রায়িসির হেলিকপ্টার দূর্ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের দফতর প্রধান

আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

নাসির মাহমুদ

ইরানের প্রেসিডেন্টের দফতর প্রধান গোলাম হোসাইন ইসমায়িলি শহীদ ইব্রাহিম রায়িসির শেষ সফরে পূর্ব আজারবাইজানে গিয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট রায়িসির ওই প্রাদেশিক সফর এবং তাঁকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন: আমরা ১৯ মে রোববার সকাল ৬টায় তেহরান থেকে তাব্রিজের উদ্দেশে রওনা হই। সকাল ৭:১০ মিনিটে তাব্রিজে অবতরণ করি। পরিষ্কার আবহাওয়ার মধ্যেই আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের প্রধান বলেন: সীমান্তে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের যৌথ কর্মসূচি ছিল বাঁধ উদ্বোধন করা। সেই কাজ সেরে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের সাথে এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে একটি কূটনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে জোহরের নামাজ আমরা আদায় করি। এ সময় গ্রামের বেশ কিছু মানুষ ওই নামাজখানাতেই তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এলাকার লোকজনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রায়িসির সর্বশেষ সাক্ষাত অনুষ্ঠানটি ঠিকঠাকমতোই শেষ হয়। এরপর আমরা সম্পূর্ণ পরিষ্কার আবহাওয়ার মধ্যেই হেলিকপ্টারে চড়ে তাব্রিজের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই। আকাশ একেবারেই পরিষ্কার ছিল। আধা ঘণ্টার মতো আমরা এভাবেই যাচ্ছিলাম। এরপর এক খণ্ড মেঘের মতো কিছু একটা দেখা গেল।

ইসমায়িলি বলেন: হেলিকপ্টারগুলো মেঘের স্তরের উচ্চতায় কিংবা মেঘের স্তর থেকে কিছুটা কম উচ্চতায় উড়ছিল। শহীদ ক্যাপ্টেন মুস্তাফাভি ছিলেন প্রেসিডেন্ট রায়িসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটির পাইলট এবং আমাদের সাথে যাওয়া হেলিকপ্টার গ্রুপের কমান্ডার। তিনি ওই মেঘ দেখে ঘোষণা করলেন, আরও উচ্চতায় উড়ে গিয়ে মেঘের উপরে যেতে এবং সেই উচ্চতায় হেলিকপ্টার চালিয়ে যেতে।

ইসমায়িলি আরো বলেন: নির্দেশ অনুযায়ী মেঘের উপরে চলে গেল হেলিকপ্টারগুলো। আমরা ছিলাম ৩ নম্বর হেলিকপ্টারে। মাঝখানের হেলিকপ্টারে ছিলেন প্রেসিডেন্ট রায়িসি আর সামনে ছিল অপর হেলিকপ্টারটি। আমরা মেঘের উপরে যাবার আধা ঘণ্টা পর ক্যাপ্টেন বুঝতে পারলেন যে মূল হেলিকপ্টারটি আমাদের সঙ্গে নেই এবং ওই হেলিকপ্টারটিকে দেখা যাচ্ছে না। হেলিকপ্টারটি না আসায় আমাদের পাইলট পেছনে ফিরে গেলেন। আমি কো-পাইলটের কাছে জানতে কারণ চাইলে তিনি বললেন, সম্ভবত ওই হেলিকপ্টারটি জরুরি অবতরণ করেছে। আমরা যতই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, কোনোভাবেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয় নি। রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাই কোনো সাড়া মেলে নি।

প্রেসিডেন্টের কার্যালয় প্রধান বলেন, আমাদের পাইলট ওই এলাকায় কয়েক রাউন্ড করে উড়ে উড়ে দেখার চেষ্টা করেন এবং এক পর্যায়ে মেঘের ওপরেও চলে যান। কিন্তু সেখান থেকে নীচে কিছুই দেখতে পান নি এবং মেঘের নিচে আসাটাও সম্ভব হচ্ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে আমরা পার্শ্ববর্তী সুনগুন তামা খনি এলাকায় অবতরণ করলাম এবং ঘটনার খোজখবর নিতে শুরু করলাম।

ইসমায়িলি বলেন: প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের কাছে মোবাইল ফোন ছিল। তাদেরকে কল করেও কোনো জবাব পাওয়া যায় নি। ফ্লাইট ক্রু আমাদের বলেছিলেন, পাইলট শহীদ মুস্তাফাভির সেল ফোনে একবার যোগাযোগ হয়েছিল। জবাব দিয়েছিলেন শহীদ আয়াতুল্লাহ আলে হাশেম। তিনি বলেছিলেন, আমি ভাল নেই এবং আমি উপত্যকায় পড়ে গেছি। এছাড়া বিশেষ কোনো কিছু বলেন নি তিনি। আমি ফোন করে তার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, বুঝতে পারছি না কী হয়েছে! বলতেও পারছি না আমি কোথায় আছি। শুধু বললেন, আমি গাছগাছালির মধ্যে আছি।

জিজ্ঞেস করলাম: কাউকে দেখতে পাচ্ছেন? তিনি বললেন, না, কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, আমি একা, আমার চারপাশে কেউ নেই।

আমি বললাম: ওই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যটা কীরকম দেখছেন? তিনি আমাদের গাছগাছালি ও বনের অস্তিত্বের কথা জানালেন। তার কথা থেকে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে। আমরা দ্রুত দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যখন আমরা এলাকাটি খুঁজে পাই, পরিস্থিতি দেখেই ধারনা করেছিলাম প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য সফরসঙ্গী দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে শহীদ হয়েছেন। তবে আলে-হাশেম কয়েক ঘন্টা পরে শহীদ হয়েছেন।

প্রেসিডেন্টের কার্যালয় প্রধান আরো বলেন, আমরা যখন ওপর থেকে দুর্ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম, তখন বিস্ফোরণের শব্দ, আগুন কিংবা ধোঁয়ার কোনো আলামত দেখতে পাওয়া যায় নি। ঘণ্টাখানেক পর আমরা যখন সুনগুন তামার খনিতে নামি তখনো আবহাওয়া অনুকূল ছিল। কিন্তু যখনই দুর্ঘটনাস্থলের দিকে যাই তখন মেঘ তৈরি হয়, বৃষ্টি শুরু হয় এবং কুয়াশা নেমে আসে। বিকেল ৩টার পর থেকে এলাকার আবহাওয়া সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।

* নাসির মাহমুদ সিনিয়র সাংবাদিক ও এডিটর, রেডিও তেহরান ওয়ার্ল্ড সার্ভিস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *