সংস্কৃতিকেন্দ্র স্থাপন ও চর্চায় নজরুলের ভাবনা ।। ড. ফজলুল হক তুহিন

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি হয়তো আমার হাতে বোঝা, কিন্তু তাই বলে তাকে আমি ফেলেও দেইনি। আমি গোধূলি বেলায় রাখাল ছেলের সাথে বাঁশি বাজাই, ফজরে মুয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলিয়ে আজান দেই, আবার দীপ্ত মধ্যাহ্নে খর তরবারি নিয়ে রণভূমে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন আমার খেলার বাঁশি হয়ে ওঠে যুদ্ধের বিষাণ, রণশিঙ্গা।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে ‘চট্টগ্রাম বুলবুল সোসাইটি’র পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যে মানপত্র দেওয়া হয়, তার উত্তরে কবি গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিভাষণ প্রদান করেন উপরের অংশটি তার প্রথম কয়েকটি লাইন।

সংস্কৃতির ব্যবহারিক উদ্দেশ্য যে সুন্দর ও কল্যাণের বার্তা ছড়ানো তা নজরুলের ভাষণে প্রকাশিত। ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভের সৃজনধারা সৃষ্টি কবির ধর্ম। কিন্তু ফুলের বিনাশ যারা চায় তাদের জন্য কবির তরবারি প্রস্তুত। কবি গোধূলিতে বাঁশি বাজান; ফজরে আজানের সুর ধরেন; অন্যদিকে দুপুরে তরবারি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করেন; এ-লড়াইয়ে কবির সুরের বাঁশিই অস্ত্র হয়ে যায়। মানে জীবন ও সময়ের প্রয়োজনে কবির সংস্কৃতি যেমন নান্দনিক চর্চায় নিয়োজিত তেমনি যুদ্ধের ময়দানেও সক্রিয়। ঔপনিবেশিক সমাজে বিপ্লবী ও ঐতিহ্যবাদী নজরুল সংস্কৃতির প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদী ভূমিকায় সৃজনশীল।

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলার লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠেন। বৃটিশ কম্পানি ও বৃটিশ শাসন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশ স্থাপন করে। বৃটিশ শাসনযন্ত্রের অপকর্ম ও অপতৎপরতা এবং গণমানুষের অধিকার বঞ্চনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নজরুল সাহিত্যাঙ্গনে অদ্বিতীয় ও অসাধারণ হিসেবে আবির্ভূত হন। অসন্তোষ থেকেই জন্ম নিয়েছে কবির দ্রোহ ধ্বংস-বিনাশ-প্রলয়ের ইশতেহার। আত্মজাগরণের মাধ্যমে বিদ্রোহ। ভারতের নির্জীব, মরা-জরাগ্রস্ত ও হীনম্মন্য জনগণের অন্তরের-আত্মার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক বিদ্রোহ। বিদ্রোহ কবির পথ; পাথেয় আত্মোদ্বধন। লক্ষ্য অনেক বড় ও মহৎ। অসুন্দর ও অধীনতা ধ্বংসে তাই কবির কোনো দ্বিধা নেই, মায়া নেই, ভয় নেই; এক্ষেত্রে কবি বিপ্লবী। এই কাজে তাই অনুভূত হবেই প্রসববেদনা, যার অন্য নাম ‘কাল বৈশাখী’ বা গণবিপ্লব। কবি নতুনের কেতন উড়িয়ে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান স্বাধীন ও বন্ধনহীন জীবনের জোয়ার।

সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। স্বাধীনতাÑ সমস্ত শৃঙ্খল-বন্ধন থেকে স্বাধীনতাÑ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতের স্বাধীনতা কবির পরবর্তী ধাপ। ‘ধূমকেতু’তে তাই কবি ঘোষণা করেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী; স্বয়ত্তশাসন নয়; কারণ ভারতের জনগণই অধিকার রাখে ভারত শাসনের; অন্য কেউ নয়। এখানে কবির মৌলিক ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়।

নজরুল ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিতে জাতপাত-বর্ণাশ্রমসহ নানা ভেদাভেদ সক্রিয়। অথচ জাতিগত বিভেদ, বিশৃঙ্খলা, অনৈক্য দিয়ে কাক্সিক্ষত মুক্তি সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন দৃঢ় ঐক্য; জাতিগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই উপনিবেশমুক্ত স্বধীন ভারত আসবে। তাই কবি হিন্দু-মুসলমানের মিলন চেয়েছেন। নিজে হিন্দু মেয়ে বিয়ে পর্যন্ত করেছেন। অসংখ্য কবিতা-গান-প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখায় এই মিলনের কথা জোরালো ও আন্তরিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। ব্রিটিশের কূটচাল ডিভাইড এন্ড রুলকে কবি মর্মে মর্মে অনুভব করেন। ফলে একদিকে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সভ্যতার গৌরব ও বীরগাঁথা; অন্যদিকে হিন্দু পুরানের বীর প্রতীকের পুনর্ব্যবহার করেছেন এই মিলনের প্রেরণায়; ইসলামী গান ও শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন উভয় জাতির শত বছরের সংস্কার, বন্ধনমুক্তি, ভক্তি ও উজ্জীবনের উদ্দেশ্যে। ‘নবযুগে’ কবির ভাষ্য: “এস ভাই হিন্দু। এস ভাই মুসলমান। এস বৌদ্ধ। এস ক্রিশ্চিয়ান। আজ আমরা সব গণ্ডী কাটাইয়া, সব সঙ্কীর্ণতা, সব মিথ্যা সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। আজ আমরা আর কলহ করিব না।” তাই কবি একবৃন্তে দুটি কুসুম- হিন্দু ও মুসলমানের ছবি এঁকেছেন।

নজরুল সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি ও শিলনের জন্য শুধু জাতিভেদ, জাতিদ্বন্দ্ব, ধনী-গরিব ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দিতে চাননি; তিনি সর্বাত্মকভাবে সাম্যবাদ চেয়েছেন, সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েমের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। সকল মানুষ এক, সমান; উঁচু-নিচু, ধনি-গরিব, সাদা-কালো, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন, দেখার আহ্বান করেছেন; যেখানে সকল বাধা-ব্যবধান দূর হয়ে মানুষ মানুষের ভাই হয়ে উঠেছে, সবাই মানুষ। পশ্চিমের উপনিবেশের সম্পূর্ণ বিপরীতে কবির অবস্থান।

কবির সাস্কৃতিক লক্ষ্যÑ প্রথমত শৃঙ্খলমুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন; দ্বিতীয়ত স্বাধীন জীবন-সমাজ-সংস্কৃতি-শিল্পের বিনির্মাণ; চূড়ান্ত লক্ষ্য মুক্তিÑ গণমানুষের মুক্তি। সত্য-সুন্দর-কল্যাণের ‘ফুল’ ফোটানো। এককথায়, অসত্য-অন্যায়-অসুন্দর শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-বিপ্লবের মাধ্যমে সত্যের নির্মাণ, ন্যায়ের সৃষ্টি এবং সুন্দরের সৃজন। বিদ্রোহ-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরে যে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা সেখানে প্রেমের প্রসঙ্গ আসে। নজরুল তাই শুধু দ্রোহ ব্যক্ত করেননি; প্রেমের জয়গান গেয়েছেন, প্রেমের বর্ণিল রং ছড়িয়েছেন; প্রেমের স্তুতি ও নান্দিপাঠ করেছেন। তবে তা একান্ত ভারতীয় মন-মেজাজ-চরিত্র ও চিত্রকল্প-উপমা-রূপকের সাহায্যে; পশ্চিমের প্রেমরীতি ও রং সেখানে নেই। বিশ শতকের ভারতবর্ষে উপনিবেশিক বাষ্ট্রে এইসব চিন্তা-চেতনা-ভাবনা যেমন নতুন; তেমনি বাংলা কবিতায় একদম মৌলিক ও আনকোরা। গণমানুষের সেই মুক্তির মন্ত্র সেই সমাজে নতুন জোয়ার সৃষ্টির পাশাপাশি সাহিত্যেও বিপ্লব সৃষ্টি করে। পলে পাঠক তীব্রভাবে তাকে গ্রহণ করে ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।

ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্কৃতির বিকাশে ইংরেজ রাজশক্তির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা লক্ষণীয়। একদিকে হিন্দু শিক্ষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাতীয়তাবাদী সাহিত্য-শিল্পকলা-রাজনীতির উত্থান; অন্যদিকে পশ্চিমা দর্শন, সাহিত্যাদর্শ ও সংস্কৃতির প্রভাব প্রতিফলিত। ফলে জীবনের সবদিক থেকে বাঙালি মুসলমানের জায়গা সংকুচিত ও সংস্কৃতি-চর্চা সংকটে নিজজ্জিত হয়। যদিও উনিশ শতকের শেষ থেকে সবক্ষেত্রে মুসলিম জাগরণের ঢেউ ওঠে। সংবাদপত্র, সাহিত্যপত্র, নানা ধরনের সংগঠন-সংস্থা গড়ে ওঠে; আবার মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনও তৎপরতা শুরু করে এ-সময়। কাজী নজরুল সমগ্র বাংলায় যুবসমাজকে জাগিয়ে তুলতে সফর করেন বাংলার সর্বত্র; কবিতা, গান ও ভাষণে নতুন উদ্দীপনায় তরুণ সমাজে উজ্জীবনের সুর তোলেন। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে আত্মজাগরণ, সর্বাত্মক দ্রোহ ও মুক্তির নিশান তুলে ধরেন বাংলার আকাশে। মনুষত্ব, মানবতা, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা আর ইনসাফের তীব্র ঘোষণায় বাংলার সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে নতুন বাঁক আসে।

নজরুল ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে ‘চট্টগ্রাম বুলবুল সোসাইটি’র পক্ষ থেকে কবি নজরুল ইসলামকে দেয়া মানপত্রের উত্তরে কবি ‘মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা’ নামে যে প্রতিভাষণ প্রদান করেন সেখানে বলেন:
আপনাদের ইসলামাবাদ হোক ওরিয়েন্টাল কালচারের পীঠস্থান-আরফাত ময়দান। দেশ-বিদেশের তীর্থ-যাত্রী এসে এখানে ভিড় করুক। আজ নব জাগ্রত বিশ্বের কাছে বহু ঋণী আমরা, সে ঋণ আজ শুধু শোধই করব না-ঋণ দানও করব, আমরা আমাদের দানে জগতকে ঋণী করব-এই হোক আপনাদের চরম সাধনা। হাতের তালু আমাদের শূন্য পানেই তুলে ধরেছি এতদিন, সে লজ্জা আজ আমরা পরিশোধ করব। আজ আমাদের হাত উপুড় করবার দিন এসেছে। তা যদি না পারি সমুদ্র বেশি দূরে নয়, আমাদের এ-লজ্জার পরিসমাপ্তি যেন তারি অতল জলে হয়ে যায় চিরদিনের তরে।

কবি নজরুল আহ্বান করেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মতো একটি সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে; যেখান থেকে পারস্যের মহাকবিদের মতো প্রতিভাবানদের আবির্ভাব হবে। এই কবিরাই নতুন প্রাণের বন্যায় নবযুগ নিয়ে আসবে এবং বদ্ধ প্রাণধারাকে মুক্তি দিবে। সেজন্য কবি ‘কালচারাল সেন্টারে’র প্রয়োজনীয়তার তাগিদ উপলব্ধি করেন।

আমি বলি, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মতো আমাদেরও কালচারের, সভ্যতার, জ্ঞানের সেন্টার বা কেন্দ্রভূমির ভিত্তি স্থাপনের মহৎ ভার আপনারা গ্রহণ করুন। আমাদের মতো শত শত তরুণ খাদেম তাদের সকল শক্তি আশা-আকাক্সক্ষা জীবন অঞ্জলির মতো করে আপনাদের সে উদ্যমের পায়ে অর্থ্য দেবে। প্রকৃতির এই লীলাভূমি সত্যি সত্যিই বুলবুলিস্তানে পরিণত হোক- ইরানের শিরাজের মতো। শত শত সাদি, হাফিজ, খৈয়াম, রুমি, জামি, শমশি-তবরেজ এই শিরাজবাগে- এই বুলবুলিস্তানে জন্ম গ্রহণ করুক। সেই দাওয়াতের আমন্ত্রণের গুরুভার আপনারা গ্রহণ করুন। আপনারা রুদকির মতো আপনাদের বদ্ধ প্রাণধারাকে মুক্তি দিন। আমি এইরূপ ‘কালচারাল সেন্টারে’র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি নানা কারণে।

অন্যদিকে কবি নজরুল পরাধীন ভারতে হিন্দু ও মুসলিম প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মাঝে দ্বন্দ্ব এবং ইংরেজ শিক্ষাব্যবস্থার চমক ও খোলস সর্বস্বতার দিকে মনোযোগ নির্দেশ করেন। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মাঝে ঐতিহাসিক বাঁকবদলের মাধ্যমে হিন্দুর ক্রমোন্নতি ও মুসলিমের ক্রমাবনতির পরস্পর বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক এবং মুসলিমের গড় মাফকাঠির প্রতি দৃষ্টি দেন।

ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি- শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটও ভাঙছে- তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা মুসলমানেরা আমাদেরই প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনত দেখে আমাদের অশ্রদ্ধা করে। ইংরেজের শাসন সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে এই যে, তার শিক্ষা-দীক্ষার চমক দিয়ে সে আমাদের এমনই চমকিত করে রেখেছে যে, আমাদের এই দুই জাতির কেউ কারুর শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতার মহিমার খবর রাখিনে। হিন্দু আমাদের অপরিচ্ছন্ন অশিক্ষিত কৃষাণ-মজুরদের (আর, তাদের সংখ্যাই আমাদের জাতের মধ্যে বেশি) দেখে মনে করে, মুসলমান মাত্রই এই রকম নোংরা, এমনি মূর্খ, গোড়া। হয়তো বা এরা যথা পূর্বম তথা পরম। দরিদ্র মূর্খ কালিমদ্দি মিয়াই তার কাছে এ্যাভারেজ মুসলমানের মাপকাঠি।

নজরুল ইতিহাসে মুসলিম সভ্যতার বিপুল অবদান ও ইংরেজ আসার পরে তার অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। ‘জ্ঞানে-বিজ্ঞানে শিল্পে-সঙ্গীতে সাহিত্যে’ মুসলিম জাতি একদা বিপুল দানে পৃথিবীকে ভরিয়ে তুলেছিলো সে-সম্পর্কে কবি স্মরণ করিয়ে দেন। ভারতে ফারসি রাজভাষা থাকাকালে এবং মুসলিম শাসন বজায় থাকাবস্থায় এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ছিলো না। মানে শাসন ও ভাষার প্রশ্নে এবং জীবনের সবখানে মুসলিম জাতিকে আগের অবস্থায় ফিরতে নতুন জাগরণের প্রতি জোর দেন কবি।

জ্ঞানে-বিজ্ঞানে শিল্পে-সঙ্গীতে সাহিত্যে মুসলমানের বিরাট দানের কথা হয় তাবা জানেই না, কিংবা শুনলেও আমাদের কেউ তাদের সামনে তার সত্যকার ইতিহাস ধরে দেখাতে পারে না বলে বিশ্বাস করে না। মনে করে-ও শুধু কাহিনী। হয়ত একদিন ছিল, যখন হিন্দুরা মুসলমানদের অশ্রদ্ধা করত না। তখন রাজভাষা ঝঃধঃব খধহমঁধমব ছিল ফার্সি, কাজেই হিন্দুরাও বাধ্য হয়ে ফাসি শিখতেন এখন যেমন আমরা ইংরেজি শিখি। আর ফার্সি জানার ফলে তাঁরা মুসলমানদের বিশ্বসভ্যতায় দানের কথা ভালো করেই জানতেন। কাজেই সে সময় অর্থাৎ ইংরেজ আসার পূর্ব পর্যন্ত কোন মুসলমান নওয়াব বাদশার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলেও সমগ্র মুসলমান জাতি বা ধর্মের উপর বিরূপ হয়ে ওঠেননি।

নজরুলের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভাষণ প্রকাশিত হয় ‘বুলবুল’ ফাল্গুন, ১৩৪৩ সংখ্যায়। জাতীয় জীবন ও সংস্কৃতির বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কবি সর্বাত্মক জাগরণের প্রতি মনোযোগী হন। একটি সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র স্থাপন এবং সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্পকলা, সঙ্গীত ইত্যাদি চর্চার মাধ্যমে নতুনভাবে জেগে ওঠার প্রতি কবি জোর তাগিদ দেন। কারণ আমাদের অর্থ ও শক্তি আছে।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু কবিতা-গানে-কথাসাহিত্যে আপন জাতির নবউদ্যমে জাগরণের রণঝংকার তোলেননি; সাংবাদিকতা, গণমুখী রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টি ও সশরীরে সমগ্র দেশের তরুণ সংঘ-সংগঠনে গিয়ে মুসলিম সমাজকে আন্দোলিত করেন; বক্তৃতা, কবিতা, গানে, সাংবাদিকতায় ও সাহচার্যে উজ্জীবিত করেন বিপুল প্রাণশক্তির উৎসারণে। সংস্কৃতির প্রশ্নে কবি নজরুলের দৃষ্টি স্পষ্ট: মুসলিম ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা থেকে প্রেরণা ও উপাদান নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে জাতীয় জীবন ও সংস্কৃতির নবনির্মাণ; সেই লক্ষ্যেই একটি ওরিয়েন্টাল সংস্কৃতিকেন্দ্র স্থাপন এবং চর্চার মাধ্যমে সবধরনের শৃঙ্খল-বাধা দূর করে মুক্তির নিশান ওড়ানো।

* ড. ফজলুল হক তুহিন কবি ও গবেষক, কালজয়ী কবি আল মাহমুদের কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে পিএইচডি, শিল্প-সাহিত্যের কাগজ ‘নতুন এক মাত্রা’র নির্বাহী সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *