সোলায়মান আহসান : কবি ও কথাশিল্পী

সময় সাহিত্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

আশির দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি ও কথাসাহিত্যিক সোলায়মান আহসান। পৈতৃক নিবাস সিলেটে। জন্মসূত্রে ঢাকার বাসিন্দা। শিক্ষাজীবনের উত্তাল সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। কিন্তু জীবনের প্রতিটি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলাসাহিত্যের সাথে। লেখকসূত্রেই বাংলাভাষাভাষী মানুষের পরিচিতজন। তিনি মননশীল-বিশ্বাসী মানুষের প্রিয় কবি। ক্রমেই তিনি দেশের পরিসীমা পেরিয়ে অন্যভাষার মানুষের কাছেও পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছেন। পুরো পৃথিবীই এখন তার আবাস। মূল্যবোধ ও নান্দনিকতা তার রচনার পলে পলে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সুঘ্রাণে মাতিয়েছেন বাংলা কবিতা, মুগ্ধ করেছেন কথাসাহিত্য, সবুজাভ উল্লাসে জমিয়ে তুলেছেন কিশোর সাহিত্যাঙ্গন। তাইতো আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনিবার্য নাম সোলায়মান আহসান।

বাংলা সাহিত্যের আশির দশক মানেই ভিন্ন রঙের বিশ্লেষণ। প্রচলিত ধারা থেকে বাঁক ঘুরিয়ে নতুন স্রোতের টানে যাত্রা। নারী দেহের রসালো চিত্রায়ন থেকে নারীকে সমাজ বিনির্মাণের অংশীদার করে গড়ে তোলা। মানবিক মূল্যবোধের পৃথিবী গড়ার স্বপ্নযাত্রায় নারীকে মহীয়সীর মর্যাদায় নান্দনিক উপস্থাপন। জীবনবোধের বাঁকমোহনার প্রতিটি ঢেউকে ঘিরে সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি। বিশ্বাসের সবুজাভ আবহে বাংলা সাহিত্যকে মানবিক প্রেসকিপশনে ছড়িয়ে দেয়া। মানবমুক্তির প্রয়োজনে দাঁতাল শুয়োর এবং লাশখেকো শকুনের উৎখাতে বজ্রকঠিন শপথে মুষ্টিবদ্ধ হাত। মুখে মুখে উচ্চকিত মানবিক স্লোগান। রক্তের কণিকা মিশিয়ে কাব্যপথকে লালগালিচায় সুশোভিত করা। এই কঠিন যাত্রায় যারা নাবিকের ভূমিকায় দক্ষ হাতে হাল ধরেছেন কবি সোলায়মান আহসান তাদের অন্যতম।

‘দাঁড়াও স্বকাল বিরূপতা ’কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্যদিয়ে সোলায়মান আহসান কবিতার জগতে তার শক্ত অবস্থানের স্বীকৃতি আদায় করেন ১৯৮৫ সালে। অশ্লীলতাকে না ঘোষণা দিয়ে মানবিক প্রেমে উজ্জীবিত করেছেন কাব্যজগৎ। জীবন-সংগ্রামের বিশ্বাসী কর্মযোদ্ধা হিসেবে সমাজকে পাল্টিয়ে দেয়ার এক দুঃসাহসী ঘোষণা দিয়েছেন এ গ্রন্থে। নতুন সকালের অনুসন্ধানে এক কর্মচঞ্চল নাবিক হিসেবে কবিতার মুক্তোয় নির্মাণে করেছেন কাব্যগ্রন্থটি। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। সময়ের সুরে সাজিয়ে নিয়েছেন কৃষ্ণস্বর প্রত্যুষের, নক্ষত্রের বিলাসিতা, শূন্য ও শূন্যতা, যুদ্ধের বিপক্ষে জিঘাংসা, ফেলো বীজ স্বপ্নবুকে, ভয় নাই জেগে আছি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, আশির দশক নামের কবিতার ডালি। নতুন স্বপ্নের মানবিক পৃথিবী নির্মাণ করতে তিনি কলমের সাথে সখ্য গড়েছেন, তৈরি করেছেন পরিশীলিত কাব্যভাণ্ডার।

কবি সোলায়মান আহসানের প্রকাশিত সাতটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা দুই শত ছাব্বিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। বাছাই করেছেন কবি নিজেই। তাঁর প্রতিটি কবিতায় উঠে এসেছে মাানুষ ও মানবতা, মানবিক মূল্যবোধের সুবাসিত ঘ্রাণ, জীবন সাগরের সুগভীর উচ্চারণ, নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ স্লোগান, কাব্যভুবনের ক্যানভাস জুড়ে বিস্তীর্ণ সবুজাভ স্বদেশ, ঝর্ণার স্বচ্ছ স্রোতের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন জীবনের বহতা নদী, চোখের কোনায় কোনায় ফুটিয়ে তুলেছেন শাপলা-পদ্ম ফোটা মায়াবী খাল-বিল, স্বদেশের মাটির কণায় কণায় পতপত করে উড়িয়ে দিয়েছেন বিজয়ের স্বপ্নউল্লাস। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সুখময় আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছেন উপমা আর উৎপ্রেক্ষার ভাঁজে ভাঁজে। মানবিক প্রেমকে আরো গভীরতম উচ্ছ্বাসে ঘুরিয়ে দিয়েছেন মহান আল্লাহর পদতলে। স্বদেশসহ বিশ্বময় জমিনে ছড়িয়ে থাকা অসহায়-নিপীড়িত মানুষের অব্যক্ত আর্তনাদকে কবিতার সুষমায় মিশিয়ে দিয়েছেন আকাশে বাতাসে। পরাধীনতার দীর্ঘশ্বাসকে সাহসের ঘোড়ায় সওয়ার করিয়ে বিশ্বজয়ী বীর তারিক-মুসা, সালাহদীনের বক্ষে তুলে দিয়েছেন। সেই দীর্ঘশ্বাস থেকে তিনি বিজয়ের স্বপ্নফুল নির্মাণের জন্য কাব্যচাষে এগিয়ে চলেছেন। তাইতো তার কবিতায় শিল্পময় ঢঙের সাথে জীবনের অনুষঙ্গ উঠে এসেছে বৃক্ষ এবং বাকলের মতো ভালোবাসাময় বন্ধনে। ‘আর তাই আজো আমার স্থূল কলমকে ঘষে ঘষে/একটা মিসাইলের তীক্ষèতা সৃষ্টিতে প্রয়াসী’ ‘প্রয়োজন পৌরুষের, সরাতে কালের অন্ধকার/সুগভীর তলা থেকে উপড়ান শক্তি মজবুত’ ‘এখন প্রয়োজন বড় আত্মার স্বকীয় উচ্চারণ’।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২ সালে প্রকাশিত নাকপোড়া বারুদের গন্ধে কাব্যগ্রন্থেও কাব্যসাহিত্যিকে মানবিক মূল্যবোধের পুষ্প হিসেবে সার্থকভাবে চিত্রিত করতে সক্ষম হন। তাইতো সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন, ‘কখনো সরল কখনো এঁকেবেঁকে চলা নদীর মতো কবিতা/কবিতার ভেতর মানুষের মৃদু পায়ে চলার সুমতি থাকে/কখনো সামুদ্রিক উত্তালতা- ঘূর্ণি বায়ুর সঙ্গে মিতালী- সতর্ক সঙ্কেত দশ নম্বর/মহাবিপদ- কবিতা/শব্দের পিঠে চড়ে টগবগে আরবি ঘোড়ায় হারিয়ে যাওয়া- বহুদূর কবিতা চলে যায়।’ কাব্যগ্রন্থের ভাঁজে ভাঁজে মানবিক পঙক্তিমালা উচ্চকিত করে সাহসের স্বপ্নমিছিল। ‘জানতে পারিনি ঘেরা কাঁটাতার বিবেকের খিল- মাথার ওপর উড়ে শকুনি পিশাচী হায় চিল!’ ‘ফিলিস্তিন চেনিয়া কাশ্মির রোহিঙ্গা অতঃপর/বন্দিদশা আফগান, রোরুদ্য সিরিয়া মিন্দানাও/লিবিয়া কসোভো চাদ স্বাধীনতা পায়নি তারাও/ ছটফট দিন কাটে, চীনের বিপন্ন উইঘুর।’ ‘লাল গোলাপের মতো তার শরীর ক্যামেরা লালে লাল হয়েছিল।’

‘তরুণদের চোখে ছানি পড়া ভীষণ বিপদ’। ‘আমার দু’চোখ বন্ধ করতে পারব না/ মানুষ করছে পান মানুষের রক্ত বলতে পারব না? না না না এমন সীমাবদ্ধ জলে আমি নৌকা ভাসাতে পারব না।’ ‘আমার বুকে বেদনার উত্তাল তরঙ্গ ভাঙছে পাড়’ ‘রাজপারিতোষিতপ্রাপ্ত তেলতেলে শরীরের ওসব কবিতা আমার প্রয়োজন নেই’। ‘বুঝে নাও মন আহা, প্রকৃতির হিসেব সমেত/ আসছে তুফান এক মনে রেখো, শব্দের সংকেত।’ ‘আমাদের চার পাশ ফাঁকা হচ্ছে, থেমে সমকাল/কিভাবে তাহলে বলো পাড়ি দেবো উত্তাল সাগর/ মাল্লারা হারিয়ে গেলে কে ধরবে এ নৌকার হাল, যতোই সান্ত্বনা বাণী শোনাও না থামবে না ঝড়।’ ‘সে পারে বিজয়ী হতে, তার নাম লিখে মহাকাল/ তেমনি বীরের পাশে বেঁচে রবে তুমি চিরকাল।’ ‘আজ আমাদের দাঁড়াতে হবে এক ময়দানে/ঐক্যের সুকঠিন বেষ্টনীতে বানাতে হবে দুর্ভেদ্য দুর্গ/ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মিলিত সহঅবস্থানে/ মানবতার শত্রুদের ওপর/ বুকে রাখতে হবে বল, তবেই চূড়ান্ত বিজয়!’

কথাসাহিত্যের চলমান ধারা থেকে একটু ভিন্ন আঙিকে পথ চলা শুরু করেছে আশির দশক। কথাশিল্পী সোলায়মান আহসান সেই নতুন পথের অন্যতম রাহবার। গল্প, উপন্যাসে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের মানবিক মাত্রা সংযোজন করেছেন তিনি। গল্পের টান টান উত্তেজনা যৌনতার মোড়কে নয়, সমাজবাস্তবতার নান্দনিক সমীকরণে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের শেকড় ছুঁয়ে তিনি বাংলাদেশকে নির্মাণ করেছেন। নির্মাণ করেছেন মানবিক সমাজের আলোকিত ক্যানভাস। সুদূরের ভালবাসা, অলক্ষ্যে অগোচরে, লোহালিয়ার বাঁকে, চর শান্দার উপাখ্যানসহ ভিন্নমাত্রার উপন্যাসগুলোতে সমাজবাস্তবতাকে মানবিক উপলব্ধিতে চিত্রিত করেছেন কোনো প্রকার যৌনবিবরণ ছাড়াই। চারটি নভেলা নিয়ে প্রকাশিত শ্রাবণ আসার আগে বাংলা নভেলার ক্ষেত্রে অনন্য সংযোজন। অচেনা সুবাস, অবোধ্য প্রণয় এবং শোপিস গল্পগ্রন্থ তিনটি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছে। কাহিনী, শব্দচয়ন, গল্পের প্লট নির্মাণসহ গল্পগুলোকে আঁটসাঁট বাঁধনে নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

নিয়নবাতির ঝলমলে ইনিংসে মত্ত আমাদের নতুন প্রজন্ম। মোবাইল ও ইন্টারনেট সংস্কৃতির মায়াবী ছোবলে চোখের মণিতে বসছে রঙিন ফোকাল, দুর্ধর্ষ আগ্রাসী লেন্স। সেই চোখে সবুজের কোমল পরশ বুলিয়ে মানবিক সমাজের আলোকিত ভুবনে স্বাগত জানাতে কলম ধরেছেন সোলায়মান আহসান। রহস্যময় চাবি, জলময়ুরীতে চব্বিশ ঘণ্টা, যত সব ভূতুরে গল্প, সেই পাখি কোন পাখি, চিকেন ইটার হুলোর কাণ্ড, সেই বিজয়ের গল্প-সহ কিশোর উপন্যাস সমগ্র প্রথমখণ্ডে তিনি কিশোর মনের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। কিশোর সাহিত্যের খরা মাঠে সম্ভাবনার দিগন্তে ফুটিয়ে তুলেছেন সুবাসিত লালগোলাপ।

পরিশেষে বলতেই হয়, সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা কোনো কবি নন সোলায়মান আহসান। বৈরী বাতাসে লাগাম টেনে তিনি মানবতার শ্লোক নির্মাণ করেন কালের উল্টো পীঠে। মূল্যবোধের কোমল সুবাসে সাজিয়ে চলেন জীবনবাস্তবতার নান্দনিক পাঠ। বর্ণমালার সুবাসিত পাপড়িতে নির্মাণ করেন কাব্যসখির অবয়ব। তথাকথিত সৌন্দর্য-লালসার মগ্নতা কখনো স্পর্শ করে না তাকে। নিখাদ প্রেমের মশাল জ্বালিয়ে পথ চলতে অভ্যস্ত তিনি পুরো সাহিত্য জীবনেই। তাইতো তার কবিতার ভাঁজে ভাঁজে সুগন্ধি বাতাস, মানবতার গান, কষ্টের স্বপ্নদাগ।

শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনের ২৩ পৃষ্ঠায় ‘ডাক দিয়ে যায়’ কবিতায় কবি সোলায়মান আহসান আহ্বান করেন- ‘এখন চেঁচাও সবে, নারা দাও-আত তাকবির/পৌঁছে যাক মর্মাবধি রয়েছে যে সর্বশেষ ঘুমে/ হয়নি কাতারবন্দী গৌরবের এ-ই রণভূমে/ কালের দোলক দেয় ঘণ্টাধ্বনি- দাঁড়াও হে বীর।’ বিশ্বায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তির বেয়াড়াপনা তাণ্ডবের বিরুদ্ধেও তিনি দাঁড়িয়েছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। ইতিহাসের গলিপথ পেরিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন সীমাহীন দিগন্তে। নিবন্ধ প্রবন্ধের শব্দবাক্যে তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন ভাঙা-গড়ার মহোৎসব। কবির শাণিত কলম চলতে থাকুক সাবলীল ঝরনার মতো। নির্মিত হোক নতুন স্বপ্ন; প্রেমযুক্ত মানবিক সমাজ।


ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ, কবি ও গবেষক। প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *