রাজনৈতিক হাওয়া থেকে মুক্ত থেকে বিচার করাই বিচারকদের দায়িত্ব : প্রধান বিচারপতি

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। আর বিচারকদের উচিত রাজনৈতিকভাবে বয়ে যাওয়া হাওয়া থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে, সংবিধান, আইন ও নিজেদের বিচারিক বিবেকের প্রতি পরিপূর্ণ অনুগত থেকে বিচারকার্য সমাধান করা। তিনি বলেন, একটি জাতির জনগণ শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে সে জাতিকে খারাপ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিদায়ি সংবর্ধনার জবাবে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, বিচার বিভাগ যদি আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগে ব্যর্থ বা পিছপা হয়, তাহলে রাষ্ট্র এবং নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। আইন যদি দরিদ্রকে পিষে দেয়, আর ধনী ব্যক্তি যদি আইনকে পিষে দেয়, তাহলে রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলছে এটা কোনো ভাবেই বলা যাবে না। সব বিচারককে অসামান্য নৈতিকতার অধিকারী হতে হবে, নইলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা শুধু সংবিধানের ভেতরই আবদ্ধ থাকবে। একজন রাজনীতিবিদ পরবর্তী নির্বাচনের কথা ও একজন রাষ্ট্রনায়ক পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবেন। কিন্তু একজন বিচারককে ভাবতে হবে সংবিধান ও আইনানুযায়ী ন্যায়বিচার করার কথা। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়. আমার উত্তরাধিকারী গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন। আমি এটাও মনে করি, মহান আল্লাহতায়ালা তাকে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার অধিকারী করবেন। বিচার বিভাগকে আরো গতিশীল বিচার বিভাগে পরিণত করবেন।’

আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর অবসরে যাবেন দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। রবিবার থেকে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ অবকাশ শুরুর প্রেক্ষাপটে বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবসে তাকে বিদায়ি সংবর্ধনা দেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজউদ্দিন ফকির। প্রধান বিচারপতির এজলাস কক্ষে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণের পাশাপাশি শত শত আইনজীবীরা যোগ দেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি রাজপথ অতিক্রম করে বিচারালয় অভিমুখে ধাবিত হলে সেটা বিচারালয়ের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আইনজীবীদের বিভক্তি ও মতভেদ এবং তার প্রতিক্রিয়া বিচারালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক মতাদর্শ রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন করলে এবং বিচারলয়কে নিরাপদ দূরত্বে রাখলে বিচার বিভাগ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ সংবিধানের আধিপত্য রক্ষার পাশাপাশি জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষক। সুপ্রিম কোর্টের পবিত্র দায়িত্ব হলো সংবিধানের প্রতিটি অক্ষরের প্রতি অনুগত থাকা এবং সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া। সাংবিধানিক বিধান দিয়ে সর্বপ্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে মজবুত দেওয়াল দিয়ে রক্ষা করার দায়িত্ব বিচারকদের, আইনজীবীদের এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেক দায়িত্বশীল নাগরিকের। আমরা, আপনারা, সবাই সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সর্বনাশা দিনের জন্য প্রতিটি নাগরিকের অপেক্ষা করতে হবে। আমি চেষ্টা করেছি, জনগণের ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে আমার কাজের মধ্যে প্রতিফলন ঘটাতে। জুডিশিয়ারিকে সুশৃঙ্খল এবং গতিশীল করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।’

অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। আপনি আপনার ঘোষিত রায় ও কর্মের মধ্য দিয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন।’ বার সভাপতি বলেন, ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনার নেওয়া উদ্যোগ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করব। একজন আদর্শ বিচারক হিসেবে আপনি বিচার বিভাগের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন।’

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কাঁদলেন স্বজনরা
বিদায়ি বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে এসে প্রধান বিচারপতি স্মরণ করেন তার মরহুম বাবা-মাকে। তিনি বলেন, ‘আমার জন্য এবং আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য অপরিসীম কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে তারা জান্নাতবাসী হয়েছেন।’ এ কথা বলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। তার কণ্ঠ ধরে আসে। ক্ষণিকের জন্য থেমে যান। পরেই অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বলেন, ‘আমি বিচার বিভাগকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম এবং আমি চেষ্টা করেছি স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমরা আবার দেখা করব। কোথায় জানি না, কখন জানি না, তবে জানি—আমাদের আবার দেখা হবে কোনো এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে।’ এ সময় এজলাস কক্ষে উপস্থিত প্রধান বিচারপতির বড় মেয়ে ও নাতিকে কাঁদতে দেখা যায়। এ সময় পুরো এজলাস কক্ষে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *