স্মৃতিতে অমলিন কমোডর আতাউর রহমান । সাঈদ চৌধুরী

প্রবন্ধ-কলাম বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

দেশের চিকিৎসা সেবায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী ইবনে সিনা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কমোডর অব. এম আতাউর রহমান ২০২১ সালের ২০ মার্চ শনিবার মহান মাবুদের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। গতকাল ছিল প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। বিশেষ অবদানের কারণে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ তার জন্য বিভিন্ন স্থানে দোওয়া করেছেন।

বহুমুখী প্রতিভা ও মেধার অধিকারী কমোডর অব. এম আতাউর রহমান ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের দ্বিতীয় বোর্ড চেয়ারম্যান ছিলেন। দেশের আর্থিক খাত নিয়ে আধুনিক ও কল্যাণ চিন্তার এক অনন্য মেধাবী মানুষ তিনি। ইসলামী ব্যাংকিং জগতের বাতিঘর।

নির্ভীক দেশপ্রেমিক কমোডর অব. এম আতাউর রহমান দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন চেয়ারম্যান ছিলেন। অত্যাধুনিক মিডিয়া হিসেবে দিগন্তকে এগিয়ে নিতে সর্বদা চেষ্টা করেছেন। তিনি ছিলেন সমাজের আলোকবর্তিকা। একজন সৎ ও সাহসী মানুষের প্রতিকৃতি। আমি সূক্ষ্মভাবে তার কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছূ। তার কাছে পরামর্শ চেয়ে কখনও নিরাশ হইনি। অনুপ্রাণিত হয়েছি বার বার। যে কোন বিষয় পরম মমতায় বুঝিয়ে দিতেন। চলার পথের অনেক স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে তিনি অমলিন হয়ে থাকবেন আজীবন।

কমোডর অব. এম আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে দেশের চিকিৎসা সেবায় রোগ নির্ণয়ে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ১২৮ স্লাইস সিটি স্ক্যান সংযোজন করে ইবনে সিনা ডায়াগনোস্টিক এন্ড ইমেজিং সেন্টার। জার্মানির সিমেন্স সিটি স্ক্যানটির নির্মাতা। এই সিটি স্ক্যান সংযোজনের ফলে দেশের চিকিৎসা সেবায় নতুন সম্ভাবনার সূচনার কথা জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিষয়টি বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এবং মাইলফলক ঘটনা। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ হাসপাতালেই স্লাইসের সিটি স্ক্যান ব্যবহৃত হচ্ছে। চিকিৎসা সেবায় বরাবরের মতো ইবনে সিনা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ১২৮ স্লাইস সিটি স্ক্যান সংযোজন করে পথ প্রদর্শক হয়ে আছে।

২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল এ উপলক্ষে আয়োজিত এক সায়েন্টিফিক সেমিনারে জার্মানির মিউনিখ ইউনিভার্সিটি হসপিটালের রেডিওলজিষ্ট ডা. ওয়াইল্যান্ড সোমার জানান, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ১২৮ স্লাইস সিটি স্ক্যানে রেডিয়েশনের মাত্রা অনেক কম, অন্য যে কান সিটি স্ক্যানের চেয়ে দ্রুততম। মাত্র ০.৩ সেকেন্ডে স্ক্যানিং সম্পন্ন হয়। সিটি এনজিও গ্রামের মাধ্যমে হার্ট, ব্রেন ও অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গের রক্তনালীর রক্ত প্রবাহের দৃশ্য এবং রক্তনালীর সংকোচন খুঁজে পাওয়া যায়। অতীতের বাইপাস গ্রাফট বা স্ট্যান্টিং করা রোগীদের অপারেশন পরবর্তী চেকআপ সহজেই করা যায়। এছাড়া অন্তঃকর্ণের প্রদাহ, ইন্ট্রাক্রোনিয়াল এনিউরিজম, হোল ব্রেন পাফিউশনস ইত্যাদি অতি সুক্ষ্মভাবে নির্ণয় করা যায়।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও সিমেন্স বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে সেমিনারটি আয়োজন করে। ইবনে সিনা ট্রাস্টের বোর্ড সদস্য কমোডর (অব.) এম আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ট্রাস্টের সদস্য প্রশাসন ডা. একেএম সদরুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান ও ডা. নূরুল ইসলাম। ডা. ওয়াইল্যান্ড সোমার সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ১২৮ স্লাইস সিটি স্ক্যানের কর্ম পদ্ধতি এবং ব্যবহারের কৌশল প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন।

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রফেসর এএনএম আবদুজ্জাহের, সাবেক সচিব বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শাহ আবদুল হান্নান, সিমেন্স বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টরও হেলথ কেয়ার ইঞ্জিনিয়ার হাফিজুর রহমান খান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের জেনারেল ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম খান, চীফ কনসালটেন্ট রেডিওলজিষ্ট মেজর (অব.) আবুল মোকারিম। অংশ নেন দেশ বরেণ্য প্রায় ৭শ’ চিকিৎসক। সেদিন জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেছিলেন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ১২৮ স্লাইস সিটি স্ক্যান ইবনে সিনার নতুন চমক। দেশের চিকিৎসা সেবায় ইবনে সিনা এভাবে অনেক অবদান রেখেছে। সত্যিকারভাবেই তারাই হলো চিকিৎসা খাতের পথপ্রদর্শক।

সভাপতির বক্তব্যে কমোডর অব. এম আতাউর রহমান বলেছিলেন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে ইবনে সিনা সবার আগে। ডায়াগনোস্টিকের জগতেও প্রযুক্তির ব্যবহারে সবার চেয়ে সব সময় ইবনে সিনাই এগিয়ে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইবনে সিনার বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি অন্ধত্ব নিবারণে বিনামূল্যে চোখের ছানি অপারেশন, জন্মগত ঠোঁটকাটা ও বাঁকা পায়ের শিশুদের অপারেশন, দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের বিল মওকুফসহ সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে।

বিনয়ী ও সদালাপী এম আতাউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চৌকষ কর্মকর্তা। তিনি ১৯৫০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনী কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে ব্রিটেনের মানাডন পলিমাউথ থেকে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগ দেন। কমোডর হিসেবে তিনি নৌবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সৈনিক জীবনে তার অনেক কৃতিত্ব রয়েছে। কর্মজীবনে কমোডর (অব.) এম আতাউর রহমান বিআইডাব্লিউটিসি, চালনা বন্দর, টিসিবি ও ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালে কলকাতা বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন।

এম আতাউর রহমান ১৯২৭ সালের ১৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারের পোভাকার্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মরহুমের এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছেন। তার ডাক্তার মেয়ে বৃটেনে কর্মরত। আরেক মেয়ে বুয়েটের অধ্যাপিকা।

কমোডর অব. এম আতাউর রহমান খুবই নির্লোভ ব্যক্তি ছিলেন। কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না তার। সব সময় অন্য মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের চিন্তা করতেন। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথিকৃৎ ছিলেন। মিডিয়া জগতে পত্রিকা ও টেলিভিশন নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চেয়েছেন। তার মৃত্যুতে জাতি একজন কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বকে হারাল। এই শূন্যস্থান সহজে পূরণ হওয়ার নয়। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন।

লেখক: সময় সম্পাদক। সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *