হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে যাবার উপক্রম হলেও স্বীকার করছে না ইসরায়েল

মধ্যপ্রাচ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। কিন্তু নেতানিয়াহু এবং তার সরকার কখনোই তা স্বীকার করবে না। জনপ্রিয় বৃটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান এখবর দিয়েছে।

ব্র্যাডফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস প্রফেসর অব পিস পল রজার্স বৃহস্পতিবার গার্ডিয়ানে লিখেছেন, ইসরায়েলের সরকারী বর্ণনায় বলা হয়েছে যে হামাস দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবে আইডিএফের বিশাল শক্তিমত্তা দ্রুত ব্যর্থ হচ্ছে।

পল রজার্স বলছেন, ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি হত্যা এবং ৫০ হাজারেরও বেশি আহত করা আর গাজার বেশিরভাগ ধ্বংসের ফলে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক খ্যাতি হ্রাস পাচ্ছে।

গাজার যুদ্ধের বিবরণ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এবং দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইডিএফ হামাসকে নিঃশেষ করার কল্পকাহিনী বর্ণনা করছে। এমনকি দাবি করছে যে, উত্তর গাজার অনেকাংশে যুদ্ধ সম্পন্ন হয়েছে, এবং দক্ষিণ গাজায় সাফল্য আর বেশি দেরি নয়।

পল রজার্স লিখেছেন, গাজায় কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিক ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েও সঠিক তথ্য প্রকাশের কারণে এই কল্পকাহিনী ধরা পড়ছে। যদিও আন্তর্জাতিক মিডিয়া বেশিরভাগ তথ্যের জন্য আইডিএফ’র উৎসের উপর নির্ভরশীল।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বিশ্লেষন করে বলা হয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সাথে ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠছে। প্রথমে আল-শিফা হাসপাতালের নীচে হামাসের সদর দফতরের বিষয়ে আইডিএফ’র দাবির সমর্থনে প্রমাণের অভাব। এছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত গোয়েন্দা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আইডিএফ ইসরায়েলি জিম্মিদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থতা।

সম্প্রতি আরও দুটি ঘটনা ঘটেছে। ১২ ডিসেম্বর ইসরায়েলি বাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গাজার একটি অংশে হামাসের আধাসামরিক বাহিনী কর্তৃক দক্ষ ট্রিপল অ্যামবুশ। তারা আইডিএফ ইউনিট আক্রমন করলে ব্যাপক হতাহত হয়। সেই ইউনিটকে সাহায্য করার জন্য আরও সৈন্য পাঠানো হয়েছিল, তখন তাদের উপরও হামাস অতর্কিত হামলা করতে সক্ষম হয়েছে।

সেখানে দশজন আইডিএফ সৈন্য নিহত এবং অন্যান্য গুরুতরভাবে আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের হতাহতের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হয়। এদের মধ্যে ছিলেন একজন কর্নেল এবং অভিজাত গোলানি ব্রিগেডের তিনজন মেজর।

হামাস যদি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ইতিমধ্যেই তাদের হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে, তাহলে গাজার সর্বত্র কিভাবে এই ধরনের অভিযান চালাতে পারে। এতে সন্দেহ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, ইসরায়েল যুদ্ধে যথেষ্ট অগ্রগতি করছে না।

একটি ঘটনা কয়েকদিন পরে এসেছে, যখন তিনজন ইসরায়েলি জিম্মি হামাসের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে সফল হয়েছিল, পরে তারা আইডিএফ সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছে। এরপর থেকে ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

আইডিএফ’র সমস্যার আরো বিস্তৃত ইঙ্গিত রয়েছে। সরকারি হতাহতের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজা, ইসরাইল এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৪৬০ জনেরও বেশি সামরিক কর্মীসহ বহু সংখ্যক নিহত ও আহত হয়েছে।

ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ইয়েদিওথ আহরোনোথ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশ করেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান লিমোর লুরিয়া বলেছেন, সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ২ হাজারেরও বেশি আইডিএফ সৈন্যকে প্রতিবন্ধী হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৮ শতাংশ তাদের হাতে ও পায়ে গুরুতর আঘাতের কারণে চিকিত্সা করেছে।

এদিকে টাইমস অফ ইসরায়েল জানিয়েছে, আহত আইডিএফ সৈন্য, ইসরায়েল পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬ হাজার ১২৫। নিজেদের গুলিতে নিজেরা (ফ্রেন্ডলি ফায়ার) হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। একই কাগজে ১০৫জনের মধ্যে ২০ জনের মৃত্যু এ ধরনের সেইম সাইড ফায়ার বা যুদ্ধের সময় দুর্ঘটনার কারণে হয়েছে বলে গার্ডিয়ান লিখেছে।

রামাল্লায় বসবাসরত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ফরিদ তামাল্লাহ মিডল ইস্ট আই’তে লিখেছন, ইসরায়েল বলে এই যুদ্ধ মূলত হামাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু দুই মাস ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসরায়েল কোনো ধরনের বাছবিচার না করে গাজার স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, বেকারি, হাসপাতাল, জাতিসংঘের স্থাপনা, আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাচ্ছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, আদতে তাদের লক্ষ্যবস্তু শুধু হামাস নয়।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বন্ধন নষ্ট করতে পারেনি; বরং গাজায় নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল তার আসল চেহারা ফাঁস করে দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে হামাস এবং ফাতাহ আন্দোলনের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও ফিলিস্তিনিদের বৃহত্তর স্বার্থের ইস্যুতে তাদের উদ্দেশ্য ও আদর্শ একই অবস্থানে রয়েছে।

৭ অক্টোবরের আগেও ফিলিস্তিনিরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে এক ছিলেন এবং এই হামলার পর তাঁদের সেই বন্ধন আরও জোরালো হয়েছে। তাঁরা প্রমাণ করছেন, ফিলিস্তিনি রক্তকে দখলদারের বুলেট দিয়ে আলাদা করা যাবে না।

গার্ডিয়ানের জেরুজালেম প্রতিনিধি বেথান মেকারনান লিখেছেন, গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ শুরু করে। এর মধ্যে নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবি ওঠেছে। নেতানিয়াহু তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জোয়ায়েভ গ্যালান্ত ও বিরোধীদলীয় নেতা বেনি গ্যান্তজকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই মন্ত্রিসভার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহুকে অসংলগ্ন মনে হয়েছে। এরপর যখন সাংবাদিকেরা কড়া কড়া প্রশ্ন করতে শুরু করেন, তখন তিনি দ্রুত সরে যান।

ইসরায়েলের বামপন্থী সংবাদপত্র হারেৎজ সোমবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে তারা লিখেছে, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু দুটি বস্তুই ইসরায়েলের দখলে। একটা হলো ডেড সি আর অন্যটি হলো নেতানিয়াহুর আচরণ। একটা প্রাকৃতিক বিস্ময়, অন্যটি রাজনৈতিক গোঁজামিল।’

লিকুদের বেশ কয়েকজন সদস্য নাম না প্রকাশ করে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন পত্রিকাটিকে। সেখানে তারা বলেছেন, নেতানিয়াহু তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন। যুদ্ধের কারণে স্থানচ্যুত ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ এবং হামাসের হাতে জিম্মিদের ব্যাপারে উদাসীনতা এই ক্ষোভকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরব সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্যকার অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ওয়ালিদ আবু হেলাল মিডল ইস্ট আইয়ে লিখেছেন, যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলের প্রতিদিনকার ব্যয় অস্ত্রশস্ত্র, গুলি, বোমা, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য রসদ, রিজার্ভ ফোর্সের বেতন-ভাতা, ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ইত্যাদি। এ ব্যয় মেটাতে ইসরায়েল অতি উচ্চ সুদে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছে।

যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয় ধারণা করেছিল, এ যুদ্ধের খরচ হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু যুদ্ধ যত এগিয়েছে, খরচের আশঙ্কাও তত বাড়ছে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এ খরচ ৪০০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।

যুদ্ধের পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন শিল্প, প্রযুক্তি, পর্যটন ও শ্রমবাজারের ওপর। এ যুদ্ধ নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মাইক্রোসফট, আইবিএম, ইনটেল, গুগলসহ প্রায় ৫০০ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের টেক-সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরায়েলে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে কি না, সেটি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

মাইক্রোসফট ইসরায়েল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের মুখ্য বিজ্ঞানী টোমার সিমন সম্প্রতি তার এ উদ্বেগের কথা ইসরায়েলি নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাজি হানেগবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন।

এদিকে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার’ কারণে ইসরায়েলের মালিকানাধীন জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে মালয়েশিয়া। গাজা উপত্যকায় অব্যাহত আগ্রাসনের জেরে দেশটি ইসরায়েলি পতাকাবাহী আর কোনও জাহাজকে ডক না করতে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা ও বর্বরতা’ চালাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের জিআইএম শিপিং কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। একই সঙ্গে ইসরায়েল অভিমুখী কোনও জাহাজ মালয়েশিয়ার বন্দরগুলোতে মালামাল বোঝাই করতে পারবে না বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলার বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী হামাসের প্রতি সমর্থনের অংশ হিসেবে ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুথি বাহিনী লোহিত সাগরে জাহাজে আক্রমন বাড়িয়েছে। হুথির প্রতিরোধ বেড়ে যাওয়ায় ইসরাইল অভিমুখে জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

ডেনিশ শিপিং জায়ান্ট মারস্ক এবং জার্মান শিপিং কোম্পানি হ্যাপাগ-লয়েড লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে তাদের জাহাজ পাঠানো স্থগিত ঘোষণা করেছে।

পূর্ব-পশ্চিম বাণিজ্য রুটকে লক্ষ্য করে হুথির আক্রমণগুলি চালিত হচ্ছে। বিশেষ করে সুয়েজ খাল অঞ্চল। তেলবাহী জাহাজ সমূহ সময় ও ব্যয় বাঁচাতে সুয়েজ খাল ব্যবহার করতে হয়।

ভূমধ্যসাগরীয় শিপিং কোম্পানি এবং সিএমএ সিজিএমকে লোহিত সাগরের সামুদ্রিক করিডোর এবং মিশরের সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করতে বাধ্য করেছে হুথিরা। এটি ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক ডেভিড হার্স্ট নেতানিয়াহুর অপ্রাপ্য স্বপ্ন এবং ইসরায়েলের সম্ভাব্য পতন সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ভেঙে পড়তে পারে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে নির্মূলে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর “স্বপ্ন সত্যি হবে না” বলেও বর্ণনা করেছেন তিনি।

ওয়াথান মিডিয়ায় প্রকাশিত নিবন্ধে হার্স্ট বলেছেন, ইসরায়েলিরা এখন একই ভুল করছে যা ফরাসিরা আলজেরিয়ায় করেছিল। প্রায় এক মিলিয়ন আলজেরিয়ানকে হত্যা করেছিল,ফরাসিরা বিশ্বাস করত যে তারা যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করবে। শেষ পর্যন্ত আলজেরিয়াকে স্বাধীনতা প্রদান করে তাদের চলে যেতে হয়েছিল। হার্স্ট বলেন, গাজাতেও একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

সূত্র : গার্ডিয়ান, টাইমস অফ ইসরায়েল, হারেৎজ, ইয়েদিওথ আহরোনোথ, ওয়াথান ও অন্যান্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *