কষ্ট /পাখি এবং পাতার কষ্ট/
চোখের বুকের নখের কষ্ট,/একটি মানুষ খুব নীরবে /নষ্ট হবার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট ।
প্রেমের কষ্ট/ ঘৃণার কষ্ট /নদী এবং নারীর কষ্ট/
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,/
ভুল রমণী ভালোবাসার/ ভুল নেতাদের জনসভার/ হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট ।
দিনের কষ্ট/ রাতের কষ্ট/পথের এবং পায়ের কষ্ট/
অসাধারণ করুণ চারু ফেরীঅলার কষ্ট/
কষ্ট নেবে কষ্ট ।/
আর কে দেবে আমি ছাড়া/আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন/আমার মত ক’জনের আর/সব হয়েছে নষ্ট,/
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।
সত্যিই কষ্টে ভরা এই কবিতাটি তাকে কষ্টে ফেলে দিলো।
তার পরিবার নেই। না,বিয়ে করেননি। ভাই ভাতিজা ভাতিজি থাকতেন না এদের সঙ্গেও। প্রেসক্লাবকে বলা হয় সাংবাদিকদের দ্বিতীয় বাড়ি। কিন্তু হেলাল হাফিজের প্রথম বাড়িই ছিলো প্রেসক্লাব। সকালে নাস্তার সময় ৮ টা সাড়ে ৮ টা থেকে শুরু করে রাত ১০ টা কিংবা ১১ টা অব্দি দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিতেন ক্লাবেই। কখনও বেশি অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি হতেন। বিশেষ করে পিজি হাসপাতালে অসুস্থতার সময় গড়িয়ে যেতো তার। শেষের দিকে চলাচলে প্রায় অক্ষম হয়ে পড়লেন। এ সময় প্রেসক্লাবে যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। বেছে নেন হোস্টেল জীবন। সেটিও শাহবাগ পিজি হাসপাতালের নিকটেই। এই আবাসিক হোস্টেলেই ছিলো হেলাল হাফিজের বসতঘর। এখানে আরও লোকেরা থাকেন। কিছু ছাত্র এবং কিছু চাকুরীজীবি তারা।
১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুর। হোস্টেলের শৌচাগারে গেলেন কবি। আকস্মিক পড়ে যান বেসিনের ওপর। পড়ে মাথা কেটে যায় তাঁর। প্রায় আধা ঘণ্টারও বেশি কোনো সাড়াশব্দ নেই। হয়তো বাথরুম দীর্ঘ সময় আটকে আছে বলে কেউ নক করলো। না, কোনো সাড়া নেই ভেতর থেকে। ফলে শৌচাগারের দরজা ভাঙলেন তারা। দেখলেন- রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন হেলাল হাফিজ। উদ্ধার করে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) অর্থাৎ পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। দেখে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করলেন। এভাবেই শেষ হয়ে যায় হেলাল হাফিজের জীবন।
তার জন্ম ৭ অক্টোবর ১৯৪৮। নেত্রকোনায়। শৈশব কৈশোর গ্রামেই কাটে। নেত্রকোনা দত্ত হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করেন নেত্রকোনা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে।
প্রথম কবিতা লেখেন নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন। স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় ছাপা হয় কবিতাটি। তারপর থেকে পথচলা কবিতার সাথে।
সালটি ঊনসত্তর। শুরু হলো গণআন্দোলন। এসময় হেলাল হাফিজ লিখলেন তার জনপ্রিয় কবিতাটি – “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়।”
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। এ দুটি ছত্র কবিকে খ্যাতি এনে দিলো।
এ দুটো ছত্র সম্বন্ধে বলা হয়- আহমদ ছফা এবং হুমায়ুন কবির দুটি ছত্রকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের কোনো একটি দেয়ালে লিখে দিয়েছিলেন।
হেলাল হাফিজের অনেক জনপ্রিয় কবিতা রয়েছে। প্রথম কবিতাবই প্রকাশ পেলো ১৯৮৬ সালে। বইটির নাম- ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। প্রথম বই দিয়েই পাঠক হৃদয়ে আসন করে নেন হেলাল হাফিজ।
যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে উল্লেখ আছে তারিখ। সে তারিখ অনুযায়ী কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।
বিস্ময়ের বিষয় হলো ৮৬ সালের পর দীর্ঘ দু’ যুগেরও বেশি সময় আর কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ২৬ বছর পর প্রকাশ পেলো দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। আবারও দীর্ঘ বিরতি। তৃতীয় এবং শেষ কাব্যগ্রন্থটি বের হয় ২০১৯ এ। এ গ্রন্থের নাম-‘ বেদনাকে বলেছি কেঁদো না।’
হেলাল হাফিজ সাংবাদিক ছিলেন। ছিলেন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ এ সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক দেশ পত্রিকায়। অনেক পরে একসময় যোগ দেন দৈনিক যুগান্তরে। এ পত্রিকায় দীর্ঘ দিন সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন।
হেলাল হাফিজ একজন আধুনিক কবি। প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে তার পরিচিতি লতিয়ে উঠেছে। লড়াইয়, সংগ্রাম, প্রেমে-বিরহ, দ্রোহ এবং জীবনের দুঃখ বেদনা স্পর্শ করেছে তার কবিতা। তার একটি কবিতার নাম- ‘অগ্ন্যুৎসব’ এ কবিতাটির কটি ছত্র পাঠ করা যাক- ‘ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি/ সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে? জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে/ রক্তঋণে স্বদেশ হলো,/ তোমার দিকে চোখ ছিল না/ জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’ এ কবিতায়ও দ্রোহের বিষয়টি উচ্চকিত।
তার লেখালেখির সময়টি বেশ দীর্ঘ। কিন্তু লিখেছেন নেহায়াতই কম। তবে খ্যাতির বিস্তারটি বেশ ছড়ানো। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য।
এবার বলি সেই গল্পটি, যেজন্য ফোন করেছিলাম কবিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব। উৎসবটি ছিলো ৭ দিন ব্যাপী। ৭ ডিসেম্বর ‘২৪ থেকে ১৩ ডিসেম্বর’২৪ ছিলো এর ব্যপ্তি। বিভাগটি মার্কেটিং অথচ ৭ দিনের গোটা একটি দিন (১২ তারিখ) ছিলো সাহিত্যের পক্ষে নিবেদিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আর কোনো বিভাগ এমন নজির স্থাপন করেনি।
সারাটাদিনে অনেকগুলো পর্ব ছিলো।
একটি পর্ব ছিলো জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকদের । একটি পর্ব কবিতাবিষয়ে আলোচনা। আরেকটি কথাসাহিত্যের। এরপর সঙ্গীত এবং সবশেষে ছিলো কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠ। একটি আকর্ষণীয় পর্ব ছিলো দিনের শুরুতেই। পর্বটি হলো সাহিত্য পুরস্কার। এটি আজীবন সম্মাননা। পুরস্কার হলো সম্মান জনক নগদ অর্থ এবং একটি নাদনিক ক্রেস্ট। পুরস্কৃত করা হয়েছে দুজনকে- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং কবি হেলাল হাফিজ।
মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর এ বি এম শহিদুল ইসলাম। তিনি খ্যাতিমান একজন কবি। শহিদ আজাদ নামে লেখেন কবিতা। তিনি কবিতার জন্য নিবেদিত একজন। কবিতার জালেই আমাদের সম্পর্কের বন্ধন। মূলত: তাঁর উৎসাহেই এমন বিশাল আয়োজন হলো সাহিত্যের। সঙ্গে তাঁরই ছাত্রী, বর্তমানে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ইশরাত তানিয়া এবং শিল্পী জাহিদ মুস্তফাও ছিলেন সক্রিয়। ছিলেন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মাহবুবা বেগম।
চেয়ারম্যান এ বি এম শহিদুল ইসলাম আমাকে অনুরোধ করলেন, কবি হেলাল হাফিজের পুরস্কারের বিষয়টি তাকে জানানোর। গুরুত্বপূর্ণ অনুরোধটি পেয়ে পুলকিত হলাম। পুরস্কারের সুখবরটি দিতেই মুঠোফোনে কল দিয়েছিলাম তাকে। খবরটি শুনেই মনে হলো তার কষ্ট উড়ে গেলো। অনেকটা চাঙা এবং ফুরফুরে মেজাজে বললেন- অসুস্থতার জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারবো না আমি। আমাকে পৌঁছে দিও পুরস্কারটি। পুরস্কার প্রদানের তারিখ ছিলো ১২ ডিসেম্বর। ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যুর হিম হাত দখল করে নিলো তাকে। পুরস্কারটি তার হাতে পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। চেয়ারম্যান কবি শহিদ আজাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- মার্কেটিং বিভাগে চালু করবেন কবি হেলাল হাফিজ সাহিত্য পুরস্কার। এর মাধ্যমে বছরে অন্তত একবার স্মরণ করা হবে কবিকে।
* জাকির আবু জাফর কবি ও কথাশিল্পী, সাহিত্য সম্পাদক- দৈনিক নয়াদিগন্ত