বিলেতে বেশ পরিচিত মুখ ড. রেণু লুৎফা। স্বাভিমান লেখক। সাহিত্য-সাংবাদিকতায় চার যুগ অতিক্রম করেছেন। সিলেটের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরীতে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। এক সময় লন্ডনে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক পূর্বদেশ। ব্রিটেনে বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক সুরমায় অনেক বছর নিয়মিত কলাম লিখেছেন। সেগুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক অঙ্গনে ড. রেণু লুৎফার পরিচয় ঘটে গল্পকার হিসেবে। যদিও সাহিত্যের অন্য শাখাতেও রয়েছে তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা। বিষয়, তত্ত্ব, পদ্ধতি, সাধারণীকরণ সব কিছুতে নিজস্ব স্টাইল বিদ্যমান। গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতার অতলে তিনি আলোকপাত করেন। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, বিষয় বিশ্লেষণ ও লেখার নৈপুণ্যে ঋদ্ধিমান।
প্রখর আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন লেখক রেণু লুৎফার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ইতরের মত সত্য (অক্টোবর ১৯৭৯), হে ঈশ্বর তোমার যবনিকা (জুলাই ১৯৮১), জীবনের বলাকা (মার্চ ১৯৯১), কালের কন্ঠ ১ (জানুয়ারি ২০০২), কালের কন্ঠ ২ (এপ্রিল ২০০৫), স্পর্ধিত আত্মবোধ (ডিসেম্বর ২০০৬), যেতে দিতে পারিনা (জুলাই ২০১২), বৈদগ্ধ অনুলাপ (ফেব্রুয়ারি ২০১৫), সূর্যরাঙা সকাল ডাকে (জুলাই ২০১৮), পথের গল্প (একুশে বইমেলা ২০২৪)।
দ্য এথনিক মাইনরিটি অরিজিনাল হিস্ট্রি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ইউকের মাধ্যমে ড. রেণু লুৎফা বিভিন্ন লেখকের অত্যন্ত মূল্যবান কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত শিকড় সন্ধানী গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলীর ৪ খন্ড রচনা সমগ্র ও চিত্রশিল্লী ইউসুফ চৌধুরীর ‘অ্যান অ্যালবাম অব ১৯৭১ বাংলাদেশ লিবারেশন মুভমেন্ট’।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে রয়েছে অজস্র শিল্পগাথা। স্বাধীনতাযুদ্ধ বাঙ্গালির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। এই যুদ্ধকে সার্বিকভাবে তুলে ধরতে সাংবাদিক-সাহিত্যিক এমনকি ফটো-সাংবাদিকেরা তাদের জীবনের সেরা সৃষ্টি উপহার দিতে বহুভাবে প্রয়াস চালিয়েছেন। যুদ্ধকালীন ঐতিহাসিক চিত্র ও চরিত্র ধারণ করেছেন প্রাণময় ভালোবাসা দিয়ে। এমনি একজন প্রবাসী লেখক ও চিত্রশিল্লী ইউসুফ চৌধুরী।
১৯৯৭ সালে বৃটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (বিবিআইএস) প্রতিষ্ঠার পর প্রবাসী লেখক ও চিত্রশিল্লী ইউসুফ চৌধুরীকে আমি বিবিআইএস প্রাঙ্গণে নিয়েছি এবং আমাদের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানবার সুযোগ করে দিয়েছি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ রুটস অ্যান্ড টেইলস অব বাংলাদেশি সেটেলার, একাত্তরে বিলেত প্রবাসী, সন্স অব এম্পায়ার, বাংলাদেশ টু বার্মিংহাম, দ্য রুটস অব ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্টাল কেটারিং ইন ব্রিটেন, অ্যান অ্যালবাম অব ১৯৭১ বাংলাদেশ লিবারেশন মুভমেন্ট ইত্যাদি ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।
উল্লেখ্য, বিবিআইএস’র ফাউন্ডার ডাইরেক্টর ও রেক্টর হিসেবে আমার আমন্ত্রণে তখন বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের কালজয়ী কবি ও কথা সাহিত্যিক আল মাহমুদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইএ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইকোনমিক্সের সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র জে আর রামানুপ, বিবিসির সাংবাদিক ফ্রান্সেস হরিসন, ব্রিটিশ হাইকমিশনার ডেভিড সি ওয়াকার-সহ দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও কুটনীতিক বিবিআইএস পরিদর্শণ করেছেন।
২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে বিলেত আসার পর মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসিদের অবদান নিয়ে গবেষণামূলক কাজ শুরু করি। এরই এক পর্যায়ে ইউসুফ চৌধুরীর সাথে সংযোগ আরো সুদৃঢ় হয়। এতে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন চেলতেনহাম নিবাসী মাসিক অভিমতের সম্পাদক মন্ডলির চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একাত্তরের আন্দোলনকারীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিসংগ্রামীদের মূল্যায়ন করার উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। তখন অন্যতম সংগঠক হিসেবে লেখক রেণু লুৎফার সাথে আমার সরাসরি পরিচয় ঘটে। যদিও দেশে থেকেও তাঁর লেখালেখির সাথে পরিচিত ছিলাম। ইউসুফ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল হিষ্ট্রি এন্ড রিসার্চ গ্রুপ ও আমরা ১১ জনের উদ্যোগে একটি সফল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করি আমি সাঈদ চৌধুরী। ২০০০ সালের ১৪ মে বার্মিংহ্যামের স্মলহীথ কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত এই মহতি অনুষ্ঠানে গ্রেট বৃটেনের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ গ্রহন করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ মুক্তিযুদ্ধের চিত্র প্রদর্শনীতে ইউসুফ চৌধুরীর নিজস্ব তোলা ৭৪টি ফটো-সহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ছিল। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলার রাখাল বন্ধু জিয়াউর রহমান, বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানী-সহ যুদ্ধের সময়কালীন যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশে আন্দোলনের চালচিত্র এতে সময়ের সাক্ষী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। সেখানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ দূতাবাসের সহকারী রাষ্ট্রদূত এনামুল কবির, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব সভাপতি ও নতুন দিন সম্পাদক মহিব চৌধুরী ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
এখানে উল্লেখ্য যে, ৬ ডিসেম্বর ২০০২ সালে ৭৫ বছর বয়সে ইউসুফ চৌধুরী ইহকাল ত্যাগ করেন। এর আগে তিনি ড. রেণু লুৎফার ঠিকানায় তাঁর পান্ডুলিপি পাঠান এবং মৃত্যুর আগের দিন টেলিফোন করে তা জানিয়ে দেন। এই ঐতিহাসিক আলোকচিত্রগুলো অ্যালবাম আকারে প্রকাশ করেছেন ড. রেনু লুৎফা। এতে তাঁর কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে বিলাতে মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলন মুখর দিন গুলোতে তাঁর ক্যামেরায় তোলা আলোকচিত্রগুলো বাঙালির আগুনঝরা দিনের একেক টুকরো গল্প।
কথাসাহিত্যে ব্যতিক্রমী ধারার উজ্জল তারকা রেণু লুৎফার প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম ‘ইতরের মত সত্য’। বইটি হাতে নিলে বুঝা যায় মানব মনের গহনে রয়েছে তাঁর পদচারণা। সমাজ বিজ্ঞানীর অনুসন্ধান ও সমাদান রূপায়িত করেন লেখাতে। কথামালা সাজান তিনি বুদ্ধিদীপ্ত দক্ষতায়।
বইটির পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় বরেণ্য রেডিও ব্যক্তিত্ব বেলাল মোহাম্মদ লিখেছেন- কি অশ্চর্য, বিরতি ব্যতিরেকেই আমাকে সম্পূর্ণটি পড়ে শেষ করতে হলো এবং এই সারাক্ষণ আমি একটি অপরূপ সহজ সরল স্নিগ্ধ হাতের কবোষ্ণ স্পর্শে চমকিত হলাম। এ যেন একজন মা বুকের সমস্ত উসুম ঢেলে আপনমনে লালন করছেন নিজের রক্তজ জাতককে। নিতান্ত চাতুর্যহীন বাকভঙ্গিতে নির্মিত এই এগারোটি অভিনবত্ব মন্ডিত একই শিরোনামের গল্পপ্রয়াসের অনন্য উপমা হতে পারে জায়নামাজে বা পূজামন্ডপে প্রার্থনারত শ্বেতবসনা রমণীর শুভ্রতা।
২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে লেখা রেণু লুৎফার কলাম সমূহ ‘কালের কন্ঠ’ (১ ও ২) নামে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থের মূল বিষয় হচ্ছে- বৈষম্যের রাজনীতির আবর্তে বিলেতের বাংলাদেশী। প্রবাসীদের প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহের সঙ্গে জড়িত বা পরিচিত এই লেখক। তিনি আমাদের সমাজ বদলের নানা দিকে পর্যালোচনা করে শুদ্ধতম বিকাশের পথ বাতলে দিতে সচেষ্ট। মানুষের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর ভেঙ্গে দিতে হলে এবং সঙ্কীর্ণতার বেড়াজালে থেকে মুক্ত হতে হলে যা প্রয়োজন, সেটি তাঁর লেখায় তুলে ধরেন। জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এবং বিলেতের মাল্টিকালচারাল সোসাইটিতে সাহস আর উদ্দীপনায় নিজের অবস্থান বৃদ্ধির জন্য তিনি সদা সক্রিয়।
‘কালের কন্ঠ’ গ্রন্থের লেখক পরিচিতি দিতে গিয়ে অধ্যাপক কবি ফরীদ আহমদ রেজা মন্তব্য করেছেন- ড. রেণু লুৎফা বিলেতের এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব, পাঠক নন্দিত এক সাহসী কলম সৈনিক। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশে তাঁর জন্ম। মেধা ও যোগ্যতার বলে আজ তিনি অসংখ্য জাতি-উপজাতির মিলনকেন্দ্র ব্রিটেনের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মধ্যে নিজের জন্য এক সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন। … রেণু লুৎফার মধ্যে প্রাচ্য কালচার ও পাশ্চাত্য উদ্যমের আশচর্য সমন্বয় ঘটেছে। দক্ষতা ও কর্মের এক উজ্জ্বল ফল্গুধারা তাঁর মাঝে সতত প্রবাহমান। মননশীলতা ও প্রচারবিমুখতা তাঁর সৌন্দর্য এবং কাজ করে তিনি আনন্দ লাভ করেন। বিলেতের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রবীনদের তিনি বিশ্বস্ত বন্ধু এবং নবীনদের জন্যে তিনি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পরিচিত।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে বেরিয়েছে রেণু লুৎফার ‘স্পর্ধিত আত্মবোধ’। এই গ্রন্থের লেখা থেকেই তাঁর চিন্তার ব্যাপকতা এবং সাহসিকতার পরিচয় মেলে। তিনি যা সত্য মনে করেন, সাহসের সাথে তা উপস্থাপন করেন। ‘ব্রিটিশ রাজনীতির ধারা ও বাংলাদেশী লিডারদের দূর্নীতি’, ‘রাজনীতি ব্যবসায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ’, ‘কার বক্তব্যটি সরকারী, মন্ত্রীর না আমলার?’, ‘বিলেতবাসী সিলেটিদের উপেক্ষার সাম্প্রতিক নমুনা’, ‘ভারতীয় গরুর বিনিময়ে বাংলাদেশী নারী’, ‘ভারতে সংখ্যালঘু সম্পর্কে বুদ্ধিজীবীরা কি বলবেন?’, ‘এসাইলাম, পশ্চিমা বিশ্ব ও বাংলাদেশের বদনাম’, ‘ব্রিটিশনেস, বর্ণবাদ ও অভিবাসী সমাজ’ ইত্যাদি শিরোনাম দেখলেই তাঁর চিন্তামূলক আবেদন উপলব্ধি করা সহজ হবে।
রেণু লুৎফার ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’ প্রখর। নিজেকে জানা (সেলফ অ্যাওয়ারনেস), নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা (সেলফ ম্যানেজমেন্ট) সামাজিক সচেতনতা (সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস) ও সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা (রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট) মুগ্ধ হবার মত। বিচিত্র স্বাদের ক্ষুরধার লেখনী আর জীবন যাপনের ক্ষেত্রে তিনি স্টেট ফরওয়ার্ড।
‘স্টেট ফরওয়ার্ড’ নামে আরটিভিতে একটি নাটক দেখেছিলাম। একজন সৎ মানুষ জীবনে চলতে গিয়ে, সব সময় সত্য কথা বলতে গিয়ে অনেকের কাছে ঠোঁটকাটা মানুষ হিসেবে পরিচিতি পান। আবার সত্য বলতে গিয়ে জীবনে নানান বিপদেও পড়েন তিনি। পরে জেনেছি, নাটকটি দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে। এভাবে বক্তব্যের স্পস্টতা রেণু লুৎফাকেও পাঠক প্রিয় করেছে।
২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়েছে রেণু লুৎফার কবিতার বই ‘যেতে দিতে পারিনা’। এই গ্রন্থের বেশ স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল কিছু কবিতা পড়ে শুনিয়েছি আমার কবি বন্ধুদের। গুণীজনেরা এতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
রেণু লুৎফা লিখেছেন- আমাদের পূর্বসূরিদের অভীষ্ট সাধনার্থ/ প্রচেষ্টার ফলে এখন আমরা/ সবাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর বিশিষ্ট সমাজসেবী/ কিম্বা রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী/ এখন দু’চার মিনিট খৈ ফুটিয়ে তুলতে পারি/ এই ভিনদেশি ভাষায়।/ আরো জমি আরো জমি এসব/ এখন পূর্বের কথা; এখন/ আমরা আরো শক্তি আরো শক্তি চাই।/ জঘন্য মাজারবৃত্তি, কপটতা/ কুটিল ক্ষুদ্রতা লোক দেখানো প্রণম্য সব/ আমলাদের অনির্বচনীয়, কারণ/ উদ্দেশ্য সুমহান- লোক দেখানো কেবল।
‘পরাজিত’ কবিতার পংক্তিমালায় লেখকের অন্তর্জগতের আবেগ আর অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে এভাবে- সমমনারা কোনো সময়েই সুমনা হয়না/ শুভাকাঙক্ষীরা কোনো সময়ই সমব্যথী নয়/ আমি তাই কাউকে কিছু বলতে পারি না/ কোনো মতে বুঝতে পারি না-/
‘একুশ’ কবিতায় আবেগ আর প্রজ্ঞার মিশেলে লেখকের মনোভূমি উপলব্ধি করা যায়। তিনি লেখেন- বিশ্ব মাঝে আসন দিতে/ তুমি আমায় ডাক দিয়েছো/ যে ডাক আমায়/ তারার পানে ছুটতে বলে/ সাত সাগরের অপর পারে/ ফুটতে বলে/ তোমার কাছে ঋণী আমি/ ভীষণ ঋণী/ যেমন ঋণী মায়ের কাছে।
‘যেতে দিতে পারিনা’ বইয়ের মলাটে লেখক ফারুক আহমদ উল্লেখ করেছেন- রেণূ লুৎফা ব্রিটেনের বহুজাতিক সমাজে সুপরিচিত মেধাবী একজন প্রচারবিমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। দুটি শব্দের বাঁধনে বাঁধা নামটি কবি, গল্পকার, সাংবাদিক, কলামিস্ট, সমাজকর্মী, সংগঠক এবং জাস্টিস অব পিস ইত্যাদি অনেক পরিচয়ে পরিচিত।
২০১৫ সালের ১২ আগস্ট সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে অমি পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের বায়োজিদ মাহমুদকে নিয়ে ড. রেণু লুৎফার ‘বৈদগ্ধ অনুলাপ’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। প্রকাশনা ও পাঠ পর্বে লেখকের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কবি ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. রেণু লুৎফা বলেন, সাহিত্যকে দলীয় মতাদর্শের বাইরে রাখা উচিত। এটা খুবই দুঃখজনক যে, এখন ভিন্নমতের মানুষের সহাবস্থানের পরিবেশ নষ্ট হতে চলেছে। এটা কোনভাবে হতে দেয়া যায়না। সত্তর দশকে আমরা মুসলিম সাহিত্য সংসদে দলমত নির্বিশেষে একত্রে কাজ করেছি। আমাদের সে ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে।
এক্সেলসিয়র সিলেট হোটেল এন্ড রিসোর্টের নান্দনিক পরিবেশে বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের এই জমজমাট অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রিন্সিপাল কবি কালাম আজাদ। প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অনলাইন দৈনিক সময়’র প্রধান সম্পাদক মুক্তাবিস-উন্-নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি লাভলী চৌধুরী, সিলেট লেখিকা সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভানেত্রী অধ্যাপিকা রওশন আরা চৌধুরী, দৈনিক জালালাবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক মানিক। বিশিষ্ট কবি মুকুল চৌধুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক কবি নিজাম উদ্দীন সালেহ।
ড. রেণু লুৎফা প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের জন্য বিশেষভাবে সিলেট অঞ্চলের জন্য কাজ করতে অত্যন্ত আগ্রহী ও আন্তরিক। তাদের কাছে যথাযথভাবে বিভিন্ন প্রকল্প উপস্থাপন করা হলে তা বাস্তবায়নে কোন বাঁধা থাকার কথা নয়। দেশের মানুষকেও তাদের দাবি দাওয়া আদায়ে উদ্যোগী, প্রয়োজনে বিদ্রোহী হতে হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আশির দশক থেকে কাব্য ও সাহিত্য অঙ্গনে কবি রেণু লুৎফার বিচরণ। ‘বৈদগ্ধ অনুলাপ’ গ্রন্থে তাঁর সমাজ সচেতনতাবোধ প্রকাশ পেয়েছে। সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও সমস্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি দ্বিধাহীন ও স্পষ্টবাদী। ড. রেণু লুৎফার লেখা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য। তাঁর জীবনবোধ যেমন স্পস্ট তেমনি সহজভাবে তা গন্থে প্রকাশ করেছেন।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ড. রেণু লুৎফার ‘সুর্যরাঙা সকাল ডাকে’ গ্রন্থের কথাসুত্র- সুর্যরাঙা সকাল ডাকে। গাছের হলুদ পাখির রঙ আজও আমার চোখে খেলা করে। দীর্ঘদিন দেশ-ছাড়া। চেষ্টা করি বছর বা দু’বছরে একবার দেশে যাই। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, যা রেখে এসেছিলাম ফিরে গিয়ে কেবল তাই খুঁজি, কিন্তু পাই না। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। শৈশবের কোনো কিছুই আমার জন্য থেমে নেই। ফিরে প্রতিবারই হোঁচট খাই, আমার বেড়ে ওঠা সময়ের, পরিবেশ পরিবর্তন দেখে। হৃদয়টা মোচড় দিয়ে ওঠে।
… রেণু লুৎফার এমন স্মৃতিকাতরতা সুতীব্র অনুভূতি দিয়ে অবলোকন করেছেন কবি ও গবেষক অধ্যাপক ফরীদ আহমদ রেজা। স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যাবার আগে তা লিপিবদ্ধ করে রাখার খায়েশ থেকে এখানে-সেখানে লেখা, গোটা-তিনেক ল্যাপটপে ছড়িয়ে থাকা লেখাগুলো গুছিয়ে দিলেন তিনি।
বইয়ের স্মৃতিময় শিরোনাম হল: আমার শৈশব, শিশুকালের স্মৃতি, প্রাক স্কুল জীবন, হাতের লেখা, আমার প্রাইমারি শিক্ষা, আমাদের স্কুল, টাকার মান, মানুষের মর্যাদা, রাজকুমারী, পীর ভাই, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, শিশুমনের ভয়-ভীতি, বৃত্তি পরীক্ষা, আমাদের কালের যানবাহন, আমাদের সকাল বেলা, আমাদের দায়-দায়িত্ব, গ্রামের ফেরিওয়ালা, ঈদ, সেকালের বিয়ে, দরগা দর্শন, আমাদের গ্রাম, সংবাদ পত্রের সাথে পরিচয়, স্কুলের পাঠক্রম, বাজার ও দোকানপাট, রাণাপিং মাদ্রাসা, নির্বাচন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, খুন, ইসতারি (ইফতারি), আম-কাঁঠালি, নানার বাড়ি, পাখি শিকার, বাড়িতে পুথি পাঠের আসর, লন্ডনি, লণ্ঠন লেকচার, চিঠি লেখা, আমাদের কালের শিশুরা, বাঘ ধরা, ফটো অ্যালবাম।
এখানে বিষয়বস্তুর উচ্চতা কিংবা তুচ্ছতা বিবেচ্য নয়। লেখার রস ও মানবিক বোধ আমার কাছে প্রধান্য পেয়েছে। শব্দের সুষমা ও ব্যঞ্জনায় বইটি পাঠকের হৃদয়ে আদরণীয় হবে বলে আমার বিশ্বাস।
নিজের শৈশব সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে রেণু লুৎফা লিখেছেন, আমার জন্মের পূর্বেই আম্মাকে না-দেখেই কোনো এক দরবেশ আব্বার হাতে একটি স্বর্ণের কানের দুল ও মোটা এক টাকার নোট তুলে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার একটি মেয়ে জন্ম নেবে, এগুলো তার জন্য। সেই স্বর্ণের দুলটি আজও রয়েছে আমার কাছে। … দরবেশ তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে কী আঁচ করতে পেরেছিলেন জানি না, তবে নিজের সম্পর্কে একটা শক্ত জোরালো মনোভাব ছিল সেই শৈশব থেকেই। নিজে জেনেশুনে তারপর মতামত দেই। ভেড়ার মতো কাউকে অনুসরণ করতে শিখিনি। নিজের উর্ধ্বে কারো মতামত আমাকে প্রভাবিত করেনি কোন কালেও। অন্ধভাবে কাউকে বা কোনো পক্ষকে কখনোই অনুসরণ করিনি। শাদাকে শাদা আর কালোকে কালো বলি বরাবরই। ক্ষমতা নাম-যশ কখনোই আমাকে টানে না। নিজের বিবেকের কাছে নতজানু আমি। মানুষ হওয়াটা আমার লক্ষ্য ছিল এবং আছে।
এই আত্মপরিচয় থেকেই লেখকের মানস ভাবনা পরিস্ফুট হয়। তাঁর সমাজ-চিন্তা-চেতনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। একইভাবে তাঁর সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদন করা যায়।
ছাড়াকার রব্বানী চৌধুরীর মতে, কথাসাহিত্যিক রেণু লুৎফার এই গ্রন্থটি আমাদেরকে পঞ্চাশ-ষাট দশকের গ্রাম বাংলায় নিয়ে যায়। লেখক দেশ ছাড়লেও ছাড়তে পারেন নি তাঁর জনম-মাটির মায়া। আজও তাঁর বাবার গন্ধ বুকে নিয়ে সাত সাগরের ওপার থেকে লিখেছেন এই অখ্যান। বাঁশের কলমে লেখা সেই সুলেখা কালির দিনগুলো।
রেণু লুৎফার ‘পথের গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে এবারের একুশে বই মেলায়। মোট ২২টি লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। প্রতিটি লেখা ভিন্ন অবয়বে রচিত। বিষয়ে ভিন্নতা থাকলেও নির্মল জলের মতো সচ্ছ তাঁর ভাবনা।
সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন মীল লিয়াকত আলী লিখেছেন, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে যারা সাহিত্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে রেণু লুৎফা একটি অপরিহার্য নাম। … ব্রিটেনে যাবার পরও কিন্তু তাঁর লেখালেখি থেমে থাকেনি। লেখালেখি ছাড়াও তিনি শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যান।
পথের গল্প ১: সুপারভাইজিং মিটিং চলাকালে সহকর্মী হেলেন বোমা ফাটিয়ে ঘোষণা দিলেন তিনি পদত্যাগ করতে চান। তাঁর এই ঘোষণায় আকাশ ভেঙে পড়ার আক্ষরিক ভাবার্থ টের পেলাম। … নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রিন্সিপালের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। ৫ সেন্টার মিলে মোট ৯জন নারী কর্মচারী মেটারনিটি ছুটির আবেদন করেছেন। একপর্যায়ে বলেই ফেললেন, তিনি মনে করছেন এটা তাকে বেহাল করার ইচ্চাকৃত পদক্ষেপ। মানুষ দিশেহারা হলে অনেক কিছুই বলে, আমরা তাই কোন ভ্রূক্ষেপ করলাম না। তবে চকিতে একে অন্যের চোখের ভাষা পড়তে ভুল করলাম না।
পথের গল্প ২: ব্যারিস্টার সাহেবের সাথে আমার যখন দেখা হয়, তখন তিনি পুরোদস্তুর একজন ওয়েটার। ছোটখাটো মানুষ, টেকসই পরিপাটি কাপড় চোপড়, পায়ে চকচকে দামি জুতা। খাটো মানুষের বয়স ঠাহর করা যায় না। চল্লিশ বা পঁচিশও হতে পারে। ভালো ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ বলেন। এককালে ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টেও কাজ করেছেন, ফ্রেঞ্চ মেয়ে বন্ধুও ছিল দীর্ঘ দিন।
পথের গল্প ২২: ন’টার ট্রেনে আসার কথা হলেও এখন বাজে পৌনে দশটা। লিহার দেখা নেই। আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে মানুষের ভিড়ে তাকে খুঁজি। বিরক্ত হতে হতে মানুষ দেখি। মানুষ দেখা আমার অনেকগুলো প্রিয় শখের একটি। আমি তাদের দেখি আর তাদের জীবন ছবি আঁকার চেষ্টা করি। কত রঙের, জাতের, বয়সের, ইতিহাসের, মানুষের ভিড়ে আমি লিহাকে খুঁজি। মাঝে মাঝে দেখি এই যে লিহা আসছে। কাঁধে ঝোলানো পরিচিত ব্যাগ, নতুন করে রং ছটানো চুলে বেশ মানিয়েছে তাকে, যদিও ওজনটা একটু বেশি দেখাচ্ছে। টিকেট বেরিয়ার পার হতেই দেখি লিহা নয়, অন্য কেউ।
প্রথম, দ্বিতীয় এবং শেষের গল্প থেকে সামান্য নিলাম। এই বর্ণনা থেকেই কল্পনা করতে পারবেন কেউ কেউ। কল্পলোকে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেই লেখেন রেণু লুৎফা। জ্যোৎস্নার শিশিরের মতো ব্যাপৃত হয় পাঠকের দেহ মনে।
• সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক