সোহেল তাজ: যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে তিন দফা দাবি জানিয়েছেন তিনি

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ কয়েকটি দাবি তুলে সম্প্রতি আবারও আলোচনায় এসেছেন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সরকার গঠন, ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যা, এই দিনগুলোকে বর্তমান সরকার সঠিকভাবে পালন করছে না বলে এর গুরুত্ব ভুলে গেছেন অনেকে। জেল হত্যা দিবস এখনো পর্যন্ত কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়নি সেনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

তবে আওয়ামী লীগের একজন নেতা তার বক্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, সোহেল তাজ পুরনো বিষয় ঘেঁটে বিতর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন ।

এই আলোচনার সূত্রপাত গতকাল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে, সোহেল তাজ হঠাৎ করেই বিকেলে ছোট একটি মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে হাজির হন।

সেখানে স্মারকলিপি দিয়ে তিনি দাবি তুলেছেন ১০ এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস এবং ৩ নভেম্বরকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। যদিও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার দিন ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সকল সংগঠক, পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধাসহ সেসময় গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাঠ্য পুস্তকে তুলে ধরারও দাবি জানিয়েছেন সোহেল তাজ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। এর কয়েকদিন পর ১৭ই এপ্রিল এখনকার মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় ওই সরকার শপথ গ্রহণ করে ।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর – যাদের মধ্যে ছিলেন সেই সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে এই সরকারের হয়ে যে দায়িত্ব তারা পালন করেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে তা অনেকটাই আড়াল হয়ে গেছে, বিভিন্ন সময় এমন কথা উঠেছে। গত বেশ কিছুদিন যাবত দল, প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্য সম্পর্কিত দিবস অনেক বেশি ঘটা করে উদযাপন করার প্রবণতা দেখা গেছে। সবকিছু শুধুমাত্র একটি দলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে প্রায়শই অভিযোগ ওঠে।

যে জায়গাটিতে শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানকার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর এবং ১৭ এপ্রিলকে মুজিবনগর দিবসও ঘোষণা করা হয়।

বিবিসি বাংলাকে সোহেল তাজ বলেছেন, “৩রা নভেম্বর জেল হত্যা দিবস হিসেবে পরিচিত। জাতীয় চার নেতা – যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন – বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাদেরকে নির্মমভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হল। বাংলাদেশের সাথে তারা কোনদিন বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তারা স্বেচ্ছায় জীবন দিয়ে গেছেন।

“এই ঘটনা জাতির ইতিহাসে একটা কলঙ্ক তো বটেই, কিন্তু অনুপ্রেরণারও ক্ষেত্র। আমরা জানি যে ১২ বছর আগে আওয়ামী ক্ষমতায় ছিল না, যারা ক্ষমতায় ছিল তারা হয়ত চায়নি, কিন্তু বিগত ১২ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। জেল হত্যা দিবস এখনো পর্যন্ত কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হল না – আমার আসলে তা বোধগম্য হয় না।”

তার ভাষায়, “স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পার হয়ে গেল। এই সময়ে এসে নানা জরীপে দেখা যাচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা স্মৃতি সৌধ এবং শহীদ মিনারের পার্থক্য জানে না। জাতীয় চার নেতার নাম জিজ্ঞেস করলে জরীপে তারা বলেছে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া এবং এরশাদ।”

এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন একটি স্বার্থান্বেষী মহল আছে যারা তোষামোদি পছন্দ করে। তাদের কারণে সঠিক ইতিহাস বের হয়ে আসছে না। আর সেজন্যেই তিনি এসব দাবি তুলেছেন যাতে করে এই দিনগুলো যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়।

সোহেল তাজ বলেছেন, “বাংলাদেশের প্রথম সরকার দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে। বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া, সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছিল। ওইরকম সময়ে সতর্কভাবে কূটনীতি চালানো, এক কোটি শরণার্থীকে সামাল দেয়া, সঠিকভাবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে তাদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো, মুক্তি বাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া, বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধের কৌশল তৈরি করা, আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা সহ আরো হাজারটা কাজ সেই সরকারকে করতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের অস্তিত্ব বাংলাদেশের প্রথম সরকার থেকেই শুরু হয়। এসব কারণে এই দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা করা অতি জরুরী।”

দু’হাজার নয় সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন সোহেল তাজ। মাস ছয়েকের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হতে দেখা গেছে। রাজনীতিতে তিনি দীর্ঘদিন নীরব ছিলেন। তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নানা কারণে আলোচনায় ছিলেন। এখন তিন দফা দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যাওয়ার কারণে তিনি আবারও আলোচনায় এসেছেন।

তার তোলা দাবি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “এসব দিবস সঠিক মর্যাদায় পালিত হয় না এমন মন্তব্য যদি উনি করে থাকেন – তাহলে সেটি উনি সঠিক বলেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং জেল হত্যার মধ্য দিয়ে এটা বোঝা গিয়েছিল যে এগুলো ব্যক্তি বা পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নয়।

“তাঁরা শুধু তার (সোহেল তাজ) পরিবারের অভিভাবক না, তারা বাংলাদেশের অভিভাবক। তিনি (তাজউদ্দীন আহমেদ) শুধু সোহেল তাজের বাবা নয়। তিনি অনেক উঁচু জায়গায় অবস্থান করেন। এই ঘটনাকে (জেল হত্যা) তার পরিবারের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে ঘটনাটিকে উনি ছোট করে ফেলছেন।”

তিনি বলেছেন, “এই ব্যক্তিত্বদের খাটো করার কোন সুযোগ নেই। কখনোই অবহেলা বা অমর্যাদা করা হয়নি। খালেদা জিয়া এরশাদ অনেক চেষ্টা করেছে। আজকে তো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। কিন্তু আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম না তখনও, ৭৫ পরবর্তী সময় থেকে আওয়ামী লীগই জনগণকে দিয়ে দিনটি পালন করেছে। ১৭ এপ্রিল, ৩ নভেম্বরকে জাতির কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ এসব দিবস পালন করেছে।”

তিনি বলছেন, ১৭ ই এপ্রিলকে বিশেষ মর্যাদার জায়গা দেয়া হয়েছে বলেই মুজিবনগরকে উপজেলা করা হয়েছে, সেখানে যাদুঘর করা হয়েছে, স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে, মুজিবনগর দিবস পালন করা হয়। তার ভাষায়, “এখন নতুন করে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার কোন মানে হয় না।” – বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *