হেফাজত কোন পথে?

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

স্টালিন সরকার

দেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নাগরিক জীবন জেরবার। মানুষের ভোটের অধিকার হারিয়েছে বহুদিন। জনগণের ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ ডান-বাম-মধ্যপন্থী প্রায় অর্ধশতাধিক দল রাজপথে। আজ শুরু হচ্ছে টানা তিন দিনের অবরোধ। আন্তর্জাতিক মহল চায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। উন্নয়নসহযোগী দেশগুলো তাদের এই অবস্থান বার বার জানিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের চলমান অবস্থার ওপর নজরও রাখছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ক্ষমতার সুবিধাভোগী কয়েকটি দল চায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো পাতানো নির্বাচন। জাতীয় সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ‘ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার’ সুযোগসন্ধানি কৌশল নিয়েছে। রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে দল সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে সেদিকে ছাতা ধরবে জাতীয় পার্টি। সুবিধাবাদী চরিত্রের জাতীয় পার্টি নিয়ে মানুষের আগ্রহ তেমন নেই। কিন্তু দেশের বৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম কোন পথে হাটছে? হেফাজতকে নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহ রয়েছে। কারাবন্দী হেফাজত নেতাদের মুক্তির দাবির পাশাপাশি জনগণের ভোটের অধিকার, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার আন্দোলনের সামিল হবে নাকি ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে এহলৌকিক কিছু সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশায় ‘নীরবতা’ পালন করে ক্ষমতাসীনদের মৌন সমর্থন দেবে?

শাপলা চত্বর ট্রাজেডিই শুধু নয়, গত কয়েক বছরে দেখা গেছে হেফাজতের নেতারা গ্রেফতার হলে সংগঠনটি হুংকার দিয়ে মাঠে নামে। পাশাপাশি দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আলেমদের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি, বক্তব্য মতামত দেন; নেটিজেনরা লাইক, শেয়ার করার মাধ্যমে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। হেফাজতকে এই সব মানুষ নিজেদের মতপথের হিসেবে মনে করেন। অথচ গত ১০ বছরে এই অরাজনৈতিক সংগঠনটির ভুমিকা দেখা গেছে বিভ্রান্তিকর। পুতুল খেলার মতো সংগঠনটি অদৃশ্য সুতার টানে চলছে। শাপলা চত্বরে ট্র্যাজেডির পরও এই সংগঠনের কিছু নেতা ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর ব্যনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমী জননী’ উপাধি দিয়েছে। কখনো দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে মাঠে নেমে সরকারের বিরুদ্ধে গগণবিদারী হুংকার দিচ্ছে; কখনো কখনো সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে পর্দার আড়ালে সমঝোতা করে চলছে। আবার দেশের লাখ লাখ কর্মী সমর্থকদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিছু নেতা ‘লাভজনক পদ পদবি’ এন্তেজাম করে আয়েসি জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের এই ক্রান্তিকালে কওমী মাদরাসা ভিক্তিক হেফাজতে ইসলাম কোন পথে? হাজার মিলিয়ন ডলারের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে দেশের সাধারণ মানুষ।

হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও দেশের রাজনীতিতে সংগঠনটির গুরুত্ব অপরিসীম। সংগঠনটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। ২০১৩ সালের ৫মে শাপলা চত্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির প্রতি কিছু বাম নেতা বিয়োদগার করলেও দেশের সর্বস্তরের মানুষ সহানুভুতিশীল হয়ে উঠে। যার প্রমাণ শাপলা চত্বরের সমাবেশের আগে-পরে দেখা গেছে।

শাহবাগ কেন্দ্রীক কয়েকজন ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগারের ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে হেফাজত ২০১৩ সালে ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছিল। ওইদিন সংগঠনটির কয়েক লাখ কর্মী-সমর্থক শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। স্মরণকালের বৃহদায়কার সেই অবস্থান কর্মসূচিতে মাদরাসার লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষকের পাশাপাশি তৌহিদী জনতা অংশ গ্রহণ করেন। এতো বিপুল সংখ্যা মানুষের খাবার সরবরাহ করে সাধারণ মানুষ এবং বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসা কর্মী-সমর্থকদের পথে পথে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে খাবার দেয়। ঘরের গৃহিনীরা রান্না করে নিজে না খেয়ে সে খাবার শাপলা চত্বরে আসা মানুষের জন্য পাঠিয়ে দেয়। নজীরবিহীন সেই সহায়তা এবং সমাবেশের দৃশ্য দেশি-বিদেশী গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। কিন্তু মধ্যরাতে ঘটে ভয়াবহ পৈচাসিক ঘটনা; যা শাপলা ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। পুলিশের অভিযানে শাপলা চত্বরে মৃত্যের সংখ্যা তথ্য সম্বলিত রিপোর্ট প্রকাশ করায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের আদিলুর রহমান খান ও নাসিরউদ্দিনের কারাদন্ড হয়। মৃত্যের সংখ্যা নিয়ে মতভেদের মধ্যেই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গণতদন্ত করে ৩৯ জন নিহতের তথ্য দেয় এবং তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরনের প্রস্তাব করে। কিন্তু হেফাজতের নেতারা সে ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। ওই ঘটনার পর সারাদেশের কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, মসজিদের ইমাম-মেয়াজ্জেমদের জীবনে নেমে আসে অবন্ধকারের আমানিশা। দীর্ঘ আড়াই থেকে তিন বছর সারাদেশের কওমী মাদরাসার শিক্ষক এবং হেফাজতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দাঁড়ি-টুপিওয়ালা তৌহিদী জনতা পুলিশী গ্রেফতার আর নির্যাতনের ভয়ে নিজেদের ঘরে ঘুমাতে পারেননি।

পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি গড়ানোর মতোই সময় অতিবাহিতের সঙ্গে ধীরে ধীরে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক মন্ত্রী সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘনঘন দেখা করেন। কেউ দিনের কেউ রাতের আঁধারেও দেখা করেন। এক সময় দেখা গেল পর্দার আড়ালে অনেক কিছু ঘটে গেছে। সংগঠনটির কিছু নেতা সরকার থেকে নানান সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন; কেউ কেউ বিভিন্ন পদ-পদবি পাচ্ছেন। সংগঠনটির সুযোগ সন্ধানী নেতারা সংগঠনের নামে কাঁদা যাতে না লাগে সে কৌশল করে ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ নামে সংগঠন তৈরি করেন। সেই সংগঠনের ব্যানারে হেফাজত নেতারা ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরানা মাহফিলের নামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

বর্তমানে হেফাজতের কিছু সুবিধাবাদী নেতা সরকারের নানা পদ-পদবি ও সুযোগ সুবিধা নিলেও লাখ লাখ কর্মী সেসব পছন্দ করছেন না। তারা বিভিন্ন দাবিতে মাঝে মাঝে রাজপথে নামেন, হুংকার দেন। সংগঠনের ওই সব আলেমদের হুংকারে সরকার কখনো বিব্রত হন; কখনো নরমে-গরমে দমনের চেষ্টা করেন; কখনো সামনে ‘কলা ঝুলিয়ে’ থামিয়ে রাখেন। যারা লোভলালসা উপেক্ষা করেন তাদের ওপর জুলুম নির্যাতন করা হয়। গ্রেফতার করা হয়। সংগঠনটির অনেক নেতা এখনো কারাগারে।

২০২১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দমোদর মোদী। মুসলিম হত্যাকারী অবিভিত করে মোদীর ঢাকা সফর ঠেকানোর কর্মসূচি দেয় হেফাজত। ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এবং পরবর্তীর কিছু ঘটনায় আরো কয়েকজন আলেম এবং ইসলামী জলসায় ওয়াজ করা আলেমকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত ওই সব নেতাদের মুক্ত করতে হেফাজত নেতারা কখনো সমঝোতার চেস্টা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। আবার কখনো হুংকার দিয়ে রাস্তায় নামেন। অতপর নীরব হয়ে যান রহস্যজনক ভাবে।

জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী অনেকেই বলছেন, হেফাজত কার্যত অদৃশ্য সুতায় চলছে। তারা কখনো গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নামার হুমকি দেয়; কখনো রাতের আঁধারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে দেনদরবার করে সুবিধা আদায় করেন। ফলে হেফাজত নেতাদের মতিগতি বোঝা কঠিন। সংগঠনটির সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নেতারা মনে করেন জনগণের ভোটের অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে হেফাজতের রাজপথে নামা উচিত। কারণ বর্তমান সরকার কিছু নেতার জন্য ‘সুবন্দবস্ত’ করলেও আলেম সমাজের বিরুদ্ধেই তাদের নীতি কৌশল। ফলে হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় জনগণের পক্ষে ভুমিকা রাখা উচিত।

সংগঠনটির সুবিধাভোগী নেতারা আন্দোলনমুখি নেতাদের ‘হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন’ তকমা দেখিয়ে থামিয়ে দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্য ‘আহা বেশ তো আছি’। শাপলা চত্বরের দুর্দিনে যারা হেফাজতের পাশে দাঁড়িয়েছিল তারা মনে করেন সংগঠনটির বর্তমান কর্মকৌশল বিভ্রান্তিকর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইসলামী চিন্তাবিদ বলেন, বর্তমান সরকার থেকে হেফাজতের কিছু নেতা সুবিধা ভোগ করায় দোদুল্যতায় ভুগছে সংগঠনটি। তবে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল হলে হেফাজত বর্তমান সুবিধার চেয়ে বহুগুন বেশি সুবিধা পাবে। কারণ তখন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীরা ক্ষমতায় যাবে। হেফাজত সামান্য কয়েকজন নেতার সুবিধা দেখবে নাকি বৃহৎ সুবিধার চিন্তা করবে সেটা তাদের ভাবনা। তবে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হেফাজত কোন পথে ##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *