বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ১০ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে ফ্রাইডে আড্ডা। ল’ম্যাটিক সলিসিটর্স আয়োজিত ব্যতিক্রমী আড্ডায় ইউরোপে নজরুল চর্চা শীর্ষক আলোচনা, নজরুলের গান ও কবিতা আবৃত্তি শেষে মজাদার মাছ-ভাত ও সাতকড়া-গোস্ত পরিবেশন করা হয়।
আনন্দঘন পরিবেশে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংষ্কৃতি চর্চার প্রয়াসে এই ধরণের আড্ডার যাত্রা হয়েছে প্রায় দু’বছর আগে থেকে। প্রতিমাসের কোন এক শুক্রবারে নতুন নতুন বিষয় কেন্দ্রিক আলোচনা হয়। সেই সাথে পরিবেশিত হয় দেশীয় খাবার।
আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র পার্টনার ও প্রিন্সিপাল সলিসিটর ব্যারিষ্টার মোঃ আসাদুজ্জামান উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠান সূচনা করেন। ব্যারিষ্টার আরিফ চৌধুরীর উপস্থাপনায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন ব্যারিষ্টার খালিদ ইয়াহইয়া। ‘ইউরোপে নজরুল চর্চা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক সাঈদ চৌধুরী। আড্ডা বিষয়ক বক্তব্য রাখেন সুরমা’র কুটনৈতিক সম্পাদক আখলাক আহমদ, আবৃত্তি বিষয়ক আলোচনা করেন সাংবাদিক তৌহিদ শাকীল।
কবি নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেন ল’ম্যাটিক সলিসিটর্সের পার্টনার ও লিগ্যাল কনসালটেন্ট সাঈদ হাসান, সলিসিটর মামুন আহসানুল মজিদ, ব্যারিষ্টার বি এম ইকতেহাদুল ইসলাম, সাংবাদিক ড. নাজমুল হোসেন প্রমুখ।
নজরুলের গান পরিবেশন করেন শিল্পী মাহবুবুর রহমান মুয়াজ এবং ব্যারিষ্টার ও সলিসিটর দেওয়ান মাহদী।
নজরুল জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন ল’ম্যাটিকের অন্যতম পার্টনার ও লিগ্যাল কনসালটেন্ট ব্যারিষ্টার ফখরুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার ব্যারিষ্টার ও সলিসিটর সালাহ উদ্দিন (সুমন), জনপ্রিয় কাউন্সিলর ব্যারিষ্টার মুস্তাক আহমদ, ব্যারিষ্টার মো: ফয়সাল জামিল, ব্যারিষ্টার সৈয়দ তাসবীর হাসান, ব্যারিষ্টার ওমর ফারুক, ব্যারিষ্টার হাসান মাহমুদ, ব্যারিষ্টার আব্দুর রউফ, ব্যারিষ্টার এনামুল হক, ব্যারিষ্টার আবু সুহেল, জাহিদুল আবেদীন, সাইয়েদ মো: ইমরান, আইন উদ্দীন সেলিম, হাসানুল বান্না, মো. ইউসুফ, ফজলে রাব্বী, মেহদী হাসান, মোস্তফা জামিল, খায়রুল ইসলাম, আমীর আব্দুল্লা, মোহাম্মদ ইকবাল, মোহাম্মদ আবুল হাশেম, আহমদ খালেদ হাসান প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, কবি নজরুলকে নিয়ে ব্রিটিশ মূলধারায় এখন অনেক গবেষণা চলছে। ক্যামব্রিজে প্রকাশিত (CAMBRIDGE UNIVERSITY PRESS) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কবিতায় নজরুলের লেখা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। বিশ্বের সেরা নিউজরিল সংরক্ষণাগার ‘ব্রিটিশ পাথে’ কবি নজরুলকে দারুণভাবে মূল্যায়ন করেছে। ইউরোপসহ বিশ্বময় অত্যন্ত জনপ্রিয় বিশ্বকোষ নিউ ওয়ার্ল্ড এনসাইক্লোপিডিয়া কবি নজরুল সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিয়েছে।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তাদের লেখা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে (THE UNIVERSITY OF SYDNEY) নজরুল চর্চার প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে। কাজী নজরুল ইসলাম এবং ড. ইয়েটসকে ভারতীয় উপমহাদেশ ও আয়ারল্যান্ডের মানুষের আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের কণ্ঠস্বর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ওয়ার্ডস উইদাউট বর্ডারস কবি নজরুলকে নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে নজরুলের তাৎপর্য একাডেমিক ক্ষেত্রের বাইরেও বিস্তৃত। তিনি নিজেকে বিপ্লবী প্রমাণ করে বাংলা সাহিত্য এবং রাজনীতি উভয়ই প্রজ্বলিত করেছেন।
লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ গুরুত্বের সাথে নজরুল চর্চা হয়। বাংলার বিদ্রোহী কবি : নজরুল ইসলাম শিরোনামে অনেক তথ্যবহুল লেখা তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন কবির কবিতা নিয়ে কাজ করে পয়েম হান্টার। কবি নজরুলের অনেক কবিতা তারা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান আমেরিকান জার্নালে কাজী নজরুল ইসলাম এবং তার বিদ্রোহী কবিতার উপর একটি গবেষণা রয়েছে।
ইউরোপে প্রবাসী বাংলাদেশী ও কলকাতার বাঙালি কমিউনিটিতে ব্যাপক ভাবে নজরুল চর্চা হয়। লন্ডনে কবি নজরুল সেন্টার বেশ সমৃদ্ধ শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আমাদের জাতীয় কবিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য লন্ডনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কবি নজরুল স্কুল জনমনে বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে নজরুল সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায়। ২০০২ সাল থেকে সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্ট কবি নজরুলকে নিয়ে লন্ডনে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে দেশী-বিদেশী সাহিত্যিক-সাংবাদিকসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকে অংশ গ্রহণ করেন। অনুভবে নজরুল শিরোনামে অনুষ্ঠানে বক্তারা কবির লেখা থেকে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। কবিকে ব্যাপকভাবে বিশ্বময় পৌঁছে দেয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করছে সংলাপ ফ্রন্ট।
২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর, রোববার পূর্ব লন্ডনের রিচ মিক্স সেন্টারে টিএস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড এবং কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী মঞ্চস্থ হয়। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন দ্য টেগোরিয়ান্স (THE TAGOREANS) কবি নজরুলকে নিয়ে চমৎকার তথ্যচিত্র করেছে ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। তারও আগে ১৯৯৯ সালে অত্যন্ত নান্দনিকতার সাথে নজরুলের জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে। খ্যাতিমান লেখক শ্রীময়ী ভট্টাচার্য কবি নজরুলকে নিয়ে দুই ঘণ্টার একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছেন ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালে এটির প্রথম প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বছর তা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
গবেষণা মতে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক বাঁধভাঙা প্রতিভা। বিদ্রোহী কবি হিসেবে ভুবনখ্যাত। সাংবাদিক হিসেবে উপমহাদেশে স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ২১ বছরে বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। আকাশচুম্বী কবি খ্যাতির নিচে কিছুটা হলেও চাপা পড়ে গেছে তার সাহসী সাংবাদিকতার ইতিহাস।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষের মানুষ কেন পিছিয়ে পড়েছে, সে কথা তিনিই প্রথম দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেছেন। শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে অদম্য মেধা ও সাহসের পরিচয় দেন। সংবাদ মাধ্যমে জনগণের মনের কথা তিনি যথার্থভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তার বিদ্রোহ ছিল উপনিবেশের বিরুদ্ধে, জাত-পাত ও বিভাজনের বিরুদ্ধে, অসত্য-অসুন্দরের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহী নজরুলের সংবাদ তৈরি এবং প্রকাশের দক্ষতা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও শিক্ষামূলক। বৈশ্বিকভাবে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা তখন ছিল না। দেশের সংবাদপত্র কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা তিনি জানতেন। সাংবাদিকতার ব্যাপারে তার প্রতিভা দেখে সমকালীন সম্পাদকরা তাজ্জব বনে গেছেন।
নজরুল ইসলামের লেখায় অবিচার ও শোষণ বিরোধী গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রেরণা জুগিয়েছে। তার ‘জার্নালিজম অব আউটরেজ’ সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছিল। প্রতিটি লেখার প্রতিক্রিয়া দেখে সমকালীন খ্যাতিমান রিপোর্টাররা বিস্মিত হয়েছেন। নজরুল জানতেন তথ্য কোথায় খুঁজতে হবে এবং কিভাবে এগুলোকে একটির সাথে আরেকটিকে সংযুক্ত করতে হবে। প্রমাণ বিশ্লেষণ, যাচাই ও পটভূমি ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি অর্থবহ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সাংবাদিকতার নৈতিক মান বজায় রাখতে গিয়ে আইনভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করেননি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় গোয়েন্দা পুলিশের মতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তুলে ধরতেন। বিজ্ঞানীর মতো প্রমাণ আবিষ্কার করতেন।
ইউরোপে এখন সাংবাদিকতায় যে মানদণ্ডের কথা কথা বলা হচ্ছে, বহুকাল আগে কবি নজরুল তা বাস্তবে প্রমাণ করে গেছেন। তাই কবিতার পাশাপাশি সংবাদিকতায় নজরুল এখন বেশ আলোচিত বিষয়। বছরের হিসেবে ক্যালেন্ডারের পাতায় এক শ’ বছর অতিক্রম করেছে। সে সাংবাদিকতার হালখাতা মিলাতে গেলে অবাক হতে হয়।
নজরুল সংবাদপত্রের সব ধারণা পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অনুসন্ধানী ও সৃজনশীল সাংবাদিকতার কিংবদন্তি। নজরুলকে আধুনিক বাংলা সাংবাদিকতার জনক বা ফাদার অব দ্য জার্নালিস্ট বলা যায়। যে জন্যও আগামীর ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।