সাইবার সিকিউরিটি আইনে জাতিসংঘের পরামর্শ প্রতিফলিত হয়নি : আইরিন খান

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের অধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলো যেসব সুপারিশ করেছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় তা প্রতিফলিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিকাশ ও সুরক্ষা বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান।

গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারকে লেখা চিঠিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। জাতিসংঘের সুপারিশ গুলোর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ নম্বর ধারা বাতিলের কথা উল্লেখ করা ছিল।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃত বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

আবার ৩১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে ওই ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা অপরাধ হিসবে গণ্য হবে। আর ধারা ২ (প) অনুযায়ী, ‘”মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” অর্থ যে সব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদের প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সেই সব আদর্শ।’

চিঠিতে আইরিন খান বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মানুষকে তাদের ধর্ম বা বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা ও বৈষম্য থেকে রক্ষা করে। কিন্তু এটি ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুভূতির সমালোচনা করার অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে না।’

‘এ ছাড়া, আইনে এই ধরনের বিধান ধর্মের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উত্সাহিত করার ঝুঁকি তৈরি করে এবং তা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে আইনি নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।’

তাই ২৮ নম্বর ধারাটি বাতিল করা উচিত বলে মনে করেন জাতিসংঘের এই বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার।

আইরিন খান বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের প্রধানসহ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সমালোচনা এবং রাষ্ট্রের পতাকা, জাতীয় প্রতীক বা ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকার আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত।’

তিনি বলেন, ‘এই বিধান অস্পষ্টভাবে প্রণীত হওয়ায় বাংলাদেশের স্বতন্ত্র জাতীয় ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রক্ষায় সরকারের ইচ্ছা রাজনৈতিক অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করতে পারে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’

আইরিন খানের মতে, সরকারের উচিত মানহানির বিষয়টিকে সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ফৌজদারি আইন থেকে সরিয়ে তার পরিবর্তে মানহানি বিষয়ে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। যাতে করে শুধুমাত্র প্রকৃত ভুক্তভোগীরাই এসব ক্ষেত্রে অভিযোগ করতে পারেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।

আইনটির ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি, ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত পাঠান, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জানা থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে প্রকাশ বা প্রচার করেন, (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জানা থাকা সত্ত্বেও, সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করলে বা সহায়তা করলে তা ওই ব্যক্তির অপরাধ হবে।’

আইরিন খানের ভাষ্য, ‘যারা সরকারের সমালোচনা করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই দুটি ধারাই সচরাচর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘যদিও আন্তর্জাতিক আইনে অন্যের সুনাম রক্ষার জন্য কারো বক্তব্যে সীমারেখে নির্ধারণের অনুমতি রয়েছে, তবে সেটা কেবল ভুক্তভোগী ব্যক্তির দ্বারা মামলা করার মাধ্যমেই করতে হবে। এক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনের অধীনে রাষ্ট্র কর্তৃক বিচারের মাধ্যমে সেটা করা যাবে না।’

‘এক্ষেত্রে “আপত্তিকর বা মিথ্যা তথ্য” দেওয়ার বিষয়টিকে অপরাধ গণ্য করা আইনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর মাধ্যমে বিভ্রান্তি ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা কার্যকর নয়। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার সব ধরনের তথ্য ও ধারণার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যার মধ্যে এমন তথ্য বা ধারণাও থাকতে পারে যেগুলো মানুষকে আঘাত দিতে পারে, বলেন তিনি।

জাতিসংঘের এই বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ারের মতে, ‘স্বাধীন ও বৈচিত্র্যময় গণমাধ্যমসহ তথ্যের বিভিন্ন উত্স জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকলে এবং ডিজিটাল মাধ্যম ও মিডিয়া বিষয়ে জনসাধারণের সম্যক ধারণা মিথ্যা তথ্য রোধে বেশি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *