সাঈদ চৌধুরী
আল-কোরআন একাডেমি লন্ডনের উদ্যাগে ৩দিনব্যাপী ইসলামি বই মেলা শুরু হবে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর। এটাকে আন্তর্জাতিক মানে ঢেলে সাজানোর জন্য বিশেষ প্রস্তুতি সভা শুক্রবার (২৬ জুলাই ২০২৪) ইস্ট লন্ডনের নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির ফাউন্ডার চেয়ারম্যান লেখক ও গবেষক ড. হাফিজ মুনির উদ্দিন আহমদ।
একাডেমির ১১তম বই মেলা হিসেবে এবারে থাকবে বিশেষ আকর্ষণ ও নান্দনিকতা। সময়ের চাহিদা পুরণে এ বছর ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার এবং মান সম্পন্ন গ্রন্থের ব্যাপক সমাহার ঘটাতে আমাদের সর্বাত্বক প্রয়াস অব্যাহত আছে।
জুম্মাবার পত্রিকার সম্পাদক এম এ মামুনের পরিচালনায় পরামর্শ সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন লেখক ও সংগঠক মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ, কবি-সাংবাদিক শিহাবুজ্জামান কামাল, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী শাহীন, ড. হাফিজ মুনির উদ্দিন আহমদের মেধাবী পুত্র এই প্রকল্পের কর্ণধার ইকবাল আহমদ, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব আব্দুল হামিদ প্রমুখ।
সভায় গত ১০টি মেলার পর্যলোচনায় বলা হয়, অতীতে ঢাকা ও কলকাতার নামি-দামি প্রকাশকদের বইয়ের পাশাপাশি লন্ডনের প্রকাশকদের অনেক গ্রন্থ পাঠকদের মুগ্ধ করেছে। ফলে আগের বছরে চেয়ে পরের বছর আরো অধিক সংখ্যক মানুষ অংশ নিয়েছেন। প্রথম বছর থেকে দশম বছরে বই প্রেমিকদের অংশ গ্রহন আমাদের প্রত্যাশার পারদ স্পর্শ করেছে।
এছাড়া বই মেলা উপলক্ষে প্রবাসী লেখক সম্মাননা অনুষ্ঠানের ফলে মেধাবী ও মননশীল লেখকদের আস্থা ও ভালোবাসার প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে আল-কোরআন একাডেমি লন্ডনের এই বই মেলা। কোরআন গবেষক ড. মুনীর উদ্দীন আহমদ মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, গত ১২ বছরে একাডেমির উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী ২৫টি দেশে ১৮টি ভাষায় ১৮লক্ষ কপি কোরআন বিতরণ করা হয়েছে।
আমরা সকলেই জানি, বই মানুষের প্রকৃত বন্ধু। মহাবিশ্বের পরতে পরতে লুকায়িত ঐশ্বর্য্য ভান্ডারে হাত বাড়াতে হলে বই প্রেমিক হতে হয়। এক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ আল কোরআন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতর মুজিজা বা অলৌকিক বিষয়। জীবনের সঠিক পথ অনুসন্ধানী মানুষের জন্য এক মহাবিস্ময়। ভাষা বিজ্ঞানীদের কাছে সেরা ভাষাশৈলী। শিল্প রহস্য সন্ধানীদের জন্য অনুপম ভাণ্ডার।
কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষেরা এ নিয়ে গবেষণা ও সাধনা করে চলেছেন। যুগ যুগ ধরে তারা হয়েছেন আল কোরআনের প্রাসাদ গুনে তৃপ্ত, পরিতৃপ্ত। জীবনের উৎপত্তি, পরিণতি এবং জগতের রহস্য খুঁজতে গিয়ে কোরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন বহু মনীষী। বর্তমান সময়ে পবিত্র কোরআন নিয়ে যারা কাজ করছেন, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে কোরআন পৌছে দেয়ার কাজ করছেন, তাদের অন্যতম নীরব সাধক ড. হাফিজ মুনীর উদ্দীন আহমদ। তিনি সস্ত্রীক এই সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ড. মুনীর ও তার সহধর্মীনি খাদিজা আখতার রেজায়ী দু‘জনই শক্তিমান লেখক ও অনুবাদক। প্রায় তিন দশক ধরে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট, আপনজন। ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ও অনুসন্ধানী লেখা আমাকে মুগ্ধ করে। তাদের দাতব্য কর্মকান্ড ও প্রকাশনা জগতে ব্যাপকতা লাভের ক্ষেত্রে আমি সবসময় সাধ্যমত সমর্থন ও প্রচারের প্রয়াস পেয়েছি। দেশে থাকা অবস্থায় ১৯৯৫ সালে ইসরা ইন্টারন্যাশনাল প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি আমাদের সাথে সিলেট অঞ্চলে অনেক সেবামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। ২০০০ সালে লন্ডন আসার পর থেকে আমরা আরো কাছে চলে আসি। সাহিত্য-সাংবাদিকতার পাশাপাশি আল কোরআনের চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে হয়েছি সরব ও সক্রিয়।
দীর্ঘ সাধনার ফলে ড. মুনীর মহাগ্রন্থ আল কোরআনের শিল্প-শৈলী বিশেষ করে আরবি অলংকার শাস্ত্রের ইলমুল মাআনি ও ইলমুল বদি দুটি শাখাতেই বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেছেন। তিনি কুরআন গবেষণা ও বিভিন্ন ভাষায় তা অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপী বিতরণের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন আল কোরআন একাডেমি লন্ডন। বহু ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করে বিভিন্ন দেশে অমুসলিমদের মাঝে তা বিতরণ করে চলেছেন অব্যাহত গতীতে।
সুলেখক ও সফল অনুবাদক ড. হাফিজ মুনীর উদ্দীন আহমদের উল্লেখযোগ্য অনুবাদ কর্মের মধ্যে রয়েছে তাফসীর ইবনে কাছীর, তাফসীরে ওসমানী, সাইয়েদ কুতুব শহীদের কোরআনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা, কোরআনের পাতায় নারীর অধিকার, মায়ালেম ফীত তরীক, বিস্ময়কর গ্রন্থ আল কোরআন, ইসলামী আন্দোলন সংকট ও সম্ভাবনা, শায়খ ইউসুফ আল কারদাওয়ীর ফতোয়া, সাইয়েদ ওমর তেলমেসানীর শহীদে মেহরাব হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.), হযরত মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শফীর মুসলিম ইতিহাসের গৌরবগাথা, ডক্টর মোস্তফা আস সাবায়ীর স্বর্ণযুগে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ, সাইয়েদ মানাযির আহসান গিলানীর হাজার সাল পহলে, শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানীর মুক্তো দিয়ে গেথেছি মালা সহ অনেক মূল্যবান গ্রন্থ।
ইসলাম যে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ তা সাবলীল ভাষায় তুলে ধরে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন ড. হাফিজ মুনীর উদ্দীন আহমদ। তার সাড়া জাগানো গ্রন্থ সমূহের মধ্যে মনীষীদের কোরআন গবেষণা, কোরআনের অভিধান, কোরআন মাজীদ সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, কোরআনের পাতায় হালাল হারাম ও আদেশ নিষেধ, কোরআন পরিচিতি, হাদীস পরিচিতি, ঈমান, আল্লাযীনা আমানু, সকলি তোমার দান, আমার নেতা তোমার নেতা বিশ্বনবী মোস্তফা, সালমান ফারসী (রা:), বেলাল হাবশী (রা:), সোহায়ব রুমী (রা.), লোকমানের উপদেশ, সৌভাগ্যবান মানুষের গল্প, আলোকিত মানুষ, হতভাগ্যবান মানুষের গল্প, দজ্জালের পা, সিন্ধান্ত করার এখনি সময়, যদি এমন হতো, সাক্ষীর কাঠগড়ায় নারী, দুর্যোগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই, খোতবাতে মোহাম্মদী, নামায কখন কিভাবে, নামায কি ও কেন, আল্লাহর সাথে পরিচয়, আদব কায়দা, প্রজন্মের প্রহসন, নাম সমাচার, তালাকের পাঁচালী, বিয়ে নিয়ে ইয়ে, নাইন ইলেভেন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
কোরআন প্রেমিক ড. মুনীর একজন দায়ী ইলাল্লাহ। কোরআনই তার ধ্যান-জ্ঞান, কোরআন অন্তঃপ্রাণ মানুষ তিনি। তার মত আরো কয়েকজন বন্ধু আমাদের আছেন। কোরআনে বর্ণিত ঘটনাবলী আলোচনায় আমরা হারিয়ে যাই ইতিহাসের অন্য এক অধ্যায়ে। জীবনের দীর্ঘ সময় যারা ব্যয় করেছেন উপনিবেশিক ও আধুনিক পুঁজিবাদের অনৈতিক ইতিহাস নিয়ে, তাদের সামনে আমরা শান্তির পথ ও মুক্তির ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। আর এ কাজে ড. মুনীর আমাদের সবার শীর্ষে। তিনি লড়ে চলেছেন অক্লান্ত বীরের মত।
আমরা যখনই একত্রিত হই, কোরআনুল করীম নিয়ে আলোচনা হয়। কোরআনের সাহিত্য ও ভাষাগত দিক, ছন্দময় আয়াত, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক, সমাসোক্তি ইত্যাদি আলোকপাত করি, যা দুনিয়ার সকল ভাষা গবেষকদের সামনে এক মহা চ্যালেঞ্জ। আজো কেউ কোরআনের আয়াতের মতো একটি আয়াত সৃষ্টি করে দেখাতে পারেনি।
আল কোরআনের অপরাজেয় সাহিত্য সৌকর্য ও অপ্রতিরোধ্য প্রভাব উপলব্ধি করে বহু অমুসলিম ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন। কোরআনের তিলাওয়াত শুনে হয়েছেন অশ্রুসিক্ত। এক একটি সুরা ও আয়াতের অনন্য উপস্থাপনা, অর্থের ব্যাপকতা, প্রার্থনার গভীরতা, ফুল ও ফলের বাহারি বিশ্লেষণ, ভূপৃষ্ঠের সম্পদ আর আকাশের তারকারাজির বর্ণনা, সর্বোপরি মহান স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রাণময় ভাষা কুরআনকে শ্রেষ্ঠতর মুজিজা বা অলৌকিক বিষয় হিসেবে করে রেখেছে অমর ও অক্ষয়। সংলাপ সাহিত্য-সাংস্কৃতি ফ্রন্ট সহ আমাদের সামগ্রীক সাহিত্য সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে ড. মুনীর একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তার মত যারাই কোরআন নিয়ে সাধনা করেছেন, তারাই হয়েছেন ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয়।
পুনশ্চ: লন্ডনে এবারের ৩দিনব্যাপী ইসলামি বই মেলায় নতুন প্রজন্মকে অধিকতর সম্পৃক্ত করতে থাকছে বিশেষ আয়োজন। ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে লেখক ও তাদের গ্রন্থের ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা রাখা হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোটি কোটি মানুষের অংশ গ্রহনের ফলে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। প্রযুক্তির বদৌলতে জগতব্যাপী দ্রুত অনেক পরিবর্তন এসেছে। সারাবিশ্ব এখন সত্যিকার অর্থে গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম। বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। গণমাধ্যমকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি। ছোট্ট একটি সেলফোন হয়ে উঠেছে সবকিছুর চালিকা শক্তি। এই বাস্তবতায় বই মেলাকে নতুনত্ব ও নান্দনিকতা প্রদানে চাই সকলের আন্তরিক অংশ গ্রহন।
* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।