সিনেমার অগ্রিম টিকেট ও ব্ল্যাকার | কামরুল হাসান দর্পণ

মতামত সময় টিভি
শেয়ার করুন

একটা সময় সিনেমা দেখার জন্য দর্শক ‘অগ্রিম টিকেট’ কিনতেন। অগ্রিম না পেলে বেশি দামে ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে কিনতেন। হলের সামনে ব্ল্যাকার শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। এটা তাদের জীবিকাও হয়ে উঠেছিল। বেশ ভালো আয়-রোজগার হতো। কাউন্টার থেকে টিকেট না পেয়ে তীর্থের কাকের মতো অনেককে ব্ল্যাকারদের পিছে পিছে ঘুরতে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তখন মনে হতো, আহারে ব্ল্যাকারদের মধ্যে যদি আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকত! মামা-চাচা থাকত!

সৌভাগ্য বশত একদিন জানতে পারি, আমার এক ক্লাসমেটের বাবা বলাকা সিনেমা হলের ব্ল্যাকার। আর আমাকে পায় কে! দোস্তর সাথে আরও ঘনিষ্টতা বাড়িয়ে দিলাম। পরের সপ্তাহেই বললাম, যা চাচার কাছ থেকে টিকেট নিয়ে আয়। টিকেটের কথা বলতেই ওর বাবা ধমক দিয়েছিলেন। মুহূর্তে চুপসে গেলাম। এখন বুঝি, কেন ধমক দিয়েছিলেন। আরও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বলাকায় তার বাবার জন্য সিনেমা দেখতে পারতাম না। দেখলেই ধমকিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার কথা বলত। যাই হোক, ব্ল্যাকাররা আগে থেকেই অর্ধেকের বেশি টিকেট কিনে ফেলত। তাদের সাথে কাউন্টারের লোকজনের যোগাযোগ থাকত। তারাও লাভবান হতো। অর্থাৎ এক সিনেমার মাধ্যমে বহুমুখী ব্যবসা ও বহু লোকের উপার্জনের ব্যবস্থা হতো।

তখন সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা খুব কম ছিল। দুই মাস, তিন মাস পর একটি নতুন সিনেমা আসত। এর মধ্যে একটানা পুরনো সিনেমাই চলত। ফলে এক সিনেমা অনেকবার দেখা হতো। তাতেও ভালো লাগত। সিনেমাগুলোও এমনভাবে নির্মিত হতো যে, বারবার দেখেও স্বাদ মিটত না।

সাধারণত অগ্রিম টিকেট কাটা হতো বাড়ির লোকজনসহ সিনেমা দেখার সময়। কিংবা দুলাভাই বা অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজনের আগমন উপলক্ষে। কয়েক ‘শো’ আগে বা একদিন আগে কিংবা দুই দিন আগে অগ্রিম টিকেট কেনা হতো।কখনো কখনো এক সপ্তাহ আগে। আর যখন শোনা যেত, নতুন কোনো সিনেমা আসছে তখন তো অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতো না। টিকেটের জন্য দুঃশ্চিন্তাও হতো। সময়টা এমন ছিল যে, সিনেমা খারাপ হবে বা ভাল লাগবে না, এমন ধারণাই মাথায় আসত না। সিনেমা ভাল হবে, দেখার মতো হবে, এটাই মাথায় থাকত। তাছাড়া কতদিন পর নতুন করে প্রিয় নায়ক-নায়িকার সাথে দেখা হবে! এটাও একটা অন্যতম আকর্ষণ হয়ে থাকত।

যাই হোক, আগে থেকেই চিন্তা করে রাখতাম সিনেমাটি দেখতে হবে। স্কুল ছাত্রদের কাছে তো অর্থকড়ি থাকে না। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে জোগাড় করতে হতো। বাবা-মা কিংবা বড় বোনের তহবিলে হাত-টাত দিতে হতো। কতদিন এমন হয়েছে, নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, গিয়ে দেখি হাউসফুল। টিকেট নাই। ব্ল্যাকারদের দুর্দান্ত দাপট। টিকেটের যে দাম তা অরিজিনাল দামের তিন-চার গুণ বেশি। আমার কাছে শুধু টিকেটের অরিজানাল দাম। এ দিয়ে তো আর হয় না। চিন্তা করতাম এ শো না দেখতে পারলেও পরের শো’র টিকেট নিশ্চয়ই পাব। পরের শো দেখার জন্য তিন ঘন্টা বসে থাকতাম। টেনশনও হতো। স্কুলের টাইম যে শেষ হয়ে আসছে! সিনেমা দেখে বাসায় গিয়ে দেরি হওয়ার কি কারণ বলব, তার নানা ফন্দি-ফিকির করতে হতো। পরের শো ঘনিয়ে আসার আগেই কাউন্টার খুলত, লাইনও লম্বা হতো। তবে লাইন অর্ধেক শেষ না হতেই কাউন্টার বন্ধ হয়ে যেত। টিকেট শেষ। হাউসফুলের সাইনবোর্ড ঝুলে যেত। বুকটাও হাহাকার করে উঠত। ব্ল্যাকারদের হই হই রব উঠত। হতাশ হয়ে ভাবতাম আজ আর হবে না, আগামীকাল আবার আসব। আগামীকাল আর আসে না। প্রতিদিনই হাউসফুল। ব্ল্যাকে টিকেট কেনা সম্ভব নয় বলে অপেক্ষায় থাকতাম কবে স্বাভাবিক দামে পাব।দুই-তিন সপ্তাহ পর হয়তো দেখা যেত লাইন ধরে টিকেট পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে টিকেটের এই বিড়ম্বনা কাটাতে আগে থেকেই ‘অগ্রিম টিকেট’ কিনতেন। বিশেষ করে পরিবার নিয়ে দেখার জন্য। এখন অগ্রিম টিকেটের সেই চল নেই। কেউ অগ্রিম টিকেট কিনে রাখতে পারেন। দেখা যাবে সিনেমা দেখতে গিয়ে তিনি একাই হলে বসে আছেন। হল কর্তৃপক্ষ তখন হয়তো অনুরোধ করবে, ভাই, আপনার একার জন্য সিনেমা চালাতে গেলে আপনার টিকেটের দামের কয়েক হাজার গুণ বেশি বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খরচপাতি হয়ে যাবে। দয়া করে এত বড় লোকাসানে ফেলবেন না। এই নেন আপনার টিকেটের দাম।

তবে অগ্রিম টিকেটের চল যে এখন নেই তা-ও নয়। আছে, এই যে ঈদ আসছে, ট্রেনের ও বাসের অগ্রিম টিকেটের জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সেহরী খেয়েই কমলাপুর রেলস্টেশনে দিকে ছুটবে। তারপরও অনেকে টিকেট পাবে না।

অন্যদিকে এবারের ঈদেও দুই-তিনটি নতুন সিনেমা মুক্তি পাবে বলে শোনা যাচ্ছে। সেদিকে কারো খেয়াল আছে কিনা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। অগ্রিম টিকেট কিনবে কিনা, তাও জানি না। অথচ দক্ষিণের নায়ক ইয়াশের কেজিএফ: চ্যাপ্টার টু সিনেমাটি কদিন পরই মুক্তি পাবে। এখনই নাকি অগ্রিম টিকেট বাবদ ১০ কোটি রুপি আয় করে ফেলেছে। মুক্তির পর কি হবে, তা কে জানে! এর কারণ কি? উত্তর খুব সহজ।

এক সময় আমাদের দেশের দর্শকের যেমন বদ্ধমূল ধারণা ছিল, নতুন যে সিনেমাই আসুক না কেন তা ভাল হবেই, তেমনি ভারতের দর্শকরাও জানে তাদের নতুন সিনেমাও ভালো হবেই। বিশেষ করে ট্রেডমার্ক নির্মাতা ও হিরোদের সিনেমা ভালো হবে, তা আগে থেকেই তারা নিশ্চিত থাকে। অগ্রিম টিকেটের কথা বাদ দেয়া যাক, এখন সিনেমা মুক্তির প্রথম দিনটির প্রথম শোটি হাউসফুল হলেই নির্মাতারা ধন্য হয়ে যায়। আবার এ শোটি হাউসফুল হবে কিনা, এ নিয়েও তাদের টেনশনের অন্ত থাকে না।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

লেখক: কামরুল হাসান দর্পণ
সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক
সদস্য সচিব, এডহক কমিটি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *