শিশুদের মোবাইল আসক্তি । ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

প্রবন্ধ-কলাম
শেয়ার করুন
এটা অনস্বীকার্য যে, বিজ্ঞান আমাদের প্রভুত উপকার করেছে। জীবন করেছে সুন্দর এবং সাবলীল। সাফল্য দিয়েছে অভাবিত। দিয়েছে সমৃদ্ধি। তবে ঝুঁকিও কম বাড়ায়নি। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রকে বিজ্ঞান এবং এর আবিষ্কার ঋদ্ধ এবং সম্মোহিত করে চলেছে প্রতিদিন। বিজ্ঞান আমাদের নিত্যসঙ্গী। এর ছোঁয়া ব্যতীত মানুষ আজ একদমই অচল। স্থবির। কিন্তু এর অপরিণামদর্শী ব্যবহার আমাদের বারোটাও বাজাচ্ছে নিয়তই। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করবার অবকাশ আমাদের নেই। যখন বিপদ এসে ঘাড়ে চেপে বসছে তখন হাহুতাশ করছি কেবল। তবে দোষ বিজ্ঞানের নয়। দোষ হচ্ছে আমাদের বোকামো এবং কুপমণ্ডুকতার। কপাল পোড়াচ্ছি আমরা নিজেরাই। কিন্তু টের পাচ্ছি না। যখন টের পাচ্ছি তখন সময় আর থাকছে না বললেই চলে।
কথাটা খুলেই বলা যাক: এক-দেড় দশকের ব্যবধানে মায়ের কোল থেকেই চোখের রোগ মায়োপিয়া বা চোখের ক্ষীণদৃষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের বুকের ধন শিশুরা। আমাদের কর্মজীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে সন্তানদের হাতে সহজলভ্য হচ্ছে কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ট্যাব। আর এসবের অতিরিক্ত স্ক্রিন এক্টিভিটি বড়দের চেয়ে শিশুদের চোখে পাঁচগুণ বেশি ক্ষতি এবং আক্রান্ত করছে নানা ধরনের রোগে।
নামটা নির্ঝরা। মাত্র ৬ বছর বয়স ওর। মায়োপিয়ায় আক্রান্ত মেয়েটি। দূরের জিনিস ঝাপসা দেখে। মাঝেমাঝেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হন পঞ্চম শ্রেণির এ শিক্ষার্থীকে নিয়ে ওর মা-বাবা। ডাক্তাররা বলছেন, দিনের উল্লেখযোগ্য সময় স্মার্টফোনে চোখ রেখেই ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে নির্ঝরা।
শিশুরা বলছে, ‘ইউটিউব দেখি, গেমস খেলি। বিশ্ব সম্পর্ক জানি। স্মার্টফোনে এগুলো বেশি দেখি।’
বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, মহানগরীর একটি স্কুলের একটিমাত্র শ্রেণিতে ‘১৯ জন শিক্ষার্থীর ৭ জনই কোনও না কোনও চোখের সমস্যায় ভুগছে। তবে, আক্রান্তরা ছাড়াও অধিকাংশের সময় কাটে ফেসবুক, ইউটিউব ও ভিডিও গেমসে।’
শিশুরা বলছে, ‘দূর থেকে বোর্ডের লেখা দেখতে পারি না। ডাক্তারের কাছে যাবার পর তাঁরা বলেছেন, কাছে থেকে টিভি না দেখতে। আর মোবাইল ফোনের বেশি গেমস না খেলতে।’
উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে, এক-দেড় দশক আগেও ৮ থেকে ৯ বছরের পর শিশুরা আক্রান্ত হতো এরোগে। বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছর বয়সেই ওরা আক্রান্ত হচ্ছে এতে। প্রথম থেকেই শিশুদের মোবাইল, ট্যাব ও ভিডিও গেমসের প্রতি চরম আসক্তি ওদের চোখের ছানি, রেটিনার নানা সমস্যাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
শিশুদের চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী সাব্বির আনোয়ার গতবছর সময় নিউজকে বলেছিলেন, ‘শিশুদের মাঠের খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ। সূর্যের আলোতে তারা বেরোয় না। যেকোনও ইলেকট্রনিক্সে ওদের আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে। এগুলোর কারণে মায়োপিয়া বাড়ছে।’
বংশগত কারণ থাকলেও স্ক্রিন একটিভিই মায়োপিয়ার অন্যতম কারণ। তবে এ সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্য অধিদফতর কেবল স্বল্পকিছু বিদ্যালয়ে চক্ষু পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এতদিন ছিল না এ সুবিধে। আমরা চেষ্টা করছি প্রত্যেক উপজেলায় এ সুবিধে পৌঁছে দেবার।’
মায়োপিয়ায় আক্রান্তদের দৃষ্টি চশমা দিয়েও শতভাগ ফেরানো সম্ভব নয়। তাই অন্তত ৬ ফুট দূর থেকে টিভি ও ৩০ সেন্টিমিটার দূর থেকে মোবাইল বা ট্যাব দেখবার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমার এক পৌত্র রাফি। বয়স এখন ৫ বছর। ও কী করে জানেন? মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে অথবা কার্টুন দেখতে দেখতে ঘুমোয়। এভাবে খায়ও। আবার ঘুম থেকে জেগেই মোবাইল হাতে নিয়ে বসে। তবে এবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। মায়ের বোকা খেয়ে স্কুল থেকে দেয়া হোমওয়ার্ক কোনওরকমে শেষ করেই আবার মোবাইল হাতে নেয়। ওর বাবা সকাল ৭ টায় অফিস চলে যায়। আসে রাত ১০/১১ টায়। বউমাও ছেলে সামলানোর উপায় পেয়েছেন এ স্মার্ট মোবাইল। আমি বাচ্চাটির মোবাইলের প্রতি ঝোঁক নিয়ে দিনে কয়েকবার সাবধান করি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বউমা মাঝেমধ্যে ছেলের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেন। ধমকও দেন। মারের ভয়ও দেখান। কিন্তু তেমন লাভ হয় না। আমার মোবাইল নিয়েও শিশুটি টেপাটেপি শুরু করে। আমি তখন তাড়াতাড়ি ওকে নিবৃত্ত করতে উদ্যোগী হই। কিন্তু কাজটি যে কত কঠিন তা ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে বোঝানো বেশ মুশকিল। আমার আশঙ্কা দৃঢ়তর হচ্ছে, এ শিশুটিও ক্ষীণদৃষ্টিরোগে আক্রান্ত হতে পারে। আল্লাহ যেন রহম করেন অবুঝ শিশুটির প্রতি।
মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টিরোগ ছাড়াও একনাগাড়ে স্মার্টফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারের স্ক্রিনে নজর রাখলে বা এসব ব্যবহার করলে আরও নানাবিধ শারীরিক সমস্যা হতে পারে। রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ক্যানসারের মতো মারণরোগও হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরাই জানাচ্ছেন। আর এর প্রভাব শিশুদের ওপর পড়ে বড়দের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তাহলে আমরা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের কী ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিক্ষেপ করছি তা ভেবে দেখবার অবকাশ অনেকেরই নেই। তাই এখনই শিশুদের স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমাবার উদ্যোগ নিতেই হবে। নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারা থেকে বিরত না থাকলে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের এবং ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য।
শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত। আগামিদিনে এরাই দেশ পরিচালনা করবে। জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। তাই এদের কেউ ক্ষীণায়ু, বিকলাঙ্গ, স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন কিংবা রেডিয়েশনপ্রভাবিত হয়ে বড় হোক, তেমনটা আমরা কেউ প্রত্যাশা করি না। করতে পারি না। কিন্তু আমাদের অলক্ষ্যেই সোনামণিরা ক্ষীণদৃষ্টিসহ নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। ফলে সুস্থ জাতি হিসেবে দৃঢ় ভিত্তির ওপর আমাদের বংশধররা দাঁড়াবে তা যেন ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানের কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যবহারের ফলে দুর্বল এবং প্রতিবন্ধী জাতি হিসেবে আমাদের শিশুরা গড়ে উঠছে। এটা আমাদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। অথচ আমরা সচেতন হলে এমন উদ্বেগ থেকে বাঁচতে পারি।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোনে গেম বা কার্টুনে শিশুরা পড়ে থেকে চোখের মায়োপিয়া সৃষ্টি করছে। স্বল্পদৃষ্টিশক্তি নিয়ে বড় হওয়া শিশুরা ভবিষ্যতে মারাত্মক চোখের অসুখে ভুগতে পারে। এমনকি বয়স বাড়লে অন্ধত্বের শিকার পর্যন্ত হতে পারে। মায়োপিয়া বেড়ে এমনও হয় যে, চশমায় আর কুলোয় না। তাই যেভাবেই হোক বাচ্চাদের মোবাইলের নেশা ছাড়াতেই হবে। বিদেশে শিশুদের হাতে মোবাইল দেয়া হয় না। আমরা দুধের শিশুদের হাতেও মোবাইল তুলে দিয়ে তৃপ্ত হই। এতে যে শিশুটির চোখের বারোটা বাজাচ্ছি সেদিকে খেয়াল দেই না।
স্মার্ট মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার এসব বিজ্ঞানের অবদান। বিশেষত স্মার্টফোন ব্যতীত আধুনিক সামাজিক যোগাযোগ কল্পনাতীত। তবে এর অপব্যবহার কাম্য নয়। বাচ্চাদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া অপব্যবহার ব্যতীত কিছু নয়। এমন অপরিণামদর্শিতার খারাপ ফল সম্পর্কে এতোক্ষণ যা আলোচনা হলো তার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আমরা উপলব্ধি করেছি। এরপরও যদি আমাদের বিবেক জাগ্রত না হয়, আমরা যদি আমাদের শিশুদের স্বল্পদৃষ্টি, অন্ধত্ব কিংবা রেডিয়েশনের মতো প্রাণঘাতী ব্যাধিগ্রস্থ করতে না চাই, তাহলে শিশুদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেবার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীনতা থেকে আমাদের বিরত থাকতেই হবে। এর কোনও বিকল্প নেই।
এক বছর ৩ মাস বয়সের নুহাদ। আমার দৌহিত্র। সে কেবল আম্মা, আব্বা, নান্না, দাদা কোনওরকমে বলতে পারে। সেও মোবাইল টান মেরে হাতে নেয়। টেপে। টিভির রিমোট নিয়ে মোবাইলের মতো টেপাটেপি শুরু করে দেয়। এ আসক্তি যে কতো মারাত্মক হতে পারে তা আমরা অনেকেই ভাবি না। ভাবতে চাইও না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। আমাদের শিশুরা মায়োপিয়ার মতো স্বল্পদৃষ্টি রোগ নিয়ে বেড়ে উঠছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *