সিরিয়ার নতুন নেতা আহমেদ আল-শারা বলেছেন, দীর্ঘ যুদ্ধে সিরিয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ঠিক-ই। কিন্তু প্রতিবেশী বা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য দেশটি হুমকিস্বরূপ নয়। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।
“এতকিছুর পর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত। কারণ এগুলো পুরনো শাসনের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিলো। অত্যাচারিত ও অত্যাচারীকে একই দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়,” তিনি বলেন।
দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের আগে বাশার আল-আসাদের সুদীর্ঘ শাসনামলের পতন ঘটানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন আহমেদ আল-শারা। তিনি সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নেতা। আগে তিনি ‘আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি’ নামে পরিচিত ছিলেন।
তিনি এইচটিএসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত না করার আহ্বান জানান। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ একে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।
কারণ আল-কায়েদার একটি শাখা হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো, তবে ২০১৬ সালে এটি আলাদা হয়ে যায়।
আহমেদ আল-শারা দাবি করেন, এইচটিএস কোনও সন্ত্রাসী সংগঠন নয়।
তিনি বলেন, তারা কখনোই বেসামরিক মানুষ বা এলাকাকে লক্ষ্যবস্তু করেননি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি তাদেরকে আসাদ শাসনের অপরাধের শিকার বলে মনে করেন।
সিরিয়াকে আফগানিস্তানের মতো বানাতে চান, এমন কথাও তিনি অস্বীকার করেন।
আহমেদ আল-শারা বলেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তান, এই দুই দেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
আফগানিস্তানের সমাজব্যবস্থা হলো গোত্রভিত্তিক। আর সিরিয়ায় মানুষের মানসিকতা ভিন্ন।
তিনি এও জানান যে নারী শিক্ষার মতো বিষয়ে তারা বিশ্বাস করেন।
“ইদলিবে প্রায় আট বছর ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ” তিনি বলেন।
ইদলিব শহরের অবস্থান দেশটির উত্তর-পশ্চিম দিকে, ২০১১ সাল থেকে যার শাসন ভার বিদ্রোহীদের হাতে রয়েছে।
“আমার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ৬০ শতাংশের বেশি।”
তার কাছে এও জানতে চাওয়া হয়েছিলো যে মদ্যপানের অনুমোদন দেওয়া হবে কি না। কিন্তু এর উত্তরে তিনি বলেন, “এরকম অনেক বিষয়ে আমার কথা বলার অধিকার নেই। কারণ এগুলো আইনগত বিষয়।”
“আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি আইন প্রণয়ন ও সংবিধান রচনার দায়িত্বে থাকবে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। যে কোনও শাসক বা প্রেসিডেন্ট সেই আইন মেনে চলবে,” যোগ করেন তিনি।
বিবিসি’র সাথে দেওয়া সাক্ষাৎকারের পুরোটা সময় আহমেদ আল-শারা স্বাভাবিক ও শান্ত ছিলেন। পোশাক-আশাকেও তিনি খুব সাধারণ ছিলেন। যারা এখনও বিশ্বাস করেন যে এই গোষ্ঠীটি এখনও তাদের অতীতের চরমপন্থী কাজকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি, তাদেরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
যদিও সিরিয়ার অনেক মানুষই এই কথা বিশ্বাস করেন না এখনও।
এখন আগামী কয়েক মাসের মাঝেই বোঝা যাবে যে সিরিয়ার নতুন শাসকরা কেমন দেশ গড়তে চান এবং ভবিষ্যতে তারা কীভাবে দেশ শাসন করবেন।
হায়াত তাহরির আল-শাম কারা
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার সময় এ গোষ্ঠীটির নাম ছিল জাবাত আল নুসরা, যা ছিল সরাসরি আল-কায়েদা জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত।
এর গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কথিত আইএস গ্রুপের নেতা আবু বকর আল বাগদাদী।
এই গোষ্ঠীটিই প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও প্রাণঘাতী ছিল বলে অনেকে মনে করেন। তবে, এটি বিপ্লবের চেয়ে জিহাদি আদর্শকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে করা হয়।
ফ্রি সিরিয়া নামে বিদ্রোহীদের যে জোট হয়েছিলো সেখানে তাদের মধ্যে ভিন্নতা দেখা দিয়েছিলো।
২০১৬ সালে এই গোষ্ঠীর নেতা আবু মোহাম্মেদ আল জোলানি প্রকাশ্যেই আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছেদ করেন এবং জাবাত আল নুসরাকে বিলুপ্ত করে নতুন সংগঠন তৈরি করেন। এর নামই রাখা হয় হায়াত তাহরির আল-শাম এবং পরে এর সাথে আরও কিছু ছোট গোষ্ঠী যোগ হয়।
কিছু সময়ের জন্য এইচটিএস সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশকে ক্ষমতার কেন্দ্র বানিয়েছিল। তারা সেখানে স্থানীয় প্রশাসন চালু করেছিলো। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এসেছিলো, যা তাদের বৈধতা পাওয়ার চেষ্টাকে ম্লান করে দিয়েছে।
এছাড়া অন্য আরও কিছু গোষ্ঠীর সাথে তিক্ত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিলো তারা।
ইদলিবের বাইরে তাদের উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে তখনো পরিষ্কার কিছু জানা যায়নি।
এমনকি আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক নষ্টের পর তারা খিলাফতের চেয়ে সিরিয়ায় ইসলামি শাসনের চেষ্টা করেছে।
অন্য যেকোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তুলনায় আসাদকে চ্যালেঞ্জ করা কিংবা সিরিয়ায় বড় ধরনের কোনো সংঘাতের লক্ষণ তাদের দিক থেকে কমই প্রকাশ পেয়েছিল।
বিদ্রোহীদের আক্রমণ যেভাবে হলো
গত চার বছরে মনে হচ্ছিলো সিরিয়া যুদ্ধ শেষ হতে যাচ্ছে। দেশটির বড় শহরগুলোতে বাশার আল-আসাদের শাসন ছিল। তবে কিছু অংশ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
এর মধ্যে ছিল পূর্ব দিকে কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো। এগুলো সংঘাতের শুরু থেকেই সিরিয়া রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
বিশাল সিরীয় মরুভূমি এলাকায় থাকা দলগুলো নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করছিলো। আর উত্তর পশ্চিমের ইদলিব প্রদেশ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণেই ছিল।
এইচটিএস ছিল ইদলিবের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। তারাই এবার আলেপ্পোতে হামলা করে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
কয়েক বছর ধরে ইদলিব ছিল যুদ্ধক্ষেত্র, কারণ সরকারি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিলো।
২০২০ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে আসাদ সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। আর তুরস্ক বিদ্রোহীদের সমর্থন যুগিয়েছে।
প্রায় চল্লিশ লাখ লোক সেখানে বাস করতো, যার বেশিরভাগই বিভিন্ন শহর থেকে বাস্তুহারা হয়েছে। আসাদ বাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে।
আলেপ্পো ছিল আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানেই বিদ্রোহীদের বড় পরাজয় হয়েছিলো।
নিজের জয় নিশ্চিত করতে বাশার আল-আসাদ শুধু তার দুর্বল সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করেননি। বরং তিনি আস্থা রেখেছিলেন রাশিয়ার বিমানশক্তি আর ইরানের সামরিক সহায়তার ওপর। এর মধ্যে হেজবুল্লাহও ছিল।
লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণে হেজবুল্লাহর পরিণতি এবং সিরিয়ায় ইরানের সামরিক কমান্ডারদের ওপর ইসরায়েলি হামলাও বিদ্রোহীদের আলেপ্পোর দিকে হঠাৎ যাত্রা শুরু করতে উৎসাহ যুগিয়ে থাকতে পারে।
গত কয়েক মাসে ইসরায়েল ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করেছে। এর ফলে সিরিয়ায় থাকা হেজবুল্লাহ নেটওয়ার্কের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
এরা না থাকলে আসাদের বাহিনী হয়তো আরও আগেই পরাজিত হতো। -বিবিসি