লেখকদের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে প্রহেলিকাময় ।। ড. আসিফ নজরুল

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

লেখকদের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশে প্রহেলিকাময় বিষয়। এখানে অনেকে সত্য কথা বলতে চাননা, কেউ কেউ সত্য বলেন না, কেউ বলেন বিভ্রান্তিমূলকভাবে। যেমন: ২০তম সংস্করণ বের হয়েছে এটা আমরা ফাটিয়ে বলি, কিন্তু মুদ্রণসংখ্যা গোপন রাখি। আবার লেখকের পারস্পরিক পিঠ চুলাকানো গ্রুপের মাধ্যমে একেকজন শক্তিমান বা জনপ্রিয় লেখক বনে যাই।

আমার কথা হচ্ছে, শক্তি না হয় মাপা যায় না, জনপ্রিয়তা তো মাপা যায়। এটা নিয়ে আমাদের দেশে এতো লুকোচুরি বা মিথ্যেচার কেন? অথচ বিদেশে এগুলো একদম প্রকাশ্য বিষয়। এমনকি বইয়ের কভারে লিখে দেওয়া হয় ‘ওভার এতো মিলিয়ন সোল্ড’। কোন সংস্করনে কতো ছাপা হলো তাও বলা হয় বইয়ের ইনারে।

আমার মতে এগুলো পাঠকরা পরিস্কারভাবে জানতে পারলে তাদের বই বাছাইয়ে সুবিধা হয়, প্রতারণাপূর্ণ প্রচারণা থেকে রক্ষা পায়। লেখকরা প্রকৃত ফিডব্যক পান।

এতোকিছু বললাম লেখক মাহবুব মোর্শেদের প্রশংসা করার জন্য। কয়েক মাস আগে সে কাছাকাছি উদ্দেশ্যের একটি কাজ করে, দেশের দুই শতাধিক জীবিত কথাসাহিত্যিকদের নিয়ে জরিপ আয়োজনের মাধ্যমে। এদের তালিকা করে মাহবুবের ফেসবুকে জানতে চাওয়া হয়, এদের মধ্যে আপনি কার কার বই পড়েছেন? খেয়াল করে দেখবেন তিনি জানতে চেয়েছেন বই কেনার কথা না, বই পড়ার কথা।

মাহবুবের এই জরিপে ব্যাপক অংশগ্রহন ছিল (১৮ হাজার ভোট), এখানে কারচুপির সুযোগ ছিল না (১ বারের বেশী বা ফেসবুক একাউন্ট ছাড়া ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না), এবং এটি ছিল প্রচন্ড রকমের স্বচ্ছ (ভোট লাইভ দেখা যাচ্ছিল)।

আমার জানামতে এতো বিস্তৃত, সৎ, স্মার্ট ও আকর্ষনীয় পাঠক জরিপ বাংলাদেশে এর আগে কোন ব্যক্তি দুরের কথা, প্রতিষ্ঠানও করেনি। এটা যে প্রায় সঠিক একটা চিত্র তুলে এনেছে তাও আমার মনে হয়েছে। তবে এই জরিপ আমাকে কিছু লেখকের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে নতুন ধারনাও দিয়েছে। যেমন: শাহাদুজ্জামান বা মামুন হুসাইনের বই এতো মানুষ পড়েছে আমার ধারনা ছিল না। আবার প্রচার প্রচারণা শুনে আমি ভাবতাম কোন কোন লেখক আরো বেশী পাঠকপ্রিয়।

যাই হোক, এই জরিপের একমাত্র সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এটি প্রধানত মাহবুব মোর্শেদের ফেসবুক বন্ধু আর ফলোয়ারদের ভোট নির্ভর। আর বিউটি হচ্ছে সেখানেও সে নিজে আছে ১১ নম্বরে। তারমানে হচ্ছে ভোটাররা এখানে অন্ধ বিবেচনায় ভোট দিয়েছেন তা বলার সুযোগ কম।

মাহবুবকে অনেক ধন্যবাদ এতো কষ্টসাধ্য কাজটি করার জন্য। আমার জানামতে এই জরিপে এমনকি ভোটার হিসেবেও অনেক লেখক অংশ নিয়েছেন। অন্তত আমরা কি সবাই তাকে একবার ধন্যবাদ জানাতে পারি?

জরীপের ফলাফল: ১১ জুন সকাল ১১ পর্যন্ত মাহবুবের জরিপে বেশী ভোট পাওয়া প্রথম ১০ জনের নাম ও ভোট ছিল এমন: ইমদাদুল হক মিলন ১১২৯, আনিসুল হক ৯৯৬, সেলিনা হোসেন ৯৩৮, শাহাদুজ্জামান ৮৯৭, আসিফ নজরুল ৬৯৪, হরিশংকর জলদাস ৫৮৮, জাকির তালুকদার ৪৪৪, তসলিমা নাসরিন ৪৩৩, সাদাত হোসাইন ৪১৮, মঈনুল আহসান সাবের ৪০৯।

কমপক্ষে ২০০ ভোট যারা পেয়েছেন তারা হচ্ছেন: মাহবুব মোর্শেদ ৪০০, হাসনাত আবদুল হাই ৩৮৫, মোহাম্মাদ নাজিমউদ্দিন ৩৪৬, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ৩৪১, আনোয়ারা সৈয়দ হক ৩৩৮, মশিউল আলম ৩২০, মামুন হুসাইন ৩০০, মাসরুর আরেফিন ২৯৩, নাসরীন জাহান ২৭৫, আহমাদ মোস্তফা কামাল ২৫২, স্বকৃত নোমান ২১৬, ইমতিয়ার শামীম ২১০, অদিতি ফাল্গুনী ২০৩।

এছাড়া শতাধিক ভোট পেয়েছেন মানস চৌধুরী, শিবব্রত বর্মণ, মোহিত কামাল, সালাহউদ্দিন শুভ্র, কাজল শাহনেওয়াজ, মোজাফফর হোসেন, সুমন রহমান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, জিয়া হাশান, মঞ্জু সরকার, আলভী আহমেদ, প্রশান্ত মৃধা, রাখাল রাহা, সেলিম মোরশেদ, শাহনাজ মুন্নী, রায়হান রাইন, সুহান রিজওয়ান, চঞ্চল আশরাফ, বাদল সৈয়দ, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, আন্দালিব রাশদী, আফসানা বেগম, জান্নাতুন নাঈম প্রীতি, আশিফ এন্তাজ রবি, পাপড়ি রহমান, সুমন্ত আসলাম, পারমিতা হিম ও মনি হায়দার।

(এই জরিপে জাফর ইকবাল কেন কম ভোট পেলেন? মাহবুবের নিজের ব্যাখা হচ্ছে, “মুহম্মদ জাফর ইকবাল মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য লেখেন। জরিপটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে আয়োজিত হলে নিশ্চয়ই তিনি শীর্ষে থাকতেন।”)

* ড. আসিফ নজরুল লেখক-ঔপন্যাসিক, রাজনীতি বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *