এ টি এম তুরাব সিলেট থেকে
সিলেটে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নিয়ে নাগরিকদের ভোগান্তির শেষ নেই। নাম, বয়স, জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ সংশোধনে এবং তালিকায় লাগামহীন দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ। দিনের পর দিনে নির্বাচন অফিসের কর্তা ব্যক্তিদের দরবারে ঘুরে সেবা না পেয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেকেই। এসব সংশোধন করতে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঘুস ছাড়া কাজ হয় না। এজন্য ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ এনআইডি সেবা পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছেন।
তাদেরই একজন নগরীর সুবিদবাজারের বাসিন্দা সুমনা ইসলাম। তার পাসপোর্ট করতে প্রয়োজন পড়ে এনআইডি কার্ডের। তাই যথাযথ নিয়ম মেনে অনলাইনে আবেদন করেন। এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কপি নিয়ে যান সিলেট সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসে। সেখানে গিয়ে ফাইল জমা দেন। তখন দায়িত্বরত ব্যক্তি তাকে বলেন ফিঙ্গার ও ছবি তোলার তারিখ ও সময় এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হবে।
এভাবে কয়েকদিন চলে যায়। মোবাইলে আসেনি এসএমএস। পরে আবার অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় তাকে অফিস থেকে জানানো হয়- নির্বাচন চলছে। এখন নতুন কারো আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে না, শুধু প্রবাসীদের ফিঙ্গার ও ছবি তোলা হচ্ছে।
কোনভাবেই সংশ্লিষ্টদের রাজি করতে পারলেন না সুমনা ইসলাম। এরপর বাধ্য হয়ে দ্বারস্থ হন উপশহর রোজ ভিউ কমপ্লেক্সেরে একটি ট্রেভেলসে। ওই ট্রেভেলসের একজনের সাথে এনআইডি’র বিষয়ে কথাবার্তা হয়। তখন তিনি ফোনে সুহিন নামের এক দালালের সাথে কথা বলেন। দালাল সুহিন চার-পাঁচ দিনের মধ্যে এনআইডি করিয়ে দিতে পারবেন বলে জানান, বিনিময়ে তাকে দিতে হবে ২০ হাজার টাকা। তখন ভুক্তভোগী দরকষাকষি করলেও ওই দালাল ছাফ জানিয়ে দেন এক টাকাও কম হবে। পরে বাধ্য হয়ে তিনি দাবিকৃত টাকা দিতে রাজি হয়ে যান। শুধু রাজি না- পুরো টাকা কাজ হওয়ার আগেই দিতে হবে। কথামতো টাকা দেন সুমনা।
পরদিন দালাল সুহিন ভুক্তভোগি সুমনাকে জানান- ২২ নভেম্বর সদর উপজেলায় গিয়ে তাকে ফিঙ্গার ও ছবি তুলেতে হবে। কথা মতো ওই তারিখে সেখানে গিয়ে ফাইল রিসিভ কালে দায়িত্বরত ব্যক্তি, ফাইলে সিরিয়াল নাম্বার না দিয়ে ফাইল আটকিয়ে দিলে সুহিনকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। তখন সুহিন মোবাইল ফোনে দায়িত্বরত ওই ব্যক্তির সাথে কথা বলেন তিনি ফাইলের পিছনে একটি বিশেষ ‘অলক’ দা লেখন এবং ৭৪ নাম্বার সিরিয়াল দেন। পরে দ্বিতীয় তলায় গিয়ে আবারও আরো এক কর্মকর্তা ফাইল আটকে দিলেও পরে ফাইলের ‘বিশেষ’ নামটি দেখেন। পরে সুমনাকে ভেতরের রুমে পাঠানো হয় এবং তার ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়।
জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য সংশোধনসহ অসৎ উদ্দেশ্যে বয়স কমানো-বাড়ানোর ‘সার্ভিস সেন্টার’ খুলে বসেছেন দোকানিরা। আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস-সহ নগরের বিভিন্ন এলাকায় এ রকম কিছু ছোট ছোট দোকান রয়েছে। এনআইডি কার্ডের ভুল সংশোধন করতে সেখানে প্রতিদিনই ভিড় করেন ভুক্তভোগীরা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চক্রটি এনআইডির যে কোনো ধরনের ভুলত্রুটি সমাধান করে। তারা এ কাজে সময় নেয় কম, টাকা নেয় বেশি। জানা যায়, চক্রটি অবৈধভাবে এনআইডি কার্ডে জন্ম সাল বাড়ানো-কমানোসহ অন্যান্য ভুল সংশোধনের কাজ করে আসছিল। এছাড়া অসৎ উদ্দেশ্যে কিছু আবেদনকারী তাদের প্রকৃত বয়স কমিয়ে অবৈধভাবে জন্মনিবন্ধন সনদ এবং এনআইডি কার্ড করিয়ে নিতেন।
এ ব্যাপারে সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল হালিম খান জানান, গণশুনানির দিন যার যা প্রমাণাদি আছে, তাই নিয়েই আসতে বলা হয়। এতে যদি অর্ধেক কাগজপত্র ঠিক থাকে এবং আমাদের বিষয়টি প্রকৃত মনে হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন আমলে নিয়ে সংশোধন করে দেই। আর যদি সঠিক বলে বিবেচিত না হয় এবং তথ্য-প্রমাণে ঘাটতিও থাকে, তবে সেটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দেই।
তিনি আরো জানান- সিলেটে অনেক মানুষের আবেদন ঝুলে আছে। সাধারণ সেবাগ্রহীতারা দিনের পর দিন মাঠ কার্যালয়গুলোতে ঘুরে কোনো সুরাহা করতে পারছেন না। ফলে গণশুনানি সিলেটের মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশই কমিয়ে দিচ্ছে।
এই কর্মকর্তা আরো বলেন, নতুন ভোটার যারা অনলাইনে আবেদন করেছেন তারা যদি প্রিন্ট কপির সঙ্গে অন্যান্য প্রমাণপত্র নিয়ে আসেন- সে ক্ষেত্রে তাকেও ভোটার করে নিয়ে এনআইডির অনলাইন কপি দিয়ে দেওয়া হয়।