ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
সম্প্রতি সিলেট, বরিশাল ও গাজিপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন হয়ে গেল। অতীতে আরও অনেক সিটি ও পৌরসভার মেয়র নির্বাচন হয়েছে। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচিত হওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নি:সন্দেহে এক ইতিবাচক দিক। একটি বিষয় বেশ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি মেয়র নির্বাচন আসলেই ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় অহরহ হেডিং দেন “কে হচ্ছেন নগর পিতা?” নির্বাচনের পর হেডিং দেন “ওমুক (নির্বাচিত মেয়র) হলেন নগর পিতা”।
মেয়র নির্বাচিত হন জনগণের সেবা করার জন্য। তিনি জনগণের সেবক, খাদেম বা পাবলিক সার্ভেন্ট। মূলত: জনগণের সেবা করার ওয়াদা করে ভোট চেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তাকে কেন “নগর পিতা” বলতে হবে? কিছু মিডিয়া ও সাংবাদিক এই উদ্ভট সংস্কৃতি চালু করেছেন আমাদের দেশে। এই সম্মোধনের না আছে কোন আইনি ভিত্তি, না আছে সাংবিধানিক ভিত্তি। আচ্ছা, কোনো মহিলা মেয়র প্রার্থী যদি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হোন তাকে কি “নগর পিতা” বলবেন? নারায়ণগঞ্জের নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে কি “নগর পিতা” বলেন?
ভোটে নির্বাচিত হলেই যদি কাউকে পিতা বলতে হয়, তাহলে তো সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদেরকে “ইউনিয়ন পিতা” বলতে হবে, সব উপজেলার চেয়ারম্যানদেরকে “উপজেলা পিতা” বলতে হবে, সব মেম্বারদেরকে/কমিশনারদেরকে “ওয়ার্ড পিতা” বলতে হবে, সব এমপিদেরকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার পিতা বলতে হবে।
আর তাতে করে দেশ পিতায় ভরে যাবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিকে পিতা ডাকার এই উদ্ভট সংস্কৃতির দরকারই বা কী? আর সব জায়গায় পিতা কেন খুঁজতে হবে? ভোট দিয়ে ভোটাররা পিতা বানায় না, বানায় প্রতিনিধি বা সেবক। আমাদের এই উদ্ভট মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নগরী লন্ডনের বর্তমান মেয়র সাদিক খান সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। দু’টার্ম ধরে মেয়র আছেন। অতীতে ছিলেন বরিস জনসন এবং কেন লিভিংস্টন দু’টার্ম করে। বরিস জনসন পরবর্তিতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারা যখন মেয়র ছিলেন কই কেউ তো তাদেরকে কখনও বলেনি “নগর পিতা” (City Father বা Father of the City)। বিশ্বের আরেক অন্যতম প্রধান ও আধুনিক নগর নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র প্রতি চার বছর পরপর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হোন। কোনো দিন শুনিনি ইয়র্ক সিটির মেয়রকে “নগর পিতা” বলতে। আমাদের দেশে এই দৈন্যদশা কেন?
“নগর পিতা” সম্মোধনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মেয়রকে তার চিন্তায়, মননে ও কর্মে পরোক্ষভাবে ও অবচেতন মনে এক অনাকাঙ্খিত ও অযাচিত অহংকার বা অনুভব (Feeling) ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তিনি সেবকের পরিবর্তে নিজেকে ভাবতে শুরু করেন অন্য কিছু। আর এ থেকেই আস্তে আস্তে শুরু হয় তার মধ্যে একগুয়েমিতা, একনায়কত্ব, জবাবদিহীতার ঊর্ধ্বে ভাবার প্রবণতা। এগুলো গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই এই উদ্ভট মানসিকতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিৎ।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।