‘স্যামন’ বিষয়ক জটিলতা ও আমেরিকায় বাংলা চর্চা । আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রবন্ধ-কলাম প্রবাসী সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

‘স্যামন’ মাছের নামের সঙ্গে পরিচয় মফস্বলের এক কলেজে ইন্টারমেডিয়েট ক্লাসে। ইংলিশ লেখক উইলিয়াম সমারসেট মম (William Somerset Maugham) এর ছোটগল্প ‘দ্য লাঞ্চিয়ন (The Luncheon) আমাদের পাঠ্য তালিকায় ছিল এবং পড়াতেন ইংরেজি বিভাগের সিদ্দিকুর রহমান স্যার। স্যার ‘স্যামন’ (Salmon)কে ‘স্যামন’ হিসেবেই উচ্চারণ করতেন। গল্পটি পড়ানো শেষ করতে তিন থেকে চার মাস সময় লেগেছিল। সিদ্দিক স্যার পঁচিশ মাইল দূর থেকে কলেজে আসতেন। যেদিন আসতে পারতেন না, সেদিন দর্শন বিভাগের মুজিবুর রহমান স্যার ইংরেজি ক্লাস নিতেন এবং ‘দ্য লাঞ্চিয়ন’ পড়ানো তাঁর ভাগেও পড়েছিল। তিনি ‘স্যামন’ এরং ইংরেজি বানানের কোনো অক্ষর বাদ না দিয়ে উচ্চারণ করতেন ‘স্যালমন’ (Salmon) এবং লেখক সমারসেট মম এর ‘মম’ উচ্চারণ করতেন (Maugham) ‘মহাম’। ওই সময়ের মধ্যে যেটুকু ইংরেজি আয়ত্ত্ব করেছিলাম, তাতে অন্তত এটুকু ধারণা হযেছিল যে, ইংরেজি উচ্চারণ রীতিতে অনেক শব্দের উচ্চারণে কোনো কোনো অক্ষরের উচ্চারণ ‘উহ্য’ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু মফস্বল বলে কথা নয়, রাজধানী ঢাকার উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকও ‘স্যামন’কে ‘স্যালমন’ উচ্চারণ করেন।

‘স্যামন’ আমাদের অঞ্চলের মাছ নয়। অতএব, নামের সঙ্গে পরিচয়ের এক যুগ পর ‘স্যামন’ মাছের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৮৩ সালে, জার্মানির বার্লিন সিটিতে। শুধুই চোখের দেখা। আমার তিন মাস বার্লিন অবস্থানকালে একদিনও মাছ রান্না করিনি। বার্লিনে যেসব বাঙালি, পাকিস্তানি ও ভারতীয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তারা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু অবাক হয়েছি দু’একজন ছাড়া তারাও ‘স্যামন’কে ‘স্যালমন’ বলতেন। এরপর যুক্তরাজ্যসহ যে ক’টি ইউরোপীয় দেশে গেছি, বাঙালি ভাইবোনদের অধিকাংশকেই অবলীলায় ‘স্যালমন’ বলতে শুনেছি। বর্তমানে আমেরিকায় শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল শ্রেনিপেশার বাংলাদেশীর বিপুল সমাবেশ। তাদের একটি বড় অংশ যদি ‘স্যালমন’, ‘স্যালমন’ বলেন, তাহলে দোষনীয় কিছু নেই। কিন্তু আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, এমন কেউ ‘স্যামন’কে ‘স্যালমন’ উচ্চারণ করলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু তারা তা করেন।

‘স্যামন’ আমার আলোচ্য বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা সাহিত্যের অবস্থা নিয়ে লেখার সূচনা ‘স্যামন’ মাছ দিয়ে করাও বোধ হয় সঙ্গত নয়। বাংলা সাহিত্য চর্চা করেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা খুব কম নয়। নিউইয়র্ক ও লস এঞ্জেলেস এর মত বড় সিটি, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী বসবাস, সেখান থেকে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু সংখ্যক সাপ্তাহিক সংবাদপত্রও প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রবাসী লেখকদের গল্প, উপন্যাসের কাহিনি এবং সাংবাদিকদের লেখা সংবাদপত্রের খবর ও কলামের অধিকাংশই বাংলাদেশ কেন্দ্রিক। প্রবাস জীবন ও ভ্রমণ কাহিনিও কিছু আছে, কিন্তু হাতে গণা। সাধারণভাবে বলা যায়, যারা বাংলাদেশে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাই প্রবাস জীবনের হাজারও ব্যস্ততার মাঝেও তাদের সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। যারা ভালো লিখতেন, অবাধ বাক স্বাধীনতার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে আরও ভালো লিখছেন। অনেকেই মনের দুয়ার খুলে লিখতে পারছেন না। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই প্রকাশিত হচ্ছে। হওয়ারই কথা, বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ প্রধান ভাষা, প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নগরী নিউইয়র্কের অনেক অফিসের কাগজপত্র, বিশেষ করে বিভিন্ন ফরমে, বোর্ড অফ ইলেকশনের ব্যালটে, নির্দেশনায় ইংরেজি ও অন্যান্য প্রধান ভাষার সঙ্গে বাংলাও থাকে। ট্রেন বাসেও এখন বাংলায় বিভিন্ন সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেখা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা আন্তর্জাতিক ভাষা নয়।

১৯২৪ সালে সমারসেট ১৯২৪ সালে সমারসেট মম তাঁর ‘লাঞ্চিয়ন’ গল্পের নায়িকার ‘স্যামন’ মাছ খাওয়ার আগ্রহে যে বিপদে পড়েছিলেন, সেই জটিলতা বাঙালির ক্ষেত্রে রয়েই গেছে। আমেরিকার মূল ধারার সাহিত্যে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা অনেক এগিয়েছেন। তারা আমেরিকায় ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করে কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যন্ত ওঠে গেছেন। আমাদের ব্ঙাালিরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছেন। দুই তিন দশক আমেরিকায় বসবাস করেও খুব কম সংখ্যক বাঙালির পক্ষে শুদ্ধ ইংরেজিতে একটি বাক্য উচ্চারণ করা সম্ভব হয়। তবে আমেরিকান টানে কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। যেমন, তারা ‘টুয়েনটি’কে ‘টুয়েনি’, ‘টুয়েনটি ওয়ান’কে ‘টুয়েনি ওয়ান’ ইত্যাদি বলতে পারে। শ্বেতাঙ্গদের বলে ‘সাদাইয়া’, কৃষ্ণাঙ্গকে ‘কালাাইয়া’ এবং তাদের বিষয় বর্ণনা করতে ব্যবহার করে ‘তুই’। যেমন, “আজ এক সাদাইয়া’কে বললাম, ‘তুই এইটা কর, তুই ওইটা কর’।” একদিকে তারা ইংরেজি আয়ত্ত্ব করেন না, অন্যদিকে তাদের মাতৃভাষায় জং ধরতে থাকে। বাঙালি পাড়া খ্যাত নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, পার্কচেস্টারের ফুটপাতে চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ও সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে জোর গলায় কথা বলে। আমেরিকার রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করে না। পাশের বাড়ির আমেরিকানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টাও করে না। সেক্ষেত্রে সাহিত্য চর্চার সুযোগ কোথায়?

খুব কম সংখ্যক বাংলাদেশী আমেরিকানের ঘরে বই খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রতিবছর নিউইয়র্কে একটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থা নিয়মিত এই মেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রকাশকরা অভিযোগ করেন, বই যা বিক্রি হয় তাতে তাদের যাতায়াত খরচ ওঠে না। স্থানীয় বাঙালির লেখকদের বইও মেলায় থাকে। তাদের পরিচিতরা চক্ষু লজ্জায় পড়ে তাদের বই কিনেন। লেখকও জানেন, ক্রেতা বই পড়বেন না, ক্রেতাও জানেন যে বই তিনি কিনেছেন তা তার পড়া হবে না। তাহলে আমেরিকায় বাঙালি ও বাংলা এবং বাংলা সাহিত্য কোথায় আছে? কোথায়ও নেই। যারা আমেরিকা, ইউরোপ অথবা বিশ্বের অন্যান্য দেশে যান, তারা জেনেবুঝেই যান যে যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে তাদের মাতৃভাষা অচল। যে দেশে যে ভাষা প্রয়োজন ক’জন সেই ভাষা শেখার চেষ্টা করেন? করেন না বলেই তারা পরিচিতির সংকটে পড়েন। এই সংকট সহজে কাটে না। আমেরিকায় যারা আসেন, তারা স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশে আসেন। বিনামূল্যে ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা থাকলেও আগ্রহ করে কেউ ইংরেজি শেখে না। ‘ইয়েস, নো, ভেরি গুড’ বলতে পারার মধ্যে অনেকে নিজেটের আটকে রাখেন। আমেরিকায় স্থায়িত্বের শর্ত হিসেবে ইংরেজি জানা, দেশটির ইতিহাস, রাজনীতি ও সমাজকে জানতে হয়। নাগরিকত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তারা নির্ধারিত কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করেন। উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেগুলোও ভুলে যান।

একটি ভাষা তখনই মানুষকে আকৃষ্ট করে যখন তারা একই সঙ্গে সেই ভাষার সৌন্দর্য ও উপযোগিতা উপলব্ধি করতে পারে। আমাদের অংশের পৃথিবী থেকে মানুষ আমেরিকায় আসে মুখ্যত অর্থ উপার্জন করতে, এবং দ্বিতীয়ত নিরাপদে বসবাস করতে এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে। পাশ্চাত্যের যেকোনো দেশের মত যুক্তরাষ্ট্রেও অর্থ উপার্জনে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কারো ফুরসত মিলে না। অনেকে ঠিকমত ঘুমানোর সময় পর্যন্ত পায় না। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়। অন্যকিছু করার সুযোগ কোথায়? ভাষাই বা শিখবে কখন? শিল্প-সাহিত্যের মত সৃজনশীল কাজে অর্থ নেই। আমেরিকার মত দেশে ‘অর্থই সকল সুখের মূল।’ তাই অর্থ ছাড়া কেউ কিছু বোঝে না। পিতা তাঁর সন্তানকে কোনো কাজের দায়িত্ব দিলে সন্তান ঘন্টা হিসাব করে। এমন পরিবেশ মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রকাশের অনুকূল নয়।

বাংলাদেশীরা তাদের গড় জ্ঞান ও বৃদ্ধিমত্তা দিয়ে শ্রমসাধ্য কাজকর্ম করে এবং অর্থ ছাড়া আমেরিকার সমাজ সংস্কৃতি থেকে সামান্যই গ্রহণ করে। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টার অংশ হিসেবে তারা প্রতিবছর বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকায় সাড়ম্বরে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। তাতে বাঙালিত্ব বজায় থাকলেও বাংলা শিল্প সাহিত্যের কোনো উপকার হয় না। যারা লেখার তারা যেখানেই থাকবেন তাদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশের জন্য লিখে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমেরিকায় বসে খুব কম সংখ্যক লেখকের পক্ষে বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখকদের মানে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে আরও কম হবে। কারণ নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী আমেরিকানদের মধ্যে যদি দু’চার জন্য সাহিত্যের জগতে বিচরণ করতে আসেন, তারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে কতটুকু মাথা ঘামাবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

লেখকঃ উপদেষ্টা সম্পাদক- উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক। সাবেক সম্পাদক- মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *