সাহিত্যিক সালেহা চৌধুরী আপন আলোয় উদ্ভাসিত

প্রবন্ধ-কলাম
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

অবিরাম লিখে চলেছেন সজীব প্রাণের দ্যোতনায় অমলিন লেখক সালেহা চৌধুরী। ব্রিটেনে আছেন প্রায় একান্ন বছর হোল। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। লন্ডনেও শিক্ষকতা করেছেন। তবে লেখালেখিই তার ধ্যান জ্ঞান।

মেধা ও প্রজ্ঞায় আলোকিত সালেহা চৌধুরীর রচনায় গভীরতা ও বিস্তার বহুমাত্রিক। জীবনজুড়ে গল্পের প্রবল প্রতিধ্বনি। সবুজ স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের কোলে তার কলম হয়ে ওঠে বর্ণময়। লেখায় ও ভাবনায় তিনি সুন্দরের প্রতিমূর্তি। শব্দের ব্যবহারে শৈল্পিক ও মাধূর্যময়‌।

একশোর উপরে গ্রন্থ রচনা করেছেন এই মহীয়সী। ১৯৬৭ সালে বেরিয়েছে তার প্রথম বই ‘যখন নিঃসঙ্গ’। একটা দুর্দান্ত গল্পগ্রন্থ। ভালোবাসার রকমফের নিয়ে এক অসাধারণ কাহিনী। প্রথম গ্রন্থেই ক্লিক করেছেন পাঠক হৃদয়ে। এতে ছিল মোট ১৩টি গল্প: ১. যখন নিঃসঙ্গ ২. বর্ষণ ৩. দুপুর পর্যন্ত ৪. দেয়ালের লেখা ৫. কান্না ৬. বয়স ৭. প্রতিবিম্ব ৮. কুয়াশার চাঁদ ৯. সুমনার পৃথিবী ১০. শেষের পরে ১১. সঙ্গিনী ১২. হৃদয় অরণ্য ১৩. সায়াহ্নে। গল্পগুলো মানবিক চেতনা জাগ্রত করে। সৃষ্টি হয় পাঠক মনে আলোড়ন।

সালেহা চৌধুরীর ‘যখন নিঃসঙ্গ’ বইটিতে ভূমিকা লিখেছিলেন তারই শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী। নাট্যকার সাহিত্য সমালোচক ভাষাবিজ্ঞানী বাগ্মী বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী দীর্ঘ মুসাবিদায় উল্লেখ করেন, ‘যখন নিঃসঙ্গ’ সালেহা চৌধুরীর প্রথম প্রকাশিত ছোট গল্পের বই। তবে প্রথম হলেও রচনা আদৌ অপরিনত নয়। সবগুলো গল্পই মনকে স্পর্শ করে, মনের চারপাশে একটা গুঞ্জরণ ও তন্ময়তা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। সালেহা চৌধুরীর সহানুভূতি ও অন্তর্দৃষ্টি আমাদের মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের, বিশেষ করে সেই সমাজের সংবেদনশীল রমনী হৃদয়ের, অনেক আনন্দ ও বিষন্নতাকে অতি সজীব, নিটোল ও অন্তরঙ্গ করে তুলেছে। আমি সবাইকে এ গল্পগ্রন্থ পড়ে দেখবার আমন্ত্রণ জানাই।

সালেহা চৌধুরী প্রবাসে পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন ‘লন্ডন রূপকথা নয়’গ্রন্থ লিখে। এরপর নতুন নতুন গ্রন্থ লিখে আকর্ষণ ও আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছেন। অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে আজো লিখে চলেছেন অবিশ্রান্ত।

‘লন্ডন রূপকথা নয়’গ্রন্থ প্রসঙ্গে বিলেতে জনপ্রিয় লেখক ও গবেষক ড. রেণু লুৎফা লিখেছেন, সালেহা চৌধুরীর সাথে দেখা করে ফিরতি পথে ট্রেনে বসেই বইখানি পড়তে শুরু করলাম। আমার বিচার মতে যে কোন বই পড়তে শুরু করার ১ মিনিটের মধ্যেই বইটি কেমন হবে ধারনা করা যায়। মোট ৩৩৬ পৃষ্ঠার বইয়ের প্রথম বাক্যটিই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। ওমা, এটা তো সালেহা চৌধুরীর বই নয়। এটা আমার, আমাদের, বৃটেনের অভিবাসীদের জীবন কাহিনী। বইখানি উৎসর্গও করেছেন এই বলে ‘ব্রিটেনের অভিবাসী- পথ চলতে চলতে কেউ পৌঁছে যায় ঈস্পিত গন্তব্যে- কেউ পেয়ে যায় পায়ের তলার মাটি- সকলে নয়- আমি সকল অভিবাসীকেই এই মূহুর্তে স্মরণ করছি।

বইটি পড়তে গিয়ে কখনো মনে হয়নি এটি একটি উপন্যাস কিংবা কল্প কাহিনী। এর চরিত্রগুলো আমার চেনা, এঁরা আমার পাশের মানুষ। এদের সকলকেই আমি চিনি। এটা আমাদের জীবন কথা। রক্তমাংসে গড়া মানুষের জীবন কথা। পরবাসী সকল মানুষের কথা কোন না কোন ভাবে এতে উঠে এসেছে। কর্মজীবি শ্রমজীবি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের চিত্র রয়েছে এতে। আমাদের সুখ দু:খ হাসি কান্না ব্যর্থতা সফলতা চড়াই উৎরাইয়ের কি নিখুঁত বর্ণনা বইটির পাতায় পাতায়। পড়তে পড়তে মনে হলো এই বইটিই সালেহা চৌধুরীর শ্রেষ্ট সৃষ্টি।

সালেহা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালে। দেশ ছাড়ার আগেই ১৯৭০ সালে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত হয় লেখকের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘সাহিত্য প্রসঙ্গে’। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বিশ বছর পরে তার তৃতীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

গল্পগ্রন্থ: ১. যখন নিঃসঙ্গ – দিঠি দিশা প্রকাশনী ২. উষ্ণতর প্রপাতে – লেখা প্রকাশনী ৩. তাহিতি এবং অন্যান্য – লেখা প্রকাশনী। ৪. জন ও জোয়ীদের গল্প – লেখা প্রকাশনী (ভাই আবুল কালাম আজাদের প্রিন্টিং প্রেসে। এরপর বই করতে শুরু করেন বাংলা বাজারের বিভিন্ন প্রকাশক) ৫. কাবার্ড ও কাবার্ড জাতীয় গল্প – অল্পকথা ৬. আবু ইসহাক এবং প্রভাতের পাখি – মাওলা ব্রাদার্স ৭. আয়নায় সময় – মাওলা ব্রাদার্স ৮. অতিপ্রাকৃত গল্প – মাওলা ব্রাদার্স ৯. একুশটি প্রেমের গল্প – মাওলা ব্রাদার্স ১০. একটি জাপানি গল্প ও অন্যান্য – সিঁড়ি প্রকাশনী ১১. শতগল্প – বিদ্যাপ্রকাশ ১২. পঞ্চাশটি গল্প – আনন্দ পাবলিশার্স কোলকাতা ১৩. একুশটি প্রেমের গল্প- উত্তরণ ১৪. মুনশী আবদুল হাকিমের কোট ও অন্যান্য গল্প – ভাবনা প্রকাশ।

উপন্যাস: ১. বিন্নি ধানের খই – লেখা প্রকাশনী (বগুড়ার গ্রামের ভাষায় লেখা) ২. আনন্দ – দিব্য প্রকাশনী ৩. ময়ূরীর মুখ – বিদ্যাপ্রকাশ ৪. শেষ মারবেলা – বিদ্যাপ্রকাশ ৫. যেখানে তোমার হৃদয় – অনন্যা ৬. অনিকেত মানব – বিদ্যাপ্রকাশ ৭. রূপান্তির সুখদুঃখ – সময় প্রকাশন ৮. জারাখান এবং শ্রেষ্ট প্রেমিক – শিল্পতরু, তিনখন্ড একসঙ্গে – ইত্যাদি ৯. অমৃতাকে ঘিরে – গতিধারা ১০. বিপন্ন বৃষ্টিতে – ইত্যাদি । ১১. মুহূর্ত – পাঠশালা ১২. থাবিজুর বাবা – পারিজাত প্রকাশনী ১৩. চাঁদের আলোয় রাজকুমারী – সিঁড়ি প্রকাশনী ১৪. উপালির উপাখ্যান – ইত্যাদি প্রকাশনী (বগুড়ার গ্রামের ভাষায় কথোপকথন) ১৫. লন্ডন রূপকথা নয় – পরিবার পাবলিকেসন্স ১৬. প্রথম প্রেম ও পলাস ক্যাফেতে এক সন্ধ্যা – বিদ্যাপ্রকাশ ১৭. পুনশ্চ – সিঁড়ি ১৮. নিরাপদ নিরিবিলি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে লেখা উপন্যাস – বেহুলা বাংলা । ১৯. একজন জুশনারার গল্প – দিব্য (সিলেটি ডায়ালেক্টে লেখা) ২০. পিয়ালির দাদাজান – বেহুলা বাংলা ।

প্রবন্ধ-সাহিত্য সমালোচনা: ১. সাহিত্য প্রসঙ্গে – ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস ২. পশ্চিমের ছিটেফোঁটা – জোছনা প্রকাশনী ৩. রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা ভুমিকা – মুধর্ণ প্রকাশনী ৪. পরমা – জোছনা প্রকাশনী ৫. খলিল জ্রিব্রান জীবন ও বানী – দিব্য প্রকাশ ৬. পশ্চিমের মেঘ ও রৌদ্র – অনুপ্রানন।

কবিতা গ্রন্থ: ১. দেয়ালে ক্যাকটাস ফুল – শিল্পতরু ২. হৃদয় পেন্ডুলামে বাজে – শিল্পতরু ৩. হাইকু – শিল্পতরু ৪. জুডাস ও তৃতীয় পক্ষ – বিদ্যাপ্রকাশ ৫. দলছুট শব্দেরা – বেহুলা বাংলা।

ইংরাজি গ্রন্থ: ১. ইট গ্রোজ ইন মাই হার্ট – প্রপ্রিন্ট, ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত, ভূমিকা উহলিয়াম র‌্যডিচে ২. এ ব্রড ক্যানভাস – প্রপ্রিন্ট, ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত, ভূমিকা ডেনিস টুমি। (লন্ডনের স্কুলে পড়াতে পড়াতে কাকতালীয় ঘটনার মত দুটো কবিতার বই হয়ে যায়)। নিজের গল্পের ইংরাজি অনুবাদ: ৩. কালেকটেড শর্ট স্টোরিজ – আমাজন ৪. দ্য স্টোরি অব জুশনারা – আমাজন।

শিশুতোষ গ্রন্থ: ১. ছড়ায় বাংলাদেশ – জনমত প্রকাশনী, লন্ডন ২. আলোরথ সিন্ধু – পারিজাত ৩. মোফালাদি নামের লেসোথোর ছেলে – সিঁড়ি প্রকাশনী ৪. চার বন্ধুর কথা – মৌলি ৫. পাতাবাঁশি ও ওরা পাঁচজন – অন্যপ্রকাশ ৬. বিশ্বের সেরা গল্প – সিঁড়ি ৭. রবির বাঁশি এবং আরো তিনটি গল্প – সিড়ি ৮. আলোরথ এবং আরো পাঁচটি গল্প – সিড়ি ৯. মায়ের আদর – সিড়ি ১০. আমরা চলেছি বাঘ শিকারে – সিড়ি ১১. বিশ্বের বারোজন বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক এবং তাদের লেখা – উত্তরণ ১২. মা হাতি ও বাচ্চা হাতির গল্প – সিড়ি ১৩. তিনটি কিশোর গল্প – সিঁড়ি ১৪. সাদা সিংহ ও আমরা – সিঁড়ি।

অনুবাদ গ্রন্থ: ১. নির্দোষ এরিনডিরা এবং তার ভয়ংকরী দাদিমা – সন্দেশ ২. বিয়াট্রিক্স পটারের গল্প – জ্যোৎস্না প্রকাশ ৩. রোয়াল্ড ডালের গল্প – ঐতিহ্য ৪. মানুষ ও ইঁদুর – মাওলা ব্রাদার্স ৫. কেলি গ্যাং এর আসল ইতিহাস – সন্দেশ ৬. নোবেল বিজয়ীদের দুই ডজন গল্প – উত্তরণ ৭. রিপ ভ্যান উইংকল – জ্যোৎস্না প্রকাশ ৮. ফ্রিথা ও পাখিরা – মাওলা ৯. নেলসন ম্যান্ডেলার জীবন ও বানী – মাওলা ১০. নেলসন ম্যান্ডেলার বানী – সন্দেশ ১১. নোবেল বিজয়ী নারী – উত্তরণ ১৩. তোমাদের জন্য চিরকালের গল্প – সিঁড়ি ১৪. গোপন বাগান – বাংলা একাডেমি ১৫. অদৃশ্য মানব – সন্দেশ ১৬. ক্ষুদে মানবী – সন্দেশ ১৮. ড্যানি নামের ছেলেটা এবং তার মজার বাবা – সন্দেশ ১৯. আমার বাঁ পা – মাওলা ২০. বিশ্বের সেরা সাহিত্যিকের গল্প – মাওলা ২১. এ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড – ২২. অনিলস ঘোস্ট – সন্দেশ ২৩. হাইডি – বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ২৪. মবি ডিক – সংবেদ ২৫. তাবেদার রসুল বকুলের প্রেমের কবিতার ইংরাজি – …, ভূমিকা কবীর চৌধুরী। ২৬. লাস্ট ফর লাইফ – নালন্দা ২৭. মার্কেজ .. ছয়টি গল্প – ক্রিয়েটিভ – ঢাকা পাবলিকেশনস্ । * চার্লস ডিকেন্সের চারটি বইয়ের ছোটদের সংস্করণ অনুবাদ করছেন সালেহা চৌধুরী। সংবেদ ছাপাবে ২০২৪ সালে * সন্দেশ প্রকাশনীর লুৎফর রহমান চৌধুরীর মৃত্যুর পর ‘বার্ডস অব আমেরিকা’ এবং ‘অনিল্স গোস্ট’ নামে সালেহা চৌধুরীর দুটি মূল্যবান অনুবাদের পান্ডুলিপি হারিয়ে গেছে।

বিবিধ: ১. ঘর সংসারের টুকিটাকি – সন্দেশ ২. আমার মুক্তিযুদ্ধ – বিভাস।

সালেহা চৌধুরী এখন পর্যন্ত প্রায় তিনশো নানা ধরণের, নানা বিষয়ের ছোট গল্প লিখেছেন। বহুমাত্রিক বিষয় ও ভাবনায় সমৃদ্ধ তার গল্প। শত গল্প, পঞ্চাশটি গল্প, প্রেমের গল্প, অতিপ্রাকৃত গল্প, আয়নায় সময়, এমনি নানা ভাবে তার গল্পের বইগুলো সন্বোধিত। এর মধ্যে সতেরোটি গল্প অনুবাদ করে লন্ডন থেকে আমাজন.কমে একটি অসাধারণ ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। বলতে- কেবল তোমাদের গল্প অনুবাদ নয়, আমাদেরও দেবার কিছু আছে।

সালেহা চৌধুরীকে নিয়ে গুনীজনের মন্তব্য ও মূল্যায়ন থেকে বুঝা যায় কেমন নির্মল চিন্তার মানুষ তিনি। কেমন কোমল আবেগে, শিল্পীত ঢঙে, নির্লোভ ও নির্মোহ দৃষ্টিতে সমাজকে দেখেন তিনি। অনুধাবন করা যায় তার সাহিত্যের ঐশ্বর্য।

২০০৯ সালে একুশে বই মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ‘শব্দপাঠ সালেহা চৌধুরী সংখ্যা’। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন প্রধান সম্পাদক আতাউর রহমান মিলাদ, সম্পাদক আবু মকসুদ, প্রকাশক কাজল রশীদ।

২০১০ সালে প্রকাশিত হয় সালেহা চৌধুরীকে নিয়ে লেখা নানা গুনীজনের প্রবন্ধ সংকলন ‘গল্প কোথা থেকে আসে’। এতে লিখেছেন বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক কবি ও কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ নূরুল হুদা, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ কবি প্রাবন্ধিক অনুবাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, জাতীয় অধ্যাপক প্রথিতযশা লেখক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক প্রাবন্ধিক ও গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষ, সংগীতশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক ঝর্না রহমান, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক হোসেন উদ্দিন হোসেন এবং আরো অনেকে। সম্পাদনা করেছেন কবি সাংবাদিক বেলাল চৌধুরী।

‘গল্প কোথা থেকে আসে’ গ্রন্থে কবির চৌধুরীর বলেছেন, সালেহা চৌধুরী অনেকদিন ধরে লিখছেন। তিনি লন্ডনে প্রবাসী জীবনযাপন করলেও স্বদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন সর্বদা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। তার লেখার ভূবনে সাহিত্যের নানা শাখা সফল ভাবে ধরা দিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় ছোট গল্পই সালেহা চৌধুরীর আসল ভূবন। এখানে তিনি সর্বাধিক সৃজনশীল। বিবিধ পটভূমিতে জীবনের বিচিত্র রূপ, বেদনাবিধূর, আনন্দোচ্ছল, তার গল্পগুলি শৈল্পিক দক্ষতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে। তার ভাষা সাবলীর ও ঝরঝরে। অতি-নাটকিয়তা পরিহারে তিনি সচেতন। কিন্তু কখনো গল্পের অপ্রত্যাশিত থেমে যাওয়াতে পাঠককে উপহার দেন নির্ভেজাল বিস্ময়।

লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সালেহা চৌধুরীর শত গল্পের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছেন, গল্প বলার একটি নিজস্ব ভঙ্গি আছে সালেহা চৌধুরীর। গল্পের প্রয়োজন ও পটভূমি ভেবে ভাষাটাকেও দুমড়ে ফেলেন। তার ‘শত গল্প’ বাংলা দেশের প্রথম শত গল্প। শত গল্প প্রকাশ উপলক্ষে আমার এক কালের ছাত্রী ও সহকর্মী সালেহা চৌধুরীকে অভিনন্দন জানাই। সালেহা চৌধুরীর ‘শত গল্প’ বাংলাদেশের গল্প সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসাবে পরিগনিত হবে বলে আশা করি।

‘গল্প কোথা থেকে আসে’ সম্পাদনা করতে গিয়ে কবি বেলাল চৌধুরী লিখেছেন, সালেহা চৌধুরীর গল্পগুলো যে হিরকতূল্য বিবেচিত হবার দাবী রাখে তাতো নবীন প্রবীন সকলেই বলে গেছেন। সবিশেষে বলা যায় সালেহা চৌধুরীর কলমে এক জাদু কাজ করে যা একই সঙ্গে বহুমাত্রিক যেন অপার্থিব হৃদয়াবত্তা ও মননশীলতার মেলবন্ধন।

সালেহা চৌধুরী সম্পর্কে লেখক আহমাদ আজাদ উল্লেখ করেন, আমি তার কিছু উৎপ্রেক্ষার কথা বলতে চাই ‘সমির মিয়া যার পয়সা নেই চোখের ছানি কাটানোর। পরিজানের কুড়িয়ে আনা শাকপাতা আর লাল মোটা ভাত তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আর বাঁচিয়ে রেখেছিল চৈত্রমাসের পাতকুয়োর তলানির মত একটু ভালোবাসা।’

‘চৈত্রমাসের পাতকুয়ার তলানির মতো ভালোবাসা’ এই উপমা শোভিত ব্যাক্যাংশটুকুতে বার্দ্ধক্য-পীড়িত, অক্ষম, স্বামীর প্রতি জীবন সংগ্রামের যাঁতাকলে পিষ্ট স্ত্রীর ভালোবাসার স্বরূপকে অনিন্দ্য সুন্দর শৈল্পিক কুশলতায় বর্ননা করেছেন সালেহা চৌধুরী। হৃদয়ের গহিনে থিতু হয়ে থাকা সংগুপ্ত ভালোবাসাকে তুলনা করেছেন চৈত্রমাসের শুকিয়ে যাওয়া পাতকুয়োর তলানির নিস্তরঙ্গ শীতল পানিটুকুর সঙ্গে। সত্যি সুন্দর! সুন্দর।

চিত্রকলার নানা সৌন্দর্য ‘মাঠটা দিগন্তে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। কে বলতে পারে ওদের শব্দে ও স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে মাঠটা চেয়ে দেখছে কিনা।’ আর একটি অনবদ্য উপমা ‘ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে ডিমপোচ সূর্যটা উঠেই সারা শহরে আলো বিকিরণ করতে শুরু করেছে।’

সালেহা চৌধুরীর ‘শত গল্পে’ উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকলা, নামের সেইসব উপাদানগুলো যেন গহনার কারুকার্যের মত দ্যুতিময়, মনিমুক্তোর মত ঝিকমিক করে ওঠে। এমনি অসংখ্য বর্ণনা তুলে দেওয়া যায়।

সাহিত্য সমালোচক প্রত্যয় জসীম বলেন, মানুষ ও মানবিকতা সালেহা চৌধুরীর গল্পের প্রাণ। সব অসম্ভবকে সম্ভব করে মানব জীবনের শত ঘটনায় শত ধারায় এক প্রেমময় সৃষ্টি তিনি আমাদের সামনে হাজির করেন- শতগল্প শীর্ষক আশ্চর্য এক সাহিত্য সম্ভারে। আশ্চর্য বলি এই জন্যে যে, প্রায় হাজার পৃষ্টার এই গল্পগ্রন্থটি লেখকের দীর্ঘ জীবনের অবিরাম সাধনা ও সংগ্রামের অমূল্য স্মারক।

সালেহা চৌধুরীর ইংরেজি গল্পগুলোর কমেন্ট জানতে আমাজনের কমেন্টবক্সে যেতে হবে। অনেক গুনীজনের কমেন্ট সেখানে রয়েছে। ছোট গল্প নিয়ে আরো নানা মন্তব্য আছে।

এবারে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক সালেহা চৌধুরীর অনুবাদে। ‘শব্দপাঠ সালেহা চৌধুরী সংখ্যা’য় বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক কবি ও কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখেছেন, তার প্রবন্ধের নাম অনুদিত সৃষ্টি – বলাবাহুল্য তার অনুবাদ যেমন প্রাঞ্জল তেমনি অর্থবহ। তার অনুবাদ পড়তে পড়তে মনে হয় অনুশীলন ও মূল রচনার সঙ্গে গভীর পরিচয়ের পর তার অনুবাদও সহজ ও সুবোধ্য হওয়ার চেতনা জগিয়েছে। অনুবাদ যে কট্টরভাবে মূলকে অনুসরণ করে যান্ত্রিক রূপান্তর নয়, বরং অনুশীলনজাত নব সৃষ্টি, এই উপলদ্ধিতে তিনি উপনীত হয়েছেন। তারই প্রমান পাই নোবেল বিজয়ীদের দুই ডজন গল্পের ভেতরে, এর ভাষা ব্যবহারে। এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্প যেমন মূলানুগ, তেমনি সমকালীন বাংলা সাহিত্যে বিশ্বসাহিত্যের মূল্যবান উপহার হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। গার্বিয়েল গার্জিয়া মার্কেজের ‘আমি তো কেবল টেলিফোন করতে এসেছি’ নামক অনন্য সাধারণ দীর্ঘ বাঙলাভাষ্য আমি কেবল পৌনে এক ঘন্টায় বিরতিহীন ভাবে পাঠ করেছি। এমন একটি মনোস্তাত্বিক গল্পের বর্ণনায় সালেহা চৌধুরী যে মুনশিআনার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তিনি অবশ্যই সমকালীন শ্রেষ্ঠ বাঙালি অনুবাদকের গোত্রভুক্ত হবার দাবী রাখেন। রোয়াল্ড ডালের গল্প সম্পর্কে আমি একই কথা বলবো। ভাবতে অবাক লাগে এমন দক্ষ অনুবাদক এখনো জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত হননি। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি তিনি কেবল তার অনুবাদ কর্মের উৎকর্ষের কারণে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হতে পারেন।

এরপর মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখেছেন, তার অনুবাদ গ্রন্থগুলোতে চোখ বুলিয়ে মনে হয়েছে তিনি তার কথাকার সত্তার কারণে বিদেশি গল্পের বাংলা ভাষান্তরে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি নিজে সৃষ্টিশীল লেখক এই কারণে তার অনুবাদও সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছে। তাই তার অনুবাদকে রূপান্তর বা ভাষান্তর না বলে ‘অনুদিত সৃষ্টি’ বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত। তার হাতে ‘অনুদিত সৃষ্টি’ যত বাড়বে, বাংলা সাহিত্যে বিশ্বসাহিত্যের দিগন্ত ততই প্রসারিত হবে। বাঙালি পাঠক পাঠিকাদের পক্ষ থেকে তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন।

প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সালেহা চৌধুরীর অনুবাদ দক্ষতা বুঝানোর জন্য মূল ইংরাজির সাথে বাংলা ভাষার অনুবাদ তুলে ধরেছেন। কমাবিহীন একটি ইংরাজি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ যে এমন ঝরঝরে হয় সেটা তাঁকে বিস্মিত করেছে। তবে তিনি সবশেষে দুঃখ করে বলেছেন এই অনুবাদে পিটার কেলির প্রতি বিশ্বস্ত থাকার একান্ত প্রয়াস এর মর্ম উপলদ্ধি করেননি প্রকাশক। আর তাই কেলিকে কালি করা, এবং কমা বিহীন বইতে কমা বসানোর মত পরিবর্তন ঘটেছে লেখকের অজান্তে। তার অনুমোদনের অপেক্ষা না রেখে। পিটার কেলি কমা ব্যবহার করেননি। সালেহা চৌধুরীও সেটাই করেছিলেন। তবে একজন প্রুফরিডার মাঝে মাঝে কমা বসিয়ে তার সমস্ত চেষ্টাকে নস্যাৎ করেছেন। এই হলো আমাদের প্রকাশকের কর্মকান্ড।

প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক হোসেন উদ্দিন হোসেন সালেহা চৌধুরীকে নিয়ে একটি রচনায় তার ভালো লাগার কারণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছেন, ১. মূল গ্রন্থের কোন কিছু থেকে বঞ্চিত হই নি। ২. ভাষা সহজ। স্টেইনবেকের মত কখনো সহজ আবার কখনো তা মাটির কাছাকাছি মানুষের মত। ৩. অনুবাদ পড়তে গিয়ে কৃত্রিমতা ও জড়তায় হোঁচট খেতে হয়নি।

প্রাবন্ধিক ও গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষ আলোচনা করেছেন কবিতা নিয়ে। তার প্রবন্ধের নাম ‘ক্যাকটাস ফুলঘেরা হৃদয়ের কথা’। বলেন, সালেহা চৌধুরী দীর্ঘদিন কবিতা লিখছেন। ইতোমধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তার নিজস্ব মৃত্তিকা। ক্যাকটাস ও সান্ডিরক পৃথিবীতে বাস করেন তার হৃদয়ে সতত বাজে ভালোবাসার রাগিনী। বরাভয়ের গান। আশা ও আশ্বাসের পংক্তিমালা।

প্রত্যাশা নামের কবিতায় তিনি বলছেন, জুতোতে যে পেরেক মুখ উঁচিয়ে থাকে/ সহস্র মাইল হেঁটে/ আমার কঠিন চামড়ার স্পর্শে/ একদিন সে সদয় হবে।

এই হলো তার স্যাটায়ার। আসলে পেরেকের দোষ আর কি? দোষ তার পায়ের কঠিন চামড়ার। এমন করে স্যাটায়ার করতে তিনিই পারেন।

সালেহা চৌধুরীর উপন্যাস নিয়ে অনেক কথা আছে ‘গল্প কোথা থেকে আসে’ বইটিতে। ড.মুকিদ চৌধুরী, স্বাতী জসিম, নাজমা হোসনে আরা, সোফিয়া রহমান, ঝর্না রহমান প্রমুখের প্রবন্ধে। তার অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে বইটিতে। তবে শিশু সাহিত্য বা প্রবন্ধ তেমন নয়। তিনি অনেক শিশু সাহিত্য রচনা করেছেন। প্রবন্ধও কম নয়। কেবল ‘সমকাল’ নামের খবরের কাগজে কলাম লিখেছেন ৭৪টি। এ গুলো একসময় বই হবে অবশ্যই।

তাহমিদা সাঈদা ‘প্রিয় শিক্ষক ও সাহিত্যিক’ প্রবন্ধে ব্যক্তি সালোহা চৌধুরী এবং লেখক সত্তা নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি তার লেখার স্টাইল সরস। সরল। ও মনোমুগ্ধকর। গভীরতার খবর পাওয়া যায় এমন স্টাইলে। বিদেশে দীর্ঘকাল থাকার ফলে তার চমৎকার বাংলায় জিরাফোড়ন বা পাঁচফোড়নের মত ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন, এই চমৎকার গাছেদেরে দেশে, সর সর মর মর পাতাদের শব্দে, কেমন এক নিথর পরিবেশে ক্রিস বুঝতে পারে ‘ট্রাংকুইল’ নামের নিথর শব্দটিকে। এখানে ট্রাংকুইলের বাংলা খোঁজা কঠিন।

তাহমিদা সাঈদা আবার বলছেন, দেয়ালে ক্যাকটাস ফুলের একটি কবিতা ‘ডাস্টবিন ছুঁড়তে বাইরে বড় বিন খোঁজা/ এক মুহূর্ত দাঁড়ানো/ ব্লিজার্ডের হাওয়া।’

ময়ূরীর মুখ উপন্যাসে লেখিকা বলেন- আমার মা? এক শরীর স্বর্ন অলংকারে, পান খাওয়া মেচেতা পড়া মুখে, তাঁকে আভিজাতিক করে তোলা সাধ্যাতীত।

এমন আজস্র শব্দের ব্যবহার বার বার মনে করিয়ে দেয় সালেহা চৌধুরীর হাতের সেই আশ্চর্য যাদু কলমের কথা। সালেহা চৌধুরীর শত গল্প এবং উপন্যাসগুলো পড়বার সুযোগ আমার হয়েছে। এমনি বর্ণনা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্পে পরিপূর্ণ তার লেখা।

সালেহা চৌধুরী বিদেশ এসেছিলেন স্বামীকে সঙ্গ দিতে। ১৯৭২ সালে স্বামী তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে লন্ডন আসেন তিনি। ছয় বছরের ছেলে আর আট বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে। মি. চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এক বছর পড়াশুনা করবার জন্য একটি স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডন পাড়ি জমান।

কিভাবে থিতু হলেন বিলেতে? এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহা চৌধুরী জানালেন, তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী পড়াশুনা শেষে একটি চাকরির ‘অফার’ পান। তিনি তখন মহা চিন্তায়। চাকরি নেবেন না দেশে ফিরবেন? ঠিক হলো কিছুদিন চাকরি করবেন। এরপর পরিবার নিয়ে ইউরোপ মহাদেশ ভালো করে দেখে দেশে ফিরবেন। সেভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জানানো হোল।

এই প্রসঙ্গ ঠিকমত না লিখলে লন্ডনে থিতু হবার ঘটনা ঠিক বোঝা যাবে না। সালেহা চৌধুরী বললেন, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করে। যখন তারা ফিরে যাবেন ভাবছেন, ছেলেমেয়েরা তখন এদেশ, স্কুল, পার্ক, লাইব্রেরী, বন্ধুবান্ধব সব ভালোবাসতে শুরু করেছে। সালেহা চৌধুরী নিজেও টেমস নদীর পাড়ে এক অফিসে চমৎকার পরিবেশে কেরানি গিরির কাজ পেয়েছেন। তোফাজজল হোসেন চৌধুরীও তখন এদেশের ইঞ্জিনিয়ার। তাহলে কি আরো কিছুদিন থাকবেন? উভয়ে মিলে মনস্থির করলেন, থাকবেন আরো কিছুদিন।

এই প্রসঙ্গে ইতি টেনে সালেহা চৌধুরী বললেন, সে থাকা এখন একান্ন বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুজনের চাকরি পাঁচ বছর রেখে, তারপর ‘টারমিনেট’ করে। ওদের কে দোষ দেবে? এরপর ১৯৭৬ সালে বাড়ি কেনার মধ্যে দিয়ে এখানে থিতু হবার ভিত্তি প্রস্তর ফেলা হলো পাকাপাকি ভাবে। তারা এ দেশে এসেছিলেন ১৯৭২ সালে। এভাবেই পরিবারসহ ঢাকা ছেড়ে লন্ডনে রয়ে গেলেন।

জীবনের বাক বদলের গল্প বলতে গিয়ে স্মৃতি কাতর হলেন এই গল্পকার। জানালেন, ছেলেমেয়ে বড় করা, নিজের কাজ, ঘর সংসার এবং আরো নানা আনুষঙ্গিক কাজে লেখা গেল বন্ধ হয়ে। মানে গল্প কবিতা লেখা। বাড়িতে চিঠি লেখা এবং বাজারের ফর্দ লেখা ছাড়া তেমন কিছু লিখলেন না। বিশ বছর না লিখে কাটালেন। কেবল দুটো প্রবন্ধ লিখে ইত্তেফাকে পাঠিয়ে ছিলেন। একটি ক্যামুকে নিয়ে অন্যটি তেমন আর কেউ। বোধকরি ইলিয়ট।

লেখক সালেহা চৌধুরীর তর সইছে না। আবারো কাগজ কলম হাতে নিলেন। বললেন, বিশ বছর পর খালি বাড়িতে লেখার পরিবেশ হলো। লেখার জন্য একটা টেবিল কিনলেন। ছেলেমেয়েরা তখন বড়। ওদের নিয়ে তেমন ভাবনা নেই। ওরা নিজের পছন্দমত চলতে ভালোবাসে।

এবার লিখলেন নতুন আদলের গল্পগ্রন্থ ‘উষ্ণতর প্রপাতে’। এরপর আরেকটি গল্পের বই ‘তাহিতি এবং অন্যান্য।’ ছাপালেন তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ। যিনি পরপর পাঁচটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রিন্সিপাল ছিলেন। এখন একটি ছাপখানা কিনে বই ছাপাবেন বলে মনস্থির করেন। প্রথম দুটো বই ছাপানোর পর আর একটি ছাপালেন ‘জোয়ী এবং জনদের’গল্প। এরপর বললেন- আমি ছাপাতে পারি। কিন্তু বিক্রি করতে পারি না। এ ও নেয়। কেউ দাম দেয়। কেউ দেয় না। তুই এবার পাবলিশার দিয়ে বই ছাপা। তোর উপর আমি অবিচার করছি। এরপর জীবনে এলেন বাংলাবাজারের প্রকাশক মজিবর রহমান খোকা তার বিদ্যাপ্রকাশ নামের প্রকাশনা সংস্থা নিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে আরো প্রকাশক এলেন।

সালেহা চৌধুরী মন দিয়ে লেখেন। ইতোমধ্যে অফিসের চাকরি ছেড়ে স্কুলের চাকরি নেন, টিচার হিসাবে। সময় ১৯৮৫ সাল। সে কাজ করতে করতে ২০০৫ সালে অবসর নেন চাকরি থেকে। তখন লিখতেন সময় পেলে, এখন লিখছেন সময় কাটাতে। তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী দীর্ঘকাল অসুখে ভুগে ২০১২ সালে মারা যান। সালেহা চৌধুরী তার প্রথম গল্পগ্রন্থের মত ‘যখন নিঃসঙ্গ’ হয়ে লেখালেখিকে দোসর করেন। কারন অন্য এক মানুষকে দোসর করবেন তেমন তার ইচ্ছা ছিল না। স্রষ্টাতো তাকে লেখার ক্ষমতা দিয়েছেন। সকলে তো সেটা পায় না।

এই করতে করতে সালেহা চৌধুরী অনেক বই লিখে ফেলেন। গোনাগুনতিতে একশোরও বেশি। ব্রিটেনে প্রথম দুটো কবিতার বই লেখেন ইংরেজিতে। এরপর দুই হাজার সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেন। দুটো পুরস্কার পান। একটি ‘মেরিট এ্যাওয়ার্ড’এবং অন্যটি ‘রানার্স আপ’ পুরস্কার।

তিনি এরপর ইংরেজি সাহিত্য চর্চায় ইস্তফা দেন। কেবল মাঝে মাঝে ইংরেজি কবিতা দিয়ে বার্ষিক ডায়েরি তৈরী করেন। এখানে ‘প্রো প্রিন্ট’ ডায়েরি ছাপান। কবিতার ডায়েরি। তিনি তো বাংলাভাষাকে ভালোবাসেন। ইংরেজি লিখে বিখ্যাত হবার মত প্রতিভা আছে বলে তিনি মনে করেন না। কাকতালীয় ভাবে আরো দুটো বই আমাজন.কম থেকে ছাপা হয়। একটি গল্পের বই ‘কালেক্টেড শর্ট স্টোরি।’ অন্যটি ‘দি স্টোরি অফ জুশনারা’ উপন্যাস। এবারে ঠিক করেন আর নয়। আর ইংরেজি বই নয়। সেগুলো তার বাংলা গল্পের আর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। যে বই গুলো ইংরাজিতে হয়েছে তা হয়ত হতো না, তিনি দেশে থাকলে।

ওই যে খালি বাড়িতে টেবিল কিনে লিখতে শুরু করেন সে লেখা অব্যহত আছে। তিনি এখনো লেখেন। বাংলার সুন্দর অক্ষরে বই লিখতে লিখতে একশোটি করে ফেলেছেন। এর মধ্যে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তিরিশটির মত বই। একটি বাংলা থেকে ইংরেজি। আর নিজের কিছু গল্পের আর একটি ছোট উপন্যাসের অনুবাদ। সেগুলো সব ঢাকা থেকে ছাপা হয়েছে। বড়দের জন্য ছোটদের জন্য নানা ধরণে অনুবাদ বই আছে তার। আর মৌলিক বই গুনলে সত্তুরটির মত। কোন কোন বই নতুন নামেও ছাপা হয়েছে। বড়দের জন্য আর ছোটদের জন্য।

পুরস্কার : ১. বাংলা এ্যাকাডেমির প্রবাসী লেখক পুরস্কার- সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ পুরস্কার বর্তমান নাম ২. অনন্যা পুরস্কার ৩. আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার ৪. বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার ৫. লেখিকা সংঘ পুরস্কার ৬. অনুবাদের জন্য আজীবন সম্মাননা এবং আরো কিছু..। ইংরাজি কবিতার জন্য ওয়াশিংটন ডিসি থেকে মেরিট এ্যাওয়ার্ড আর রানার্সআপ পুরস্কার পেয়েছেন ২০০০ সালে।

সালেহা চৌধুরীর দাদার দেশ বগুড়া। প্রিয় জেলা ফরিদপুর, যেখানে বাবা কাজের জন্য পাঁচ বছর ছিলেন। বাবা সুজাত আলি চিরজীবন শিক্ষা বিভাগে কাজ করেন। তিনি কবিতা লিখতেন। মা খোদেজা খাতুন সন্তানদের প্রাণ ভরে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। চোখ নষ্ট হয়ে গেলে তিনি অন্যের পড়া গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। সালেহা চৌধুরী যদি আবার ফিরে পেতেন সেই ফেলে আসা জীবন, মা আর বাবাকে আরো অনেক যত্ন করতেন। বিদেশে বসে তাদের মৃত্যু সংবাদ তাকে বির্দীর্ন করেছে।

তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৪ সালের পাঁচই অক্টোবর। তিনি পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সালেহা চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে। তিনি পড়াশুনার জন্য লন্ডন আসেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা শেষ করে এখানেই ভালো চাকরি পেয়ে থিতু হন। তার কনট্রাক্ট ব্রিজ খুব প্রিয় খেলা ছিল। দাবাও ভালোবাসতেন।

সালেহা চৌধুরীর লেখালেখি প্রসঙ্গে স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, খুব মনে আছে আমি তখন লেসোথোতে। ওখানকার রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ায়ের কাজ করতে চলে যাই। সালেহা চৌধুরী লন্ডনে। সংসার দেখে, বাড়ি দেখাশোনা করে, এবং স্কুলে শিক্ষকতা করে। একটা মেয়ে কাছে আছে তাকে দেথে। নিয়মিত চিঠিপত্র লেখালেখি হয়। একদিন একটা পার্শ্বেল এলো লেসোথোর বাড়িতে। খুলে দেখি সেটা আর কিছু নয়, সালেহা চৌধুরীর উপন্যাস ‘বিন্নিধানের খই’। ও যখন লিখছিল বইটা নিয়ে একটু আধটু কথা বলেছিলো। এখন পুরো বই আমার সামনে। গ্রামে যারা আমাদের জমি বংশানুক্রমিক ভাবে দেখাশোনা করে এ উপন্যাসে ওদের কথা আছে। আমি রেখে দেই বইটা রাতে পড়বো বলে।

রাতে খাওয়ার পর বইটা পড়তে শুরু করি। বইটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে বুঝতে পারি সকাল হয়ে গেছে। মনে পড়ে না আর কোন বই আমি এত যত্ন করে, এত মনোযোগে, সারারাত জেগে পড়েছি। তার লেখা নদীর মত প্রবাহিত হোক এই কামনা করি।

তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী তার স্মৃতিচারণে লিখেন, আমাদের রান্নাখাওয়ার পর যে সময় তার একান্ত সে সময়েই ও লেখে। কাজেই আমাদের অভিযোগের কিছু নাই। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে, তারপর নিজেকে গুছিয়ে এখন কমপিউটারের সামনে বসে। (আগে হাতে লিখতো)। আমি দীর্ঘদিন নানা অসুখে ভুগছি। সেসব হাসি মুখে সামলিয়ে লিখছে সে। এও বা কমকি।

সালেহা চৌধুরীর বিভিন্ন লেখা তিনি পড়তে ভালোবাসতেন। তিনি ‘ওড়ো ঈগল ওড়ো’ নামে একটি অনুবাদ বই লিখেছিলেন। বইটি সালেহা চৌধুরীকে উৎসর্গ করেন।

সালেহা চৌধুরীর ছেলে দিশা আজিক চৌধুরী কম্পিউটার কনসালটেন্ট ও লেখক। পুরো আফ্রিকার দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে তিনি কাজের জন্য যান। ইউরোপের অনেক দেশে কাজের কারণে ভ্রমন করেন। এখন পর্যন্ত তিনটি বই লিখেছেন। ১. এ মুসলিম বয় ২. রিফিউজি ৩. রাইনো এ্যান্ড দ্য পোচার।

সালেহা চৌধুরীর কন্যা দিঠি নাজমুন সেহার চৌধুরী অনেকদিন একটি গ্রামার স্কুলে এ্যাকাউনটেন্ট হিসাবে কাজ করেন। বর্তমানে সোসাল সার্ভিসে নিবেদিত প্রাণ। তিনি বই লেখেন না। তবে তার প্রিয় শখ বই পড়া ও দেশ ভ্রমন।

অনেক দেশ দেখেছেন সালেহা চৌধুরী। পৃধিবীর প্রায় সব মহাদেশ। লেখেছেন সেখানকার দারুণ সব ঘটনা ও দৃশ্যাবলি। তার সবচাইতে প্রিয় ঋতু বসন্ত। যখন ঝুম করে শীতের ভেতর থেকে জেগে ওঠে প্রকৃতি। সময় কাটাতে খুব পছন্দ নিজের এক টুকরো বাগানে গোলাপের দিকে তাকিয়ে, বই পড়তে পড়তে। সন্তানদের কৃতিত্ব সবচাইতে আনন্দময় অনুভূতি। একটি গল্প লিখে শেষ করলে মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়। একটি ভালো বই! উৎসবের মত। যারা চলে গেছেন তাদের জন্য নিরন্তর প্রার্থনা সেই স্বর্গের যেখানে নিবিড় বাগান থাকে। আর পায়ের তলা দিয়ে চলে যায় কোন স্রোতস্বিনী।

সালেহা চৌধুরীর বয়স ৮০ বছর। মাঝে মাঝে আমাদের সাহিত্য বিষয়ে কথা হয়। সৃজনতরঙ্গ সাঈদ চৌধুরী সংখ্যা পড়ে ভীষন মুগ্ধ। আমার লেখা নিয়ে এফবিতে তার মন্তব্যে চমৎকৃত হই। খুবই বড় মনের মানুষ। আপনি তার সাথে কথা বলে মনে হবেনা কোন অশীতিপর বৃদ্ধার সাথে কথা বলছেন। লেখালেখিতেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে চান তিনি। বিক্রম শেঠের মতো সালেহা চৌধুরী বলেন, আমি আমার রচিত প্রেমের কবিতার শেষ লাইনে মারা যেতে চাই।

* সাঈদ চৌধুরীসময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *