সেলফিকাণ্ডে সরকারের বিপদ!

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আসিফ নজরুল, নিউইয়র্ক

নিউইয়র্কে ভাসানী ফাউন্ডেশনের একটা আলোচনা সভায় এসেছি। আলোচনা অনেকক্ষণ চলেছে। মাঝে মাগরিবের নামাজের বিরতি হলো। এরপর প্রোগ্রাম শেষ হলো রাত ১০টার দিকে। অনেক মানুষের সাথে কথা হলো। অনেকেই সেলফিকাণ্ড নিয়ে জানতে চাচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাইডেনের সেলফি। ঋষি সুনাকের সাথে ছবি এগুলো নিয়ে খুব জানতে চাচ্ছে যে, আমার বক্তব্য কী। বিষয়টি খুব কনফিউজড অবস্থায় গেছে। একটা সেলফি মানে কি রাজনৈতিক সব সমস্যা সমাধান হয়ে গেলো? আমেরিকার চাপ কমে গেলো? এরকম নানা কথা হচ্ছে।

আমি সেখানে কিছু বলি নাই। পরে মনে হলো সেলফিকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন, নেতারা এতো হৈ চৈ করছে। বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, বাইডেনের সাথে সেলফি তোলা মানে অবাধ নির্বাচনে আমেরিকার যে চাপ ছিল সেই চাপ এখন আর নাই। আওয়ামী লীগ যেরকম চায় সেভাবেই নির্বাচন করা সম্ভব। এই ধরনের বার্তা দেবার চেষ্টা করছে।

শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং অতিরিক্ত অস্বাভাবিক সব আশাবাদ ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহ, এক মাস বা দুই মাস পরে কী হতে পারে? যদি সত্যি দেখা যায় যে, আমেরিকা ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে। সরকারের পদস্থ লোকরা, প্রশাসনের লোক বা আমলারা ভিসানীতির খপ্পরে পড়েছে বা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ সরকারেরতো আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলাওতো টাফ হয়ে যাবে।

আপনি খুব খুশি হলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে সেলফি তোলা হয়েছে। খুশি হয়ে প্রকাশ করছেন যে, আমেরিকা ম্যাটারস। আবার নির্বাচনে যখন প্রকাশ্যে চাপ দেবে তখন কি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে বলা সম্ভব নয় যে- আমেরিকা কে? আমেরিকা কী? আমেরিকা কে বা কী, কতোটুকু গুরুত্ব রাখে এটাতো আপনি সেলফিকাণ্ডে নিজেই স্টাবলিশ করে দিলেন।

এই সমস্ত বিপদ আওয়ামী লীগের নেতারা ভাবে বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় তারা ডমিস্টিক অডিয়েন্সের জন্য করে। লোকাল লোকদের কোনো একটা কিছু বুঝিয়ে দিলাম হাইপ তৈরি করলাম ব্যস সলভ হয়ে গেলো। শর্টটার্ম সল্যুশন; লং টার্ম সল্যুশনের দিকে তাদের কোনো নজর নাই। সেলফিকাণ্ড সরকারের জন্য কিন্তু বদহজম হয়ে যেতে পারে। জানি না এই উপমাটা টানা ঠিক হচ্ছে কিনা, একবার করোনার সময় ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়া বাটপার শাহেদ তারতো প্রচুর সেলফি ছিল। আর্মি চিফ, পুলিশের চিফ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে সেলফি ছিল। আমার ঠিক মনে নাই হয়ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সেলফি ছিল। সেলফি না হলেও ছবি হয়ত ছিল। এগুলো সেলফি কি তাকে রক্ষা করতে পেরেছিল? কিছুদিন পর দেখি তার হাত-পা বাঁধা, কোমড়ে পিস্তল গুজে দেয়া, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া, অত্যন্ত অপমানিত, পরাজিত মানুষের ছবি। যে ছবি দেখে করুণা লাগছিল সবার।

এটাতো সিম্বলিক বিষয়। আপনি একটা ভুয়া জিনিস প্রচার করলেন, অতিরঞ্জিত জিনিস প্রচার করলেন শাহেদ যেটা করেছিল। এখন আপনি দেখানোর চেষ্টা করলেন বিশ্বব্যপী আমার কতো ক্ষমতা, প্রতাপ। আমার কাজে কতোটা মুগ্ধ। আমার ওপর আস্থা রাখছে নির্বাচনের ব্যাপারে। পরে যদি এটা দেখা যায় যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ অব্যাহত আছে। সেটা খুব ভালো হবে না। আপনিতো ডমিস্টিক অডিয়েন্সকে বোঝাতে পারবেন না। শাহেদের পক্ষেতো গ্রেপ্তার হবার পর বলা সম্ভব হয়নি যে, সরকার ষড়যন্ত্র করেছে। সরকারের সাথে তার কতো দহরম মহরম এটাই ছিল তার প্রতাপ দেখানোর উৎস। তারপর যখন সেই সরকার গ্রেপ্তার করেছে তখনতো আর তার কিছু বলার ছিল না।

যদিও এটা খুব এপ্রোপ্রিয়েট উপমা না। তবে এরকম একটা পরিণতিতো সরকারেরও হতে পারে। আপনি যেটা দেখাচ্ছেন আপনার বিজয়, আপনার সমর্থন সেটাতো না। যার কারণে আপনি এটা দেখাচ্ছেন সেতো আপনাকে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। তখন খুব বিব্রতকর অবস্থা হতে পারে সরকারের জন্য। আমার মনে হয় না সরকার এটা ভেবেছে। সেলফিকাণ্ড করে মানুষকে একটা কৃত্রিম আশাবাদ তৈরি করার চেয়ে সরকারের উচিত খুব সিরিয়াসলি ভাবা যে এই নির্বাচন কেন্দ্রীক ডিসপিউটটা কীভাবে সমাধান করা যাবে। এখন একটা পজিশনে বসে থেকে সাময়িক শক্তি দেখালাম বা নির্বাচন করেই ফেললাম এটাতো এন্ড অব দ্য ডে বা এন্ড অব দ্য গেম নাও হতে পারে।

আমার মনে হয় না সরকার এতো ভাবছে। সেলফিকাণ্ড নিয়ে এতো উৎসাহের কোনই কারণ নাই। পৃথিবীতে কোনো সম্মেলনে বা কোনো ইউনিভার্সিটিতে যদি যাই যেকোনো বড় মানুষ সেখানে থাকলে ছবি তোলা যায়। ছবি ইন্ডিকেট করে না আপনার প্রতি সমর্থন বা অসমর্থনকে। যদি সরকার মনে করে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটিকে পাশে চায় তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে বাস্তব কিছু লক্ষ্য, বাস্তব কিছু প্রস্তাব দিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, নতুন কোন সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকার যার নেতৃত্বে গ্রাউন্ড ব্রেকিং কিছু করতে হবে যে আমি সত্যি সিন্সিয়ার।

২০১৮ বা ’১৪ সালের মতো নির্বাচন করতে আগ্রহী না। সেটা যদি সরকার না দেখাতে পারে আমি বিশ্বাস করি না যে ইউরোপ বা আমেরিকার চাপ সরকারের উপর থেকে কমবে। এই সেলফি হয়ত কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে দিতে পারে, কিন্তু যখন ওই ধোঁয়াশাটা কেটে যাবে তখন দেখা যাবে সরকারের উপর সেই চাপ অব্যাহত আছে। কাজেই সেলফি নিয়ে এতো মাতামাতির কিছু নাই। এতো হতাশ হওয়ার কিছু নাই, আনন্দিত হওয়ার কিছু নাই। আসল সংকট, আসল সংকটের জায়গাতেই রয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *