সঙ্কটাপন্ন খালেদা জিয়া

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এটি কোনো ভক্তের অতিশয়োক্তি নয়। দেশের রাজনীতির ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করে। বিগত অর্ধশতাব্দীতে তার পরাজয়ের কোনো গ্লানি নেই। যে ক’টি নির্বাচনে তিনি যেখান থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন না কেন, বিজয় ছিল অবধারিত। এটি আইনগত জনপ্রিয়তার উদাহরণ। আর দৃশ্যমান জনপ্রিয়তা পরিমাপের বিষয় যদি থাকে তাহলে মানুষের উদ্বেলিত ভালোবাসা তার প্রমাণ। বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই গেছেন পদ্মা-মেঘনা-যমুনার তীরে তীরে অথবা যেকোনো নগর-বন্দরে উপচে পড়েছে মানুষ। ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, খালেদা জিয়া আছে দেশ জুড়িয়া’। তিনি বহন করেন শহীদ জিয়ার উত্তরাধিকার। গণতন্ত্রের সংগ্রামে আপসহীন নেত্রী তিনি। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রহরী, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতীক তিনি। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের মহাশত্রু। তিনি সম্প্রসারণবাদের চ্যালেঞ্জ। তাই তারা তাকে নিমিষেই নিঃশেষ করে দিতে চায়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে রাজনীতির মাধ্যমে মোকাবেলা না করে ক্ষমতাসীন সরকার ‘নির্মূল’-এর সিদ্ধান্ত নেয়। এক-এগারোর প্যাকেজ ডিল অনুযায়ী অগ্রসর হয় প্রতিপক্ষ ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ অবশেষে ‘মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড স্থগিত করে দু’টি শর্তে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তখন করোনা মহামারীর মধ্যে তার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়। এরপর থেকে পরিবারের আবেদনে ছয় মাস অন্তর তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। যে দু’টি শর্তে নির্বাহী আদেশে সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে, তার প্রথমটি হলো- তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। দ্বিতীয় শর্তটি হলো- তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। ৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, খালেদা জিয়ার লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি ও কিডনি সমস্যার কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এর আগেও ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই সময় পাঁচ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। ৭৮ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় তাকে বাঁচানোর চেষ্টায় বিদেশে পাঠানোর অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করে খালেদা জিয়ার পরিবার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়ে দেন, আইনগতভাবে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে অনুমতি দেয়ার কোনো সুযোগ সরকারের হাতে নেই। তবে এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বেশ কয়েকজন আইন-বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, খালেদা জিয়া এখন যে অবস্থায় আছেন, সেই অবস্থায় রেখেই তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে অনুমতি দেয়া যায়। আইনে সে সুযোগ আছে।

আইনে কেন সুযোগ নেই, সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ আইনে থাকে না। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং সর্বশেষ উপধারা ৬ ব্যাখ্যা করে মতামত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। সেই মতামত হচ্ছে ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেটির অতীতও শেষ হয়ে গেছে। এটি আর খোলার কোনো উপায় নেই।’ তিনি আরো বলেছেন, উপমহাদেশে ৪০১ ধারার ক্ষমতা যখন সরকার প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না বলে সিদ্ধান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী যেটি বলেছেন, সেটি হচ্ছে এখন যে আদেশ আছে, সেটি যদি বাতিল করা হয়, বাতিল করে তাকে (খালেদা জিয়া) যদি আবার কারাগারে নেয়া হয়, তাহলে আদালতে যেতে পারেন। বর্তমান অবস্থায় তিনি আদালতে যেতে পারেন বলে কোনো সুযোগ নেই। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার আলোকে আবেদনটিতে আগেই খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়েছিল। এ কারণে আর কোনো স্কোপ নেই অন্য কোনো আদেশ দেয়ার। এখন তাকে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যেতে হবে এবং জেলখানায় যাওয়ার পর তিনি জামিন আবেদন এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। কারণ সাজার বিরুদ্ধে তার আপিল পেন্ডিং রয়েছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়া তার দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছেও আবেদন করতে পারেন।’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করে, এ ধরনের বক্তব্য আপসহীন নেত্রী বলে পরিচিত দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মাথা অবনত করানোর কূটকৌশল মাত্র। তার সম্পর্কে সুকান্তের সেই বিখ্যাত উক্তিই প্রযোজ্য : ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। সরকারের উক্তি ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত নিয়ে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডক্টর শাহদীন মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘খালেদা জিয়া এখন যে অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় রেখেই তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে অনুমতি দেয়া যায়। আইনে সে সুযোগ আছে। খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হয়। এর পর ছয় মাস তা বাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আইনমন্ত্রী যে বলছেন ওই আবেদন নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, আইনে আর কিছু করার নেই। তাহলে আমার প্রশ্ন- তার মুক্তির মেয়াদ আরো আটবার বাড়ানো হলো কোন আইনে? যদি ওটা ক্লোজ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাসেই শেষ হওয়ার কথা ছিল।’ শাহদীন মালিক আরো বলেন, ‘এটি করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নির্বাহী সিদ্ধান্ত নেয়া প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন। ম্যান্ডেটরি নয়।’ এবার দেখা যাক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর উক্তি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার বয়স তো আশির ওপরে, মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে। বিএনপি কিভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরো সহানুভূতি আশা করে।’ ২ অক্টোবর ২০২৩ লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারপ্রধান হিসেবে নিজের নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে খালেদা জিয়াকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। বিএনপি এখন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আন্দোলন করছে। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে আমার কিছুই করার নেই। কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া তার বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। তারপরও তারা (বিএনপি) কিভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরো সহানুভূতি আশা করে।’

সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমাদের একটি কঠিন অবস্থানের নির্দেশ দেয়। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে অমানবিক, অনৈতিক ও অন্যায় বলে অভিহিত হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, অতীতে তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। সে জন্য অন্যায় ন্যায় হয়ে যায় না। ‘তুমি অধম হইয়াছো বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন?’ এটি দুর্ভাগ্যের কথা যে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে সম্ভবত রাজনৈতিক দরকষাকষি চলছে। তার চিকিৎসা পাওয়ার মানবিক অধিকার খর্ব করে আইনের অজুহাতে দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চায় সরকার। আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিনা চিকিৎসায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সরকার হত্যা করতে চায় বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজনৈতিক বিরোধিতা আর শত্রুতাকে একাকার করে ফেলছে আওয়ামী লীগ নেতারা। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার মানবিক ও মৌলিক।

খালেদা জিয়ার কিছু হলে তার রাজনৈতিক পরিণতি কী হবে তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে সরকারকে। আইনের চোখে সবাই সমান। নীতিগতভাবে এ টুকুও যদি সরকার মেনে নেয় তাহলে বেগম খালেদা জিয়া আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারেন। কিন্তু সবাই জানে, সবাই বোঝে- কী কারণে আইন বেআইনি পথে হাঁটে। খালেদা জিয়ার প্রতি নিযুত কোটি মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের তাড়নায় নিবেদন করছি একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানের কয়েকটি কলি :

‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/ সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহঙ্কার/ একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/ সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহঙ্কার।’


ড. আবদুল লতিফ মাসুম- অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় Mal55ju@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *