শুভ জন্মদিন কবি সোলায়মান আহসান

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী
সোলায়মান আহসান একজন আধুনিক কবি ও কথাসাহিত্যিক। চার দশক ধরে বাংলা ভাষা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করে চলেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় সাফল্য দেখিয়েছেন অবলীলায়। কবিতার পাশাপাশি সাংবাদিকতায়ও রেখেছেন সুগভীর অবদান। প্রচন্ড উদ্ভাবনী শক্তি ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি তার সাহিত্যকে করেছে স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী। আজ এই কবির শুভ জন্মদিন।

কবি সোলায়মান আহসান আমার জীবনে ছায়ার মতো। সেই ছেলে বেলা থেকে কেমন আপন করে নিয়েছিলেন। অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত অভিভাবক বা মেন্টর যদি বলি, তাহলে সাহিত্যে কবি আল মাহমুদ ও কবি আফজাল চৌধুরী ছিলেন আমৃত্যু এবং সাংবাদিকতায় সোলায়মান আহসান, হারুনুজ্জামান চৌধুরী ও আব্দুল হামিদ মানিক আজো আয়না ও ছায়ার মতো। প্রতিটি সৃজনকর্মে তাদের হৃদয়জ পরামর্শ আমাকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যোগায়।

আমি যখন নতুন লেখিয়ে, তখন দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী সিলেটি সাহিত্যিকদের মধ্যে দার্শনিক ও সমাজচিন্তক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ‘জিব্রাইলের ডানা’ খ্যাত গল্পকার অধ্যাপক শাহেদ আলী, বিশ্বাসী কবি কন্ঠ অধ্যাপক আফজাল চৌধুরী, গণমানুষের কবি দিলওয়ার, লেখক ও পন্ডিত অধ্যক্ষ কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী, ডাক সাইটে আমলা কবি মোফাজ্জল করিম প্রমুখ ছিলেন ধ্রুব তারার মতো। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান শাহরিয়ার, সম্পাদক ও টিভি উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী প্রমুখ দেশ-বিদেশে আলোকিত নাম। নানাভাবে আমি যাদের সাহচর্য পেয়েছি। তাদের সকলের জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখেছি।

কবি সোলায়মান আহসানের উৎসাহে আমি যখন সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের সাথে সম্পৃক্ত হই, তখন একেবারেই তরুণ। সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের কারণে অগ্রজের সাথে কাজ করতে হয়। প্রবীণেরা আমাকে অধিক ভালোবাসতেন। আল ইসলাহ সম্পাদক নুরুল হক, শিক্ষাবিদ মুসলিম চৌধুরী, ভাষা সৈনিক শাহাদত খান, সাংবাদিক-কলামিস্ট বোরহান উদ্দিন খান, গবেষক-অধ্যাপক আসাদ্দর আলী, সত্যসন্ধানী লেখক দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, লোক সাহিত্যিক ও গবেষক চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্য ভূষণ, গবেষক ও রম্য লেখক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, কবি রাগিব হোসেন চৌধুরী, সাংবাদিক মুক্তাবিস-উন-নুর, প্রাবন্ধিক আব্দুল হামিদ মানিক, অধ্যক্ষ কালাম আজাদ, সাংবাদিক অজয় পাল, সাংবাদিক গিয়াসউদ্দিন আউয়াল, সাংবাদিক ও সংগঠক মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান, সাংবাদিক-কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী সহ অনেক প্রবীণের একান্ত ভালোবাসা পেয়েছি। তাদের বেশির ভাগকে নিয়ে আমি লিখেছি।

অগ্রজ সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের মধ্যে ফরীদ আহমদ রেজা, শাকুর মজিদ, পীর হাবিব, তমিজ উদ্দিন লোদী, মুকুল চৌধুরী, মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, নিজাম উদ্দিন সালেহ, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, এনামুল হক জুবের সহ সিলেটের বেশ কিছু লেখক সম্পর্কে লিখেছি, যারা স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত ও সমাদৃত। যাদের সাথে আমি কোন না কোন ভাবে কাজ করেছি।

এক সময় সিলেটের ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী সংগঠন সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের মূখ্য সংগঠক তথা সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন কবি সোলায়মান আহসান। পরবর্তীতে আমি ছিলাম সেক্রেটারি জেনারেল। চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর কবি আফজাল চৌধুরী। তখন নিয়মিত সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর ছাড়াও বছরে অন্তত ২/৩টি বড় অনুষ্ঠান আমরা করেছি। বাংলা ভাষার প্রধান কবি আল মাহমুদ, সাংবাদিকতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর গিয়াস কামাল চৌধুরী সহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরা অতিথি হিসেবে অংশ নিতেন।

আমাদের সাহিত্যে আদর্শিক অগ্রপথিক ছিলেন আফজাল চৌধুরী। কবি সোলায়মান আহসান ও কবি মুকুল চৌধুরী ছিলেন আফজাল চৌধুরীর প্রাণপ্রিয়। পরে আমি যুক্ত হলাম। আমরা ছিলাম তাঁর পুত্রসম। তিনি আমার প্রথম উপন্যাস ‘ছায়াপ্রিয়া’র প্রকাশক। আফজাল চৌধুরী একজন সফল সাহিত্যিক হিসেবে শিল্প-সাহিত্যের নানা অঙ্গনে অসংখ্য কালজয়ী রচনা সৃষ্টি করেছেন। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও শিক্ষাবিদ। তার প্রাণস্পর্শী প্রজ্ঞাদীপ্ত বক্তৃতা-ভাষণ ছিল বিরল বিস্ময়। তার কন্ঠের যাদুকরী উচ্চারণে দর্শক শ্রোতা সম্মোহিত ও আকৃষ্ট হতেন। তিনি আধুনিক মুসলিম সাহিত্যের এক মহারাজ। বীরদর্পে বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় সফল বিচরণ করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

কবি আফজাল চৌধুরীর স্বার্থক উত্তরাধিকার হিসেবে কবি সোলায়মান আহসান পরিচিতি পেয়েছেন। এই সময়ের অগ্রগণ্য কবি সোলায়মান আহসান নান্দনিক শব্দ প্রয়োগে সর্বদা সিদ্ধহস্ত। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী এক অনন্য সাধারণ লেখক। কবিতার মত গল্প, উপন্যাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কিংবা সাহিত্য সমালোচনায় সমভাবে মননশীল ও বহুমাত্রিক। বিশ্বাসী সাহিত্য বলয়ে তিনি এক বিস্তীর্ণ জলাশয়। আদর্শ জীবনবোধ ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে তার অবদান তুলনারহিত। তার প্রতিবাদী কবিতা সমাজ বিপ্লবের প্রেরণা যোগায়। কবির ভাষায় – ‘মিছিল আসে প্যালেস্টাইন, ল্যাটিন আমেরিকা, আফগান সীমান্ত হতে/ বারূদের গন্ধ শুঁকে শুঁকে মিছিল আসে/ রক্তাক্ত বিক্ষত দেহে ধুঁকে ধুঁকে’’ (মিছিল আসে)।

সব্যসাচী লেখক কবি সোলায়মান আহসান আশির দশকের শেষার্ধে আবিভুর্ত একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দাঁড়াও সকাল বিরূপতা’। এতেই তিনি পাঠক হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। প্রথম গ্রন্থেই সোলায়মান আহসান এক অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা কাব্য গগনে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

শান্তির পক্ষে অনশন কবিতায় সোলায়মান আহসান এক নতুন ধারার কাব্য ব্যঞ্জনা সৃস্টি করেছেন। তিনি লিখেন ‘যতক্ষণ না এই হিংস্র্রতা থামাবে আমি কিছুই ছোবনা/ নারীদের বলে দিচ্ছি- তোমরা জঠরে কোন আদম সন্তান/ জন্ম দেবে না। / নুতন জন্মের কোন সুসংবাদ না/ শিশুর আর্তচিৎকার শোনা যাবে না/ ধরিত্রির উদর চিরে যতো স্রোতধারা নদী-উপনদী বয়ে চলে/ খামোস। তারাও চলা থামিয়ে নিথর হয়ে রবে/ গাছেরা দেবেনা ফল/ মাছেরা কোন বংশ বিস্তারে উজানে যাবেনা’ ।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত দৌলতপুর বিস্ময়কর ঝংকারে বিধৃত হয়েছে তার কবিতায়। ‘তোমার দুরন্তপনায় যে নারীর জীবনে বিষাদ চিহ্ন এঁকে দিলো/ তাকে সুধীজন কিভাবে নেবেন জানি না, তবে/ আমরা কতিপয় কবি তোমার স্মরণ উৎসবে এসে/ স্মৃতিময় জনপদে শুনেছি এক কিশোরীর চাপা কান্নার শব্দ, কবিদের বিশ্বাস করোনা- কবিদের দিয়ো না ভালবাসা/ মনে হলো আমরা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আর/ বাদী দৌলতপুরবাসীর রোষানলে পতিত হবো/ বিলুপ্ত হবে আমাদের অস্তিত্ব/ কিন্তু না, দৌলতপুরবাসীর হৃদয়ের দৌলত আজো/ উপছিয়ে পড়ছে আমাদের জন্যে/ শুনেছি তোমার বাউন্ডেলে জীবনের সবাককালে/ যৌবনের প্রারম্ভিক এ শোক- স্মৃতি পুড়িয়েছে তোমাকে/ আর সেই নারী যার হৃদয়ে তুমিও বেঁচে ছিলে’ (দৌলতপুরে একদিন)

কবি সোলায়মান আহসানের কবিতায় রয়েছে মানবিক মূল্যবোধের গভীর উচ্চারণ, নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ট শব্দাবলী, বিস্তীর্ণ সবুজাভ সার্বভৌম স্বদেশ, নরম রূপালী নদী, মায়াবি বিল, বিজয়ের উল্লাস, পরম সত্তার প্রতি গভীর ঈশকের দহন-দাহন, নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ের অব্যক্ত বেদনার আর্তনাদ এবং জাতিসমূহের স্বাধীনতার দীর্ঘশ্বাস। যে কোন মূল্যে মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে মেনে নিতে হবে কবির আহবান- ‘আসুন আমরা এই মুহূর্তে যুদ্ধ বিরতি মেনে নেই/ যে যার স্থানে/ যে যার সীমানায়/ যে যার পরিচয়ে/ ফিরে যেতে হবে,/ এটাই সভ্যতা বাঁচার একমাত্র উপায়’।

কবি সোলায়মান আহসানের কাব্যদর্শন ও কাব্যকৌশল অসাধারণ। তাঁর রচিত সনেটগুলোও পাঠককে আলোড়িত এবং সম্মোহিত করে – ‘বাঁচাও বাঁচাও বলে শেষ কথা বলে দিয়ে চুপ/ সমুদ্রের অতলান্তে রহস্যেও কোন সে আড়ালে/ স্বপ্নের ঝিনুক গেছে এরপর বিনম্র দাঁড়ালে/ কোজাগরী কেটে গেছে এরপর নিঝুম নিশ্চুপ’ (নক্ষত্রের বিলাসিতা)

কবি সোলায়মান আহসানের ভাষার কারুকাজ, বর্ণনার গতিময়তা, ব্যাখ্যার কৌশল পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমাদৃত। আমাদের সাহিত্য সংসারে শিল্পসমৃদ্ধ কবিতার স্বপ্নময় রৌদ্রোজ্জল ঝলকানি।- ‘এখন সকল পড়ে, মৌন শোকে, তারা আজ নাই/ যারা গড়েছিলো এই সভ্যতার শিরোস্বর্ণতাজ/ আর নয় হিরোশিমা, নাগাসাকি আর নাহি চাই/ শান্তির উদ্যানে এসো শপথে সবল হই আজ’ (হিরোশিমা দিবসে)

সোলায়মান আহসানের কবিতার শরীর যেন এক পাহাড়ি নদী, পাহাড়ের কোল বেয়ে এঁকে-বেঁকে চলছে কোথাও উন্মত্ত আবার কোথাও বা শান্ত। এই নদীর দুই তীরের পাহাড়, বন ও ঝর্ণার সৌন্দর্যে আপনি বিমোহিত হবেন। এই পাহাড়ি নদী উর্বরা করে তুলেছে আমাদের কাব্যাঙ্গন।

‘আমার বুকের মাঝে শিকড় গেড়েছে এক চারা/ একদিন পূর্ণতায় বিকশিত হয়ে শুশোভিত/ সবুজ পাতার ভরে ফুলে ফলে আর পরিমিত/ বাতাসে দেদেলা দোলে ভুলাবে যে পথিকের তাড়া’ (প্রতীকী শব্দমালা)

‘বেঞ্জামিন মলয়সী, নাজিম হিকমত, ভাৎসারোভ/ পাবলো নেরুদা কিংবা গার্সিয়া লোড়কার মতো-/ দেখিনা একজন নজরুলের মতো বিদ্রোহের আগুনে/ সেঁকে তুলতে শীতার্থ জনতাকে/ কিংবা ফররুখের মতো বিশ্বাসকে আলিঙ্গন করে/ অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সত্যের জয়গান গাইতে’ (কবি)

সোলায়মান আহসান একাধারে কবি, গল্পকার, উপন্যাসিক ও সাংবাদিক। তার প্রতিটি সৃষ্টি অনবদ্য। এপর্যন্ত তার ৮টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ২টি গল্পগ্রন্থ এবং ৮টি কিশোরগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সাঁতটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বেছে বেছে দুইশত ছাব্বিসটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। এগুলো পাঠক মহলে ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হয়েছে। বৈচিত্রময় কবিতার মধ্যে রয়েছে আদির্শিক, আধুনিক ও রোমান্টিক কবিতা। মানবিক মূল্যবোধের শৈল্পিক উচ্চারণ। বহুমাত্রিক কাব্য সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন।

কবি সোলায়মান আহসান কবিতার শূদ্ধতা ও সময়ের বাস্তবতা নিয়ে বিভিন্নভাবে আলোকপাত করেছেন। সাহিত্য বিষয়ক লেখাসমূহ পাঠকের কাছে মহার্ঘ্যের মতো। বর্তমান সময়ের কবিতা নিয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে – আধুনিক কবিতা খুব সুসময়ে আছে এমনটা বলার মতো বেশি উদাহরণ কাছে নেই। ভাষা বিবর্তনশীল। সাহিত্যও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। এই এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে থাকে ধারণ এবং বর্জনের প্রক্রিয়া। গোটা পৃথিবী যখন তথ্যপ্রবাহে নিকটতর এবং সহজ হয়ে পড়ল, তখন থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির আদান-প্রদানের হিড়িক পড়ে গেলো। এর ফলে বিশ্বজুড়ে নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির মৌলিকত্ব টিকিয়ে রাখার এক প্রচেষ্টাও স্পষ্টতর হলো। যদিও কেউ কেউ মনে করে এসব গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টা স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটতে থাকে, কিন্তু তা হয় না। প্রবেশ-অনুপ্রবেশের বিষয়, আরোপ-বহিষ্কার, সাহিত্য-সংস্কৃতির একটি চলমান অভিযোগ থাকেই।

কবি সোলায়মান আহসান বলেন, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আমরা যদি লক্ষ করি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) থেকে যে আধুনিক যুগের শুরু যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) হাতে পুষ্পপল্লবিত হয়ে বিস্তারিত, তাও কয়েক দশকে নানা বিবর্তনের পথে এগোতে হয়েছে। ত্রিশের দশকে এসে রীতিমতো হোঁচট খেতে হয়েছে। কোনটা আধুনিক? এমন বিপ্রতীক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথকে প্রমাণ দিতে হয়েছে চলমান ‘আধুনিক’ ধারাকে উপেক্ষা করে নয়, খানিকটা বরণ করার মাধ্যমেই। এ সম্পর্কে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে/ তুমি বিচিত্র রূপিনী’। আধুনিকরা সংক্ষেপের পক্ষপাতী, তাই তাঁদের উপলব্ধিও একটু সংক্ষিপ্ত; জগতের মাঝে বিচিত্র তুমি হে। তুমি বিচিত্ররূপিনী। চিত্র দু’টির একটি চিত্র দুঃখের অন্যটি পাপের। দুঃখ ও পাপের যুগ্ম সত্তাকে ইংরেজিতে বারষ বলে অভিহিত করা হয়। তারই বাংলা করেছি অমঙ্গল। দর্শনশাস্ত্রে ও ধর্মশাস্ত্রে ‘প্রবলেম অব ঈভিল’ এক বহু প্রাচীন এবং আজো পর্যন্ত নাছোড়বান্দা সমস্যা। ইদানীংকালে তা সাহিত্যকেও পেয়ে বসেছে। ঠিক দার্শনিক সমস্যাটি নয়, জগতের মধ্যে অমঙ্গলের একচ্ছত্র আধিপত্য। (আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ- আবু সয়ীদ আইয়ুব) ‘পাপ’ ‘অমঙ্গল’ শব্দ অভিধায় ত্রিশের কবিদের উপেক্ষা করার চেষ্টা যত করুন না, রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত তার সাহিত্য সচিব অমিয় চক্রবর্তীকে (১৯০১-১৯৮৬) দিয়ে একটা বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। রবীন্দ্র-বিদ্রোহ থেকে সরে এসেছিলেন প্রথমে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। পরে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) ও অন্যান্য ‘কল্লোল’ এবং ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর কবিরা। এ সম্পর্কে আবু সয়ীদ আইয়ুবের মন্তব্য : “এই নব মূল্যায়নের ধাক্কা বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। ‘কল্লোল’ এবং ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর কবিরাও এক হিসাবে রবীন্দ্র-বিদ্রোহ ছিলেন কিন্তু সে বিদ্রোহ অন্য জাতের।” (আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ পৃষ্ঠা: ০২)

সাহিত্যের ইতিহাসে এমন বাদানুবাদ পরিবর্তনের ধাক্কার ঘটনা সব ভাষায়ই লক্ষণীয়। এসব পরিবর্তন কখনো শৈলী, উপাদান, বিষয়বস্তু, আদর্শ, সঙ্ঘাত ইত্যাদি উপলক্ষে হয়ে থাকে।

সোলায়মান আহসান বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষন করে বলেন, ইংরেজি সাহিত্যেও আমরা এমনটা দেখি। ভিক্টোরীয় যুগের ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে একসময় কিছু কবি বললেন ‘সীমাবদ্ধ পৃথিবী’। তখন প্রস্ত, জয়েস, পাউন্ড, এলিয়ট, ফকনার এঁরা আধুনিক সাহিত্যের এক নতুন রূপরেখা দিলেন। তাঁরা বললেন ‘সময় ও অনুভূতির সম্মিলিত গতিধারায় এক নতুন সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছেন।’ তা কী রূপ- ১. সময় একটি অননুভূতকাল। সময় আমাদের চিন্তার নয়, আমরা সময়ের মধ্যে বিকশিত। আমাদের মনোবিকাশ সময়কে নিয়ে। ২. আমাদের প্রতি মুহূর্তের কর্মে সম্পূর্ণ অতীতের প্রভাব রয়েছে। আমাদের চরিত্র এবং কর্ম সর্বপ্রকার বিগত সত্তার দ্বারা লালিত। ৩. আমাদের চেতনা হচ্ছে স্মৃতি, আমাদের মন হলো স্মৃতি, তাই আধুনিক কাব্য এবং উপন্যাস প্রধানত আত্মব্যাখ্যা। ৪. আমরা নিঃশেষ না হয়ে পরিবর্তিত হই, যতদিন আমরা জীবিত থাকি। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের পরিবর্তন আসে, কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব সর্বক্ষণ একইভাবে জড়িত থাকে সময় এবং স্মরণ। আধুনিক সাহিত্যিক তাই ঘটনা এবং আবেগের স্রোতোধারায় চরিত্রের জীবন নির্মাণ করেন।

কবি সোলায়মান আহসান কবিতায় ‘দুর্বোধ্যতা’ প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনা করে বলেন, আধুনিক কবিতার ব্যাপারে ‘দুর্বোধ্যতা’র অভিযোগও আদি। সত্তর দশকে পত্র-পত্রিকায় কবিতার বিরুদ্ধে কম লেখালেখি হয়নি। বলা হয়েছে আজকাল কবিতা পাঠকের জন্য লিখিত হয় না। এই ‘আজকাল’ কথাটা খুব মজার। কবে থেকে আজকালটা শুরু হলো আর কত দিন ধরে চলছে, সেটা একটা রহস্য। মধুসূদন আমলে তাঁর কবিতা সবাই বুঝতে পারতেন এ কথা যদি কেউ দাবি করেন, তিনি বদ্ধ উন্মাদ। মধুসূদনের কবিতা টীকার সাহায্য ছাড়া আজইবা ক’জন বোঝেন? আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সকলেই বুঝতে পারেন তাঁর রহস্যময় অলৌকিক সব পঙক্তি, তাঁর আত্মানুসন্ধান, তাঁর কৌতুক, তাঁর রূঢ় বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা যারা বুঝতে পারেন কোনো কবিতাতেই যারা হোঁচট খান না, তারা পণ্ডিত পাঠক। এমন দুঃসাহসী দাবি করতে আমাদের তো বুক কেঁপে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভালো লাগে, জীবনের সুখ-দুঃখের আশ্রয় হয়ে ওঠে, এ সবই সত্যি কিন্তু সব বুঝতে পারি এমন দাবি করা মুশকিল। বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) বা সুধীনন্দ্রনাথ দত্তের (১৯০১-১৯৬০) কবিতা সবই যে পানির মতো বুঝে ফেলেছি এমন দাবি করার দরকারটাইবা কী? তাঁদের কবিতার সাথে আমাদের অনুভূতিগুলো মিশে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা তৈরি হয়, এটাই কি যথেষ্ট নয়? যারা কবিতা ভালোবাসেন, কবিতার মাধ্যমে নিজের অনুভূতির সাড়া উপলব্ধি করেন, তাদের পক্ষে কবিতায় সর্বগামী হওয়া খুব আবশ্যক?

কবিতার পাঠক নিয়েও প্রশ্ন আছে সাহিত্যাঙ্গনে। এবিষয়ে কবি সোলায়মান আহসান অগ্রজ কবিদের উদাহরণ দিয়ে বলেন, পঞ্চাশের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান (১৯২৭-২০০৬) একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেই ফেললেন, আমার কবিতা সবার জন্য নয়। তাহলে কার কার জন্য? মানুষের জন্য তো বটে! আর কবিতা যদি শিল্প হয় তবে এর নিশ্চয়ই ভোক্তা আছে, তারা কারা? তাদের সংখ্যা কত? হ্যাঁ, সব কালের জন্য এ কথা সত্য, কবিতা পাঠকের সংখ্যা সীমিত। গদ্যোর মধ্যে গল্প-উপন্যাসের পাঠকই বেশি। আর অন্যান্য মাধ্যম নাটক ও প্রবন্ধের ব্যাপারে ওই এক কথা। আরো সীমিত পাঠক। নাটক মঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত তার ভোক্তা নেই বললেই চলে। আর প্রবন্ধ, বিষয়ভিত্তিক শ্রেণীভেদে পাঠক রয়েছে। সংখ্যায় খুব বেশি নয়। কিন্তু কবিতার তো একটা খোলামেলা পাঠক থাকতে পারে? সে পাঠক কোথায় লুকিয়েছে? সত্যি কথা হলো, কবিতার পাঠক দারুণ পড়তির দিকে। বেশ কয়েক দশক ধরে কবিতার বাজারে আক্রা চলছে। পঞ্চাশের আরেক প্রধান কবি আল মাহমুদের (১৯৩৬-২০১৯) পর পাঠকনন্দিত আর কবি কই? মাঝে সত্তরের দশকে হেলাল হাফিজ ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়’ পঙ্ক্তি রচনা করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর তেমন তুমুল স্পর্শ করার মতো কবির উপস্থিতি দেখি না। হয়তো বলবেন পাঠকপ্রিয়তা কি সাহিত্য-মূল্য বিচারের ব্যারোমিটার? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু পাঠকই যদি না থাকে সাহিত্য কার জন্য লিখবেন? আগে একটা কবিতার বই বারো শ’ কপি মুদ্রিত হতো। এখন দুই শ’ কপিতে নেমে এসেছে। প্রকাশকরা কবিতার বই প্রকাশ করতে পিছটান দেন। কখনো কবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেন। মানে মাছের তেলে মাছ ভাজা। একজন বড় কবির কাছ থেকে খেদ উচ্চারণ করতে শুনেছি পেনশনের গ্রাচ্যুইটির টাকা দিয়েছিলাম কবিতার বই প্রকাশের জন্য, কথা ছিল পরে টাকাটা ফেরত দেবে। এখন বলছে বই বিক্রি করে দেবে। মানে টাকাটা গায়েব। হয়েছেও তাই। কারণ কবি নিজেই গায়েব ধরাধাম থেকে।

কবিতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কারণ উৎপাটন করে কবি সোলায়মান আহসান বলেন, কবিতার আসলে দুর্দিন চলছে। এর পেছনে কারণটা খতিয়ে দেখা দরকার। সাহিত্য সমালোচকদের এ বিষয়ে নজর দেয়ার সময় উপস্থিত হয়েছে। তবে সাদামাটা আমরা যা দেখি, আমাদের কবিতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আমাদের কবিতা কি সাধারণ মানুষের বেদনার কথা বলছে? কবিতা কি বহমান প্রেম-ভালোবাসার নির্ভার আধার হচ্ছে? কবিতা কি জীবন-যন্ত্রণার ভার বহন করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে? কবিতায় মানুষের মুক্তির কথা কতটুকু বলছে? কবিতা কি মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতার বিশ্বের অসহায় মানুষের হৃদয়ের আর্তির কথা বলছে? তাহলে কবিতা কার কথা বলছে? এসব নানা সঙ্গত প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে। কবিতার শৈলী কি অতি ব্যবহৃত হতে হতে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে? কী বলবেন কবি? কবিকেও জবাবদিহিতা করতে হবে না? কবির পাঠকের কাছে দায় থাকবে না? নাকি শুধু বলেই নিষ্কৃতি আমি কবি সুন্দরের গাহি জয়গান। সুন্দরের জয়গান গাইতে হলে অসুন্দরের পৃথিবী থেকে অসুরের হুঙ্কার আগে থামাতে হবে। শুধু বললেই হবে না কবিতাই পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামাতে। মনের কদর্যকে মুছতে হবে কলমের কালিতে কবিতায়। কখনো কলম হবে তরবারির মতো তীক্ষ্ম। এমন শুভ উদ্যোগের অপেক্ষায় কবিতার বিশ্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *