রমজানে হিজাজের প্রাচীন ঐতিহ্য ও রীতিনীতি

মধ্যপ্রাচ্য লাইফ স্টাইল
শেয়ার করুন
সৌদী আরবের পশ্চিমাঞ্চলীয় হিজাজ এলাকায় যুগ যুগ ধরে রমজানের কিছু অনন্য ও প্রাচীন রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। মক্কা ও মদীনা নগরীর বাসিন্দারা তাদের বদান্যতা ও মহানুভবতার জন্য সুপরিচিত। তারা হজ্ব পালনকারীদের স্বাগত জানিয়ে থাকেন এবং বছর ব্যাপী তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। তাদের বাড়িঘর এমন ডিজাইনে তৈরী যাতে বাড়ির আঙ্গিনায় অতিথিদের জন্য একটি ঘর রয়েছে। এই স্থাপত্যরীতি সিরিয়া ও এর সংলগ্ন অঞ্চলসমূহ থেকে সংগৃহীত। মদীনার পরিবারগুলোকে বলা হয়, ‘মুজাওয়ারীন’। এটা আরবী ‘জেয়ারা’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘দর্শনার্থী’। তারা দর্শনার্থীদের স্বাগত জানিয়ে থাকেন যারা মহানবী (সঃ)-এর রওজা ও মসজিদ দর্শনে আসেন।
মক্কার ‘মুতাওয়ীফিন’-এই শব্দটি ‘তাওয়াফ’ নামক হজ্ব সংক্রান্ত ইসলামী রীতির শব্দ থেকে আগত। মুতাওয়ীফিনরাও দূর দূরান্ত থেকে আগত অতিথিদের থাকার জন্য বাড়িঘরের ডিজাইন করে থাকেন। অনেক হজ্ব ও উমরাহ পালনকারী সমুদ্রপথে মক্কা ও মদীনায় আসেন জেদ্দা নগরীর মাধ্যমে। নগরীর ধনী ব্যবসায়ীরা উভয় পবিত্র নগরীর গেষ্ট হাউস গুলো প্রদান করেন। পরিবারসমূহ অতিথি ও পরিবারের সবার জন্য সারা বছরজুড়ে একই ধরনের দুই সেট খাবার প্রস্তুত করেন। এতে হিজাজের প্রচলিত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
মক্কা ও মদীনায় মাগরীবের নামাজের আগে, পুরুষেরা পবিত্র মসজিদগুলোর উদ্দেশে রওয়ানা হন। সাথে নেন ব্যাগভর্তি ইফতার সামগ্রী। এগুলো তারা মুসল্লী ও উমরাহ হজ্ব পালনকারীদের মধ্যে বিতরণ করেন। মসজিদসমূহের চারদিক ঘিরে এ ধরনের বহু বাড়ি আছে। এসব ব্যাগে অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে উসমানীয় শোরাইক ব্রেড, খেজুর এবং দুগ্গা’ নামক জিরা থেকে তৈরী এক ধরণের মসলা, লেমন সল্ট, সল্ট, সিসেইম সীড, বাখর পাতা ইত্যাদি থাকে। মদীনায় প্রচলিত রীতি হচ্ছে, ‘দুগ্গায়’ চুবানো খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা। সাথে একটুকরো রুটি এবং কফি বা ঠান্ডা দইয়ের শরবত পান। এই ঐতিহ্যবাহী খাবার আজো প্রচলিত।
উভয় নগরীতে যে সব পরিবারে দীর্ঘদিন বসবাসকারী হজ্বপালনকারী থাকেন, সেই রেওয়াজ আজো ধরে রেখেছে সেগুলো। প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানীগুলো তাদের বাড়িঘর এবং সর্বোত্তম সেবা প্রদান করে, যেমনটি করেছেন তাদের পূর্ব পুরুষেরা বহু কাল ধরে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা স্মরণ করেন কীভাবে পরিবারের কম বয়সী নারীরা আগে ভাগেই পুরো রমজানের জন্য খাবার সংগ্রহ ও প্রস্তুত করে রাখতেন। এসব মহিলা তাদের স্বামী, ভাই কিংবা পুত্রদের বাজারে পাঠাতেন তাদের বিশেষ ডিশ বা খাবারের উপকরণ ও ফলের রস কিনে আনার জন্য।
বাজারের ফর্দে তাজা পাপড়ি থেকে প্রস্তুত গোলাপজল ও হিবিসকাস ফুলের রসও অন্তর্ভুক্ত থাকতো। থাকতো সুগন্ধী ও মসলা মিশ্রিত জমজমের পানি, স্যুপের জন্য গম ও শস্য, ফাভা বীন ও ময়দা-যা দিয়ে রমজানের গুরুত্বপূর্ণ সব খাবার তৈরী হতো। রমজানের খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে ফুল মুদাম্মাস নামক একটি সাধারণ অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডিশ বা খাবার ছিলো, যা মিশর থেকে এসেছে। একটি ক্ষুদ্র তেল বা ঘিয়ের পাত্রে ছোট্ট একখন্ড জ্বলন্ত চারকোল রেখে দেয়া হয় সার্ভিং ডিশের মধ্যে এবং ফুলের চারদিকে-যাতে এতে আলাদা ধোয়াঁটে সুগন্ধ সৃষ্টি হয়।

একটি অন্যতম প্রধান হিজাজী খাবার হচ্ছে স্যাম্বুসাক, বাফ- এটা চারকোনা ভাজা পাফড্ সমুচা, যা মাংস কিংবা পনিরের টুকরো ভর্তি। অপর সুপরিচিত খাবার হচ্ছে সুবিয়া, এক ধরণের শীতল পানীয়-যা বার্লি কিংবা কয়েকদিন ধরে পানিতে ভেজানো রুটি থেকে তৈরী হয়। এতে চিনি, এলাচি, বেইসিন, মান্টো, শিশ বারাক, বার্লি স্যুপ, বুরাইক ইত্যাদি মেশানো হয়। রমজানের রাতগুলো থাকে নিঃশব্দ, শান্ত। মৃদুস্বরে কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ শোনা যায়।
নামাজে রত থাকেন লোকজন। পরিবারের অনেক তরুণ যুবা ও মহিলা সবান্ধব একত্রিত হয়ে গরম সুগন্ধী চা পান করে দীর্ঘ রাত অতিবাহিত করেন। যদিও ক্যারম খেলাটি ভারতীয় উপমহাদেশের। তবুও এটা হিজাজী রেওয়াজের অংশ। অনেক তরুণ ছেলে মেয়ে আজো এই ক্যারম খেলে থাকে রমজান মাসের রাতগুলোতে। হিজাজী পরিবারগুলো তাদের মধ্যেকার দৃঢ় বন্ধন ও সম্পর্কের জন্য প্রসিদ্ধ। রমজান মাসে পরিবারের লোকজন চলে আসে নিজেদের বাড়িঘরে স্বজনদের মাঝে।
সূত্রঃ আরব নিউজ। অনুবাদঃ নিজাম উদ্দীন সালেহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *