যে নারীর প্রিয় মমতা আমার অঙ্গে মাখা ।। রোকেয়া খাতুন রুবী

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বিশ্ব নারী বর্ষের সফল নারী, আজ নয়, আরো বহুকাল আগে। ৬০ ও ৭০ দশকে জাতীয় পত্র পত্রিকায় তাঁর প্রচুর গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ও রান্না বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে মহিলা ও শিশু কিশোর পাতায়। অনেক লেখার কাটিংস ই হারিয়ে গেছে, সযতনে সংরক্ষনের পরেও।

গ্রন্থাগার আন্দোলনের পথিকৃত, ভাষা সৈনিক, সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সম্পাদক মাসিক আল ইসলাহ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মরহুম মুহম্মদ নূরুল হক ও তার সহধর্মিণী লেখক ও মহীয়সী নারী নুরুন্নেসা হক

স্বামীর সঙ্গে “আল ইসলাহ ” মাসিকের অনেক লেখাই তিনি সম্পাদনা করতেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রুফ কাটতেন। নিজে স্মরনিকা সম্পাদনা করেছেন। ম্যাট্রিকে আরবীতে লেটার ছিল, ইংরেজী, বাংলা, অংক, ভূগোল, উর্দু, সিলেটী নাগরীতে দক্ষতা ছিল, ছিল নানা বিষয়ে আগ্রহ। সন্তানদের গান, নাচ, শেখাতে চেয়েছিলেন। হারমোনিয়াম, নুপূর ও কেনা হয়েছিল। কিন্তু হয়নি। মাজারের কাছে বাসা আর কট্টরবাদী পিতার জন্য। পিতার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম।

পেশায় ছিলেন শিক্ষিকা। সংসারের রান্নাবান্না সারা জীবন নিজ হাতে সামলেছেন। স্কুল, কলেজ জীবনে খেলা ধুলা করতেন ভালই। বাসার উঠানে ছেলে মেয়েদের সাথে ব্যাডমিন্টনে অনীহা ছিলনা। ক্যারামে ছিলেন তুখোড়। নিজে পান খেতেন। সন্তানদের জন্য তা হারাম ঘোষিত ছিল। হস্ত রেখা বিষয়ে ছিল ভীষণ কৌতূহল। কিরোর বই পড়ে ঘুমন্ত সন্তানদের হাতের রেখা বিশ্লেষণ করতেন ।

অসম্ভব মেধাবী তাঁর ডাক্তার হওয়ার যোগ্যতা ছিল। হয়নি। অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতা ছিলো। হয়নি। সংসারের স্বার্থে ইন্টারমিডিয়েটের শেষে শিক্ষা প্রতিষ্টান ছেড়েছিলেন। পড়ার অভ্যাস ছাড়েন নি। স্মৃতির আকাশে ভাসমান তিনি, সাগরময় ঘোষের সম্পাদকের বৈঠকে বইটি থেকে পড়ছেন আর সন্তানরা একেকটা ঘটনা শোনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ।

যতোই হাসেন না কেন, নামাজ, কোরান, পড়া শোনায় ফাঁকি দেবার জো ছিলোনা। এক ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির যোগ্য করে তোলা, পরবর্তীতে সেনা বাহিনীতে যোগদান, এক মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় অনার্স মাস্টার্স পড়িয়ে, বিসিএস শেষে উচ্চ পদস্থ সরকারী চাকরীজীবি করা, অন্য সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করা, যার যার মতো পেশা গ্রহণ সব কিছুতেই জড়ানো আছে তাঁর অবদান। শালীনতাকে সহ যাত্রী করে চলার মন্ত্র ঢেলেছেন কানে। দৃষ্টি রেখেছেন তীক্ষ্ণ ।

রক্ষনশীল পরিবেশে ছেলে মেয়ে একসাথে মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে গ্রামবাসীর সমালোচনায় লেখা পড়া বন্ধ হলে, হিন্দু পন্ডিত মশাই তীব্র প্রতিবাদ জানালে পিতা তাঁর স্কলারশীপ পাওয়া এই মেধাবী কন্যাকে শহরের সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। তাঁর পিতা নিজে ছিলেন টাইটেল পাশ স্কুল শিক্ষক। পরে তিনি তাঁর এই কন্যার সাথে ম্যাট্রিক দিয়ে, দু’জনে এক সাথে উত্তীর্ণ হন। পিতা এক দিকে ছিলেন বিদ্যানুরাগী, অপর দিকে ভীষণ কট্টরবাদী।আরবী, বাংলা, ইংরেজী, উর্দু, ফার্সী, ইমামতী, সব কিছুতে দক্ষ হলেও, ছিলেন না শিল্পানুরাগী। কিছুটা বিচিত্র ছিল তাঁর চরিত্র। কট্টরবাদী হওয়া সত্বেও মেয়ে, নাতনীদের কখনো বোরকাবৃত হতে আদেশ জারী করেন নি। সাহিত্য চর্চা নিয়ে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন নি। তবে এমন কড়া পিতার কন্যা হয়ে তাঁর মাঝে এতো শিল্প তৃষ্ণা কি করে জন্মালো তা সবাইকে অবাক করতো। পিতার প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি আমৃত্যু তাঁর পণ্ডিত স্যারের জন্য শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার বাণী ছিল তাঁর মুখে ।

স্কুলে পড়াকালে একজন সাধক পুরুষের সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বয়সের বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্বেও তাঁরা ছিলেন নির্ভেজাল সুখী দম্পতি। বিয়ের পর লেখা পড়ার সুযোগ পে্যেছিলেন। পত্রিকার সম্পাদনা, প্রতিষ্ঠান চালানো, পাশাপাশি, লেখক, গবেষক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক স্বামীর সংসারের হাল, কম বয়েসেই শক্ত হাতে ধরতে হয়েছিল। স্বামী বিত্ত বৈভব দেননি, বরং বলেছেন, “কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের ও মাঝার ।” না কোন অভিযোগ অনুযোগ ছিলোনা। কোন হীণমন্যতা গ্রাস করেনি তাঁকে। অর্থের জন্য কোন ছেলেকে ‘লন্ডনী” করতে উৎসাহিত ছিলেন না কখনো।

আত্নীয় স্বজনদের আসা, থাকা, খাওয়াতে সবাই অতিষ্ট হয়ে পড়লেও তিনি অসীম ধৈর্য নিয়ে সন্তানদের চুপ থাকতে বলতেন। সাধ্যের মধ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখতেন।

শত ঝামেলার মাঝে ও বাগান করা ছিল তাঁর নেশা। ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকতো সাধারণ বাড়ীটি। অজস্র দোলনচাঁপা, বেলী, কামিনী, গোলাপ, জবা, গাঁদা, সন্ধ্যা মালতী, হাস্না হেনা আর ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ মৌ মৌ করতো। বৃষ্টি রাতে ণেবু ফুলের ঘ্রাণ সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে দিতো। দিনে সময় পেতেন না বলে রাতে বাগানে কাজ করতেন। প্রায়ই সঙ্গী থাকতো বুড়ো মালী হবিবুল্লাহ। বাড়ীতে ফল গাছের ও কমতি ছিলোনা তাঁর। আম, কাঁঠাল, জাম্বুরা, আতাফল, কামরাঙ্গা, অরবরই, নারকেল, সুপারী কিনা ছিল ।

রক্ষনশীল একটি শহরে থেকেও তিনি সন্তানদের বিতর্ক, আবৃতি, বক্তৃতায় অংশগ্রহণে বাধ্য করতেন। সাহিত্য সভায় পাঠাতেন। ছেলে বন্ধুদের সাথে সম্মানজনক দূরত্ব রেখে মেয়েদের মিশতে দিতেন। নিজে রেডিওর জন্য স্ক্রিপ্ট লিখতেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন। প্রচুর গান, কবিতার কথা মুখস্থ ছিল তাঁর। প্রায়শঃই আওড়াতেন “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরন ধুলার তলে….” ভাল বাসতেন “যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্নে এই বাটে …..” গানের কলি।

হাস্যময়ী, ব্যক্তিত্বশালী তিনি গয়না পরতেন না বলতে গেলে। মেয়েদের ও কম পরাতেন। কি রান্না কি সেলাই সব খানেই তাঁর চরণ ধ্বনি বাজতো ।

সন্তানদের সাহিত্য রচনার প্রথম পাঠক তিনি। সম্পাদনায়, সমালোচনায়, ছন্দ সংশোধণে নির্ভরযোগ্য শিক্ষক। তিনি শিখিয়েছেন পরচর্চা ও পরনিন্দা না করার বাণী।

ছেলে মেয়েদের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি কোনদিন। তাই বোধ হয় তাঁর সন্তানদের পরস্পরের প্রতি নিঃস্বার্থ অমলিন সম্পর্ক দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে ।

মানুষকে সম্মান করা, ভালবাসা ছিল তাঁর আদর্শ। রাত জেগে বই পড়তেন, ছড়া, কবিতা লিখতেন। লিখতেন গল্প, প্রবন্ধ। ছিলেন বাংলা একাডেমীর সদস্য।

সিলেটের মহিলা লেখকদের মধ্যে তখন জাতীয় পর্যায়ে তাঁর মতো এতো বহুবিধ লেখা ক’জনেরই বা প্রকাশিত হয়েছে! অথচ এই লেখিকার নামটি পর্যন্ত উচ্চারিত হয়না! তাতে কি। ইতিহাস তো সত্যাশ্রয়ী। তিনি মরহুম নুরুন্নেসা হক। আমাদের আম্মা।

আম্মা, সময়ের চেয়ে অগ্রগামী ছিলে তুমি। রক্ষনশীল সমাজে থেকেও তুমি আমাদের ভুবন আলোয় ভরিয়ে দিয়ে গেছো। তোমার জন্য আজকের এই আমি, আমরা। বিশ্ব নারী দিবসের সফল নারী তুমি। আজ নয়, বহু আগেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *