সংগ্রাম এবং অগ্রগতির গল্প : লন্ডনে বাংলাদেশীদের অর্ধ শতাব্দী

প্রবাসী যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশীদের অর্ধ শতাব্দীর (১৯৫০-২০০০) সংগ্রাম এবং অগ্রগতির গল্প নিয়ে ইস্ট এন্ড কানেকশন দারুণ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। গতকাল বুধবার (২৬ জুন ২০২৪) বিকেলে ছিল প্রজেক্ট লঞ্চিং অনুষ্ঠান। ইস্ট লন্ডনের ব্র্যাডি আর্টস সেন্টারে কমিউনিটির উল্লেখযোগ্য সংগ্রামী মানুষের উপস্থিতিতে অন্যরকম আবহ তৈরি হয়েছিল।

বাউন্ডারি কমিউনিটি স্কুল এবং উইভার ইয়ুথ ফোরামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল ইসলাম জোয়ারদারের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় বড় স্ক্রিনে বর্ণবাদ প্রতিরোধের ছবি সমূহ দেখে সে সময়ের স্মৃতি কাতরতায় এক ধরনের নস্টালজিক হয়ে পড়েন প্রবীণদের অনেকেই।

ইস্ট এন্ড কানেকশনের ফাউন্ডার ট্রাস্টি এবং এই প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী বদরুল আলম অনুষ্ঠানে প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন। যে কোন তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে সামগ্রিকভাবে সঠিক ইতিহাস তথা অন্য সকলের অবদান তুলে ধরার জন্য তিনি কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন কমিউনিটির শীর্ষ হিরোদের অন্যতম বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামী রাজন উদ্দিন জালাল। সমাজে বর্ণবাদের বিষবাষ্প এবং শ্বেতাঙ্গদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার পর বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চাল চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর অনুপম উপস্থানায়। প্রকাশ পেয়েছে বর্ণবাদের জঘন্য আধিপত্য আর নিগৃহীতের কাতরতা। জানা গেছে তখন কিভাবে বিক্ষোভে কেঁপে উঠেছে পুরো কমিউনিটি।

অনুষ্ঠানে টাওয়ার হ্যামলেটস লোকাল হিস্ট্রি লাইব্রেরি এন্ড আর্কাইভ‘র এনগেজমেন্ট অ্যান্ড লার্নিং অফিসার সানজিদা আলম মাল্টিকালচারাল সোসাইটি হিসেবে ইস্ট লন্ডনের বিকাশের ইতিহাস তুলে ধরেন। এখানকার সঠিক তথ্য সংরক্ষণে ইস্ট এন্ড কানেকশন কর্তৃক নেয়া প্রকল্পের গুরুত্বারোপ করে বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসে সমৃদ্ধ বহু-সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় তৈরি করতে যারা অবদান রেখেছেন, জাতি তাদের সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানতে পারবে।

লেখক-কবি ও প্রশিক্ষণ সহায়তাকারী ফরিদা মমতাজ বর্ণ বৈষম্য মোকাবেলার ইতিহাস-সহ এথনিক সম্প্রদায়ের তথ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করেন। তিনি জাতিগত সহিংসতা ও বৈষম্য নিরসনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ব্যাপক অংশ গ্রহন প্রত্যাশা করেন।

উপস্থিত সুধীজনের মধ্য থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামে সামনের কাতারের সৈনিকদের মধ্যে সাবেক কাউন্সিলর ও ডেপুটি মেয়র আকিকুর রহমান, সাবেক কাউন্সিলর ও ডেপুটি লিডার আব্দুস শুকুর, কমিউনিটি নেতা সিরাজ হক, সাবেক কাউন্সিলর আয়ুব করম আলী, অধ্যাপক তারেক কোরেশী ও ড. আব্দুল হান্নান। তারা বলেন, সত্তর ও আশির দশকের অগ্রগামীরা আমাদের কমিউনিটির জন্য পরিবর্তনকারী ছিলেন। যারা সংগঠিত হয়েছেন, প্রচারণা চালিয়েছেন, মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এবং সবকিছু ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য অগণিত কার্যক্রম চালিয়েছেন তাদের কথা যেন সঠিক ও যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ড. এম আহমদুল্লাহ তথ্য সংগ্রহে শ্রম, সাধনা ও নৈতিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সকলের সার্বিক সহায়তা কামনা করেন।

সমাপনী বক্তব্যে সাবেক মেয়র ও কাউন্সিলর সাইফুল আলম বলেন, আমাদের সংগ্রামী সাধারণ মানুষ কিভাবে রুখে দিয়েছে রেসিস্ট এটাক ও প্রপাগান্ডা তা তুলে ধরার জন্য এই প্রকল্প। এর মাধ্যমে সমাজ বিকাশে যারা অবদান রেখেছেন তাদের ইতিহাস জানতে পারবে আমাদের নতুন প্রজন্ম।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনের মধ্যে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর ও স্পিকার আব্দুল মুকিত চুনু, কাউন্সিলর আব্দাল উল্লাহ, কমিউনিটি নেতা আব্দুস সাত্তার, ফখর আহমদ, আব্দুল মুকিত, মনি হক, সাদিকুল আমিন, হাফসা ইসলাম, হাফিজ মো: জিলু খান, আহলুল করিম, আ. ম. নেসওয়ার, জামাল মিয়া, সফিক উদ্দিন, আনহার আলী, নোমান আহমদ, আনা এস মিয়া, শফিক আহমদ, মুন্নী চৌধুরী, লিপি চুনু প্রমুখ।

উল্লেখ্য, ‘ইস্ট এন্ড কানেকশন’ ন্যাশনাল লটারি হেরিটেজ ফান্ড থেকে ৮৪ হাজার ৮৯৬ পাউন্ড অনুদান পেয়েছে। লন্ডনের ইস্ট এন্ডে বাংলাদেশীদের অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্য এই তহবিল ব্যয় করা হবে। এজন্য বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সংগ্রামগাথা ইতিহাস প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রকল্পটি পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশী জনতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে- যারা ১৯৭০ এবং ১৯৮০র দশকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলির জন্য অগ্রগামীরা সাড়া দিয়েছেন। প্রকল্প সংশ্রিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অংশগ্রহণকারী এক ডজন মানুষের সাথে কাজ করবেন। যারা পঞ্চাশ বছরের সময়কালে বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সংগ্রাম এবং সক্রিয়তার গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস গবেষণা, রেকর্ড এবং প্রকাশের জন্য তৈরী করবেন।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণা, ডেটা বিশ্লেষণ এবং বাংলাদেশী পটভূমির অতীত কর্মীদের মৌখিক ইতিহাস রেকর্ড করা হবে। এর মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং শিক্ষাবিদদের পাশাপাশি পূর্ব লন্ডনে বসবাসকারী অ-বাংলাদেশি বাসিন্দারা। এতে অতীতের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী লোকের মুখ থেকে সরাসরি শেখার সুযোগ বাড়বে। এটি সমাজের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের স্মৃতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে, যা তাদের অতীত সম্পর্কে জানা ও বোঝা এবং সুন্দর ভবিষ্যত তৈরীর ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

প্রকল্প থেকে মৌখিক ইতিহাসের ছত্রিশটি রেকর্ডিং, ডেডিকেটেড ওয়েবসাইট, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শেখার উপকরণ সমৃদ্ধ ভিডিও অভিজ্ঞতা, সংক্ষিপ্ত ডকুমেন্টারি, একটি প্রদর্শনী, নাটকের মাধ্যমে বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম মঞ্চায়ন এবং বাংলা ও ইংরেজিতে গ্রন্থ প্রকাশিত হবে।

উল্লেখ্য, ইস্ট এন্ড কানেকশন হল একটি স্পন্দনশীল কমিউনিটি হাব- যার লক্ষ্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম এবং ইভেন্টের মাধ্যমে মানুষকে একত্রিত করা। অন্তর্ভুক্তি এবং বৈচিত্র্যের উপর ফোকাস করে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষমতায়ন ও উন্নত করতে সাহায্য করা; সম্প্রদায়ের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য প্রচার-সহ টাওয়ার হ্যামলেটসের সামাজিক সংহতি অর্জন।

* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *