শুভজ্যোতি ঘোষ
আমেরিকায় দুই মেয়াদের বেশি কারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেনে অবশ্য সেরকম কোনও বিধিনিষেধ নেই, তবে সেখানেও দেখা গেছে মার্গারেট থ্যাচার বা টোনি ব্লেয়ারের মতো প্রবাদপ্রতিম নেতানেত্রীরা যখন তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাদের জয়ের মার্জিন অনেক কমেছে এবং রাজনৈতিকভাবে তারা অনেক দুর্বল হয়েছেন।
ভারতে পরপর দুটো মেয়াদে নরেন্দ্র মোদীর একচ্ছত্র শাসনের পর তিনি যখন তৃতীয়বার দেশের ম্যান্ডেট চাইলেন, তার অনুগামী ও সমর্থকরা আশা করেছিলেন তার জয়ের ব্যবধান আরও বাড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, তৃতীয় দফার নেতৃত্বের যে ‘গেরো’ – নরেন্দ্র মোদীও তা থেকে অব্যাহতি পেলেন না। অথবা অন্যভাবে বললে, নিজেকে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন।
তবে টানা তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি যার রেকর্ড স্পর্শ করবেন, সেই জওহরলাল নেহরুও কিন্তু ১৯৬২তে তার তৃতীয় তথা শেষ নির্বাচনে অনেক কম ব্যবধানে জিতেছিলেন। যদিও তার দল কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে কোনও সমস্যা হয়নি।
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি শেষ পর্যন্ত এককভাবে পেয়েছে ২৪০টি আসন। সরকার গড়ার জন্য পার্লামেন্টে দরকার অন্তত ২৭২টি আসন, সুতরাং বিজেপির আসন সংখ্যা তার চেয়ে ঠিক ৩২টি কম। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সরকার গড়তে হলে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে এখন জোটসঙ্গী দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। যদি প্রাক-নির্বাচনি জোটসঙ্গীরা কোনও কারণে জোট ছেড়ে যায়, বিজেপিকে হয়তো নতুন সঙ্গী দলও খুঁজতে হতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা, গত এক দশক ধরে বিজেপির একার শক্তিতেই বলীয়ান একটি ক্ষমতাবান সরকার চালানোর পর নরেন্দ্র মোদীকে এখন একটি তুলনামূলকভাবে দুর্বল কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিতে হবে। এতদিন শরিক দলগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া না-করলেও এখন সরকারকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থেই তাকে সঙ্গীদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
কিন্তু এরপরও যে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, তা হল আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে থাকা একটি ক্ষমতাসীন দল যেখানে চারশো আসনের লক্ষ্যে উদ্দীপিত প্রচার চালাচ্ছিল, সেখানে কীভাবে তারা আড়াইশোরও নিচে আটকে গেল? বিরোধীরা তো অনেকে এটাকে বিজেপির নৈতিক পরাজয় বলেও বর্ণনা করছেন। এই প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কিছু উত্তর খোঁজা হয়েছে এই প্রশ্নটিরই!
ব্যর্থতার উত্তর উত্তরপ্রদেশে?
ভারতের রাজনৈতিক ভূগোলটা ভাল করে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, নির্বাচনি ল্যান্ডস্কেপে উত্তরপ্রদেশই হল গোটা দেশে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। দেশে যে কোনও রাজ্যের চেয়ে বেশি – ৮০ টা – সংসদীয় আসন দেয় বলেই সম্ভবত, অতীতেও দেখা গেছে যে দল বা জোট উত্তরপ্রদেশে জিততে ব্যর্থ হয়েছে তাদের দিল্লির ক্ষমতায় আসাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর এই উত্তরপ্রদেশেই ছিল গত দু’টো নির্বাচনের মতো বিজেপির সব চেয়ে বড় ভরসা – সেখানকার তথাকথিত ‘ডাবল ইঞ্জিন’ মডেলকেও (যার অর্থ কেন্দ্রে মোদীর আর রাজ্যে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে একই দলের সরকার) তারা উন্নয়নের সেরা টেমপ্লেট গোটা দেশে হিসেবে তুলে ধরেছিল। কিন্তু গত দুটো নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে যথাক্রমে ৭২টি ও ৬৩টি আসন পাওয়ার পর ওই রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা এবার ৩৩-এ নেমে এসেছে, যে ফলাফল দলের নেতা-কর্মীরা কেউ আশাই করেননি।
উত্তরপ্রদেশের পরে সবচেয়ে বেশি লোকসভা আসন যে দু’টি রাজ্যে, সেই মহারাষ্ট্র (৪৮) ও পশ্চিমবঙ্গও (৪২) বিজেপিকে দারুণভাবে নিরাশ করেছে। মহারাষ্ট্রে গতবারের তুলনায় তাদের আসন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে, আর পশ্চিমবঙ্গে আসন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়া হিন্দি হার্টল্যান্ড বা গোবলয়ের আরও দু’টো রাজ্য, রাজস্থান ও হরিয়ানাতে এবং দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকেও বিজেপি প্রচুর আসন হারিয়েছে।
সেই জায়গায় ওড়িশা, তেলেঙ্গানা বা অন্ধ্রের মতো নতুন নতুন রাজ্যে বিজেপি ভাল সাফল্য পেলেও তা কিন্তু এই ‘ঘাটতি’টা পুষিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল না। বস্তুত এখন দেখা যাচ্ছে, গতবারের তুলনায় শুধু উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যে ৩০-টার মতো আসন খুইয়েছে, সেটা ধরে রাখতে পারলেই তারা কিন্তু এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি পৌঁছে যেত।
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে বহুকাল ধরেই জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজন প্রাধান্য পেয়ে আসছে। ২০১৪-তে বিজেপির তথাকথিত ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর ফমুর্লা বিভিন্ন ছোটখাটো জাত-ভিত্তিক দলকে কাছাকাছি এনে একটা সফল ‘উইনিং কম্বিনেশন’ তৈরি করতে পেরেছিল বলে পর্যবেক্ষরা মনে করেন – যা পরপর দুটো নির্বাচনে ওই রাজ্যে বিজেপিকে চমকপ্রদ সাফল্য দিয়েছে।
এবারে কেন সেই ফমুর্লা কাজে লাগল না বা মোদী-যোগীর ডাবল ইঞ্জিন কেন বেলাইন হল – তা ভাল করে খতিয়ে দেখে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে আরও কিছুটা সময় লাগবে অবশ্যই। তবে আপাতত ম্যাজিক নাম্বারে পৌঁছতে বিজেপির ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ চিহ্নিত করতে হলে আঙুল তুলতে হবে উত্তরপ্রদেশের দিকেই!
‘ইট’স দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’
১৯৯২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিল ক্লিন্টন যখন ক্ষমতাসীন জর্জ ডাব্লিউ বুশ (সিনিয়র)-এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জার হিসেবে দাঁড়ান, তখন প্রচারে কোন কোন বিষয়ে জোর দিতে হবে তার নির্বাচনি স্ট্র্যাটেজিস্টরা তার একটা নকশা তৈরি করেছিলেন। সেই পটভূমিতেই সামনে এসেছিল ‘ইট’স দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’ – এই বাক্যবন্ধটি!
আসলে অর্থনীতি যে বিশ্বের যে কোনও নির্বাচনেরই সারকথা, এটা পন্ডিতরা বহুকাল ধরেই বলে আসছেন। এই চারটি শব্দ খুব কম কথায় সেই বার্তাকেই সার্থকভাবে প্রতিফলিত করেছে। গত এক দশকে ভারতের অর্থনীতি একেবারে বেহাল দশায় পৌঁছেছে, তা মোটেই বলা যাবে না – কিন্তু এই অর্থনীতির নানা বিরূপ অভিঘাত কিন্তু নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপিকেও যথেষ্ঠ ভুগতে হয়েছে।
কোভিড মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মতো নানা আন্তর্জাতিক প্রভাবের জেরেই হোক বা নানা অভ্যন্তরীণ কারণে – মূল্যবৃদ্ধির চাপে ভারতের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষজন হিমশিম খাচ্ছেন তাতে কোনও ভুল নেই। রান্নার জ্বালানি গ্যাসই হোক বা চাল-ডাল-আটা-তরিতরকারির মতো রোজকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সব জিনিসের অগ্নিমূল্যে দেশের আমজনতা নাভিশ্বাস ফেলছেন। আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি (ইনফ্লেশন) পরিস্থিতিকে আরও অসহনীয় করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে ভারতের সাম্প্রতিক অর্থনীতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটা মূলত ‘জবলেস গ্রোথ’ – যার মানে শতকরা হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও তাতে কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে চাকরি বা কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বহু বিশেষজ্ঞই সরকারকে এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন। যেমন এই মুহুর্তে ভারতে বেকারত্বের হার সরকারি হিসেবেই ৮.১ শতাংশ – যা প্রায় সর্বকালীন রেকর্ডের কাছাকাছি। সারা দেশে এই চাকরির হাহাকার – বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে কর্মসংস্থানের অভাব – দেশের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই বিজেপিকে ভুগিয়েছে।
বিরোধী দলগুলোও প্রায় নিয়ম করে প্রতিটি নির্বাচনি সভায় এই চাকরির অভাব বা ‘বেরোজগারি’র ইস্যু তুলেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তো তার প্রায় প্রতিটি ভাষণই শুরু করতেন এই প্রসঙ্গ দিয়ে। এছাড়া বছরকয়েক আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য নরেন্দ্র মোদী সরকার ‘অগ্নিবীর’ নামে যে বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করে সেটাও ভারতের বহু রাজ্যে যুবকদের মধ্যে প্রবল হতাশা সৃষ্টি করে।
‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের জন্য ভারতীয় সেনাতে একজন জওয়ান হিসেবে ‘পাকা চাকরি’তে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ অনেক সঙ্কুচিত হয়ে আসে – এখন বেশির ভাগ আর্মি রিক্রুটই কেবল পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। ভারতের বহু রাজ্য – বিশেষত যেখানে বড় শিল্পের অভাব আছে – সেখানে তরুণদের জন্য চাকরির বড় ভরসা ছিল এই ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেই সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তরুণরা অনেকেই হয়তো বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।
‘চারশো পার’-এর ব্যাকফায়ার?
বছরের শুরুতে যখন ভারতে ভোটের দামামা ভাল করে বাজেইনি, তখনই প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আবকি বার, চারশো পার!’ বিজেপি তথা এনডিএ জোটের জন্য চারশোরও বেশি আসনে জেতার সেই টার্গেট বেঁধে দেওয়া দলের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছিল কি না, ড্রয়িং বোর্ডে ফিরে গিয়ে বিজেপির নীতি-নির্ধারকদেরও এখন সে কথা ভাবতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ‘চারশো পার’ স্লোগান দেওয়ার পর ধেকেই বিরোধী নেতারা ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে আসছিলেন, এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ‘ব্রুট মেজরিটি’ নিয়ে নরেন্দ্র মোদী আসলে কী করতে চান? তার উদ্দেশ্যটা কী? এরই মধ্যে কর্নাটকে বিজেপি-র তখনকার এক এমপি বলে বসেন, ‘চারশো পার’ আসন পেলে তাহলেই দল প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধন করতে পারবে এবং হিন্দুরাষ্ট্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সফলভাবে এগোতে পারবে। দলকে অস্বস্তিতে ফেলা সেই নেতাকে বিজেপি সাসপেন্ড করতেও বাধ্য হয়।
প্রসঙ্গত, ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা জরুরি। লোকসভার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৩৬১ বা তার কাছাকাছি। তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষজন ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির (ওবিসি) জন্য ভারতে সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় যে ‘সংরক্ষণ’ চালু আছে – বিজেপি সংবিধান সংশোধন করে সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায় কি না, সেই প্রশ্নও তখন থেকেই উঠতে থাকে।
নির্বাচনি প্রচারের সময়ও দেখা গেছে, নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে শীর্ষ বিজেপি নেতারা একের পর এক জনসভায় গিয়ে রক্ষণাত্মক সুরে সাফাই দিচ্ছেন, গরিব মানুষের ‘কোটা’ বা সংরক্ষণ কেড়ে নেওয়ার কোনও অভিপ্রায় তাদের নেই! কিন্তু ততদিনে যা বার্তা যাওয়ার চলে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী আর একটা কথাও বারবার বলেছেন – তফসিলিদের সংরক্ষণ বহাল রাখলেও তিনি দেশে ‘ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ’ কিছুতেই হতে দেবেন না, কারণ ভারতীয় সংবিধানের রূপকাররা এটির অনুমতি দেননি।
স্বভাবতই এই কথার অর্থ করা হয়েছে – বিজেপি সরকার মুসলিমদের সংরক্ষণের আওতায় কখনওই আনবে না। তা ছাড়া বিশেষ করে দ্বিতীয় দফার ভোটের পর থেকে নরেন্দ্র মোদী নিজে যেভাবে তার ভাষণে কখনও ‘মঙ্গলসূত্র’ বা কখনও ‘মুজরা’-র প্রসঙ্গ টেনে, কখনও বা ‘যাদের বেশি বাচ্চাকাচ্চা হয়’ বলে বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করেছেন – সেটাও কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে ভারতের মুসলিম ভোটকে ‘কনসলিডেট’ বা সংহত করেছে।
২০১৯ সালের নির্বাচনের পরও বিজেপি নেতারা গর্ব করে বলতেন, মোদীজি দেশের মুসলিমদেরও একটা বড় অংশের ভোট পান – কারণ তা না-হলে এতগুলো কেন্দ্রে এত বড় ব্যবধানে জেতাই সম্ভব নয়। ‘পসমিন্দা’ বা পশ্চাতপদ মুসলিম গোষ্ঠীগুলো বা ভারতের মুসলিম নারীদের কাছে টানার জন্য দল বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে অনেক উদ্যোগও নিয়েছিল। এবারে কিন্তু ফলাফলের প্রাথমিক গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, ভারতের দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণি এবং মুসলিমদেরও অনেকেই বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
কংগ্রেসের পুনরুত্থান
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলেন, তার বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট অমিত শাহ বিজেপি সভাপতি হয়েই ঘোষণা করেছিলেন তাদের অগ্রাধিকার হবে একটি ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ গঠন করা। পরে অবশ্য বিজেপি ব্যাখ্যা দিয়েছিল, কংগ্রেস-মুক্ত ভারত মানে কংগ্রেস দলটাকেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া নয়, বরং কংগ্রেসের যে আদর্শগুলো তারা মানে না, সেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই চালানো।
কিন্তু শতাধিক বছরের পুরনো ভারতের এই ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’ যেভাবে সারা দেশে ৪৪টি বা পরে ৫২টি আসন পেয়ে ধুঁকছিল – তাতে বিজেপি নেতারা যে কংগ্রেসকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না, তাদের কথায় তা ছিল স্পষ্ট।
কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধীকে ‘পাপ্পু’ বা অপদার্থ বলে চিহ্নিত করা এবং নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মতো আসলেই কেউ নেই, এই ন্যারেটিভটাকেও সচেতনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছিল।
কিন্তু গত দেড় দু’বছরের মধ্যে কংগ্রেসের এই ভাঙাচোরা ছবিটায় একটা নাটকীয় পালাবদল এসেছে। ২০২২-র সেপ্টেম্বরে দেশের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করে কাশ্মীর পর্যন্ত একটানা পাঁচ মাস ধরে রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ দেশে রীতিমতো সাড়া ফেলেছিল – পাশাপাশি রাহুল গান্ধী যে রাজনীতিবিদ হিসেবেও আন্তরিক ও সিরিয়াস, তার সেই নতুন পরিচিতিটাও ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল। পরে দেশের পূর্বে মণিপুর থেকে পশ্চিমে মুম্বাই পর্যন্ত সেই পদযাত্রারই দ্বিতীয় পর্ব, ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ও যথেষ্ঠ সফল ছিল।
রাহুল তখন প্রায়ই বলতেন, বিজেপির ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি ‘মহব্বত কা দুকান’ (ভালোবাসা বিলি করার দোকান) খুলতে চান, যে ভাবনাটাকে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ সাদরে মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তখনই ভোটের বাক্সে হয়তো এর সুফল দেখা যায়নি, কিন্তু রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্য বাড়াতে এই যাত্রাগুলোর অবশ্যই খুব বড় ভূমিকা ছিল। লক্ষ্য করার বিষয় হল, রাহুলকে বিজেপির ‘পাপ্পু’ বলে আক্রমণ করাটাও ক্রমশ বন্ধ হয়ে এসেছিল।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বেই কংগ্রেস কিন্তু প্রায় ‘সেঞ্চুরি’ করে ফেলেছে, তাদের নিজেদের আসন সংখ্যা গতবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করতে পেরেছে। এমন কী, বিরোধী শিবির যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কাউকে তাদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেনি – দেশের মানুষের চোখে রাহুল গান্ধীই কিন্তু ছিলেন মোদীর অঘোষিত চ্যালেঞ্জার।
ফলে নরেন্দ্র মোদীর কোনও বিকল্প নেই – বিজেপি এই যে কথাটা এতদিন ধরে বলে এসেছে, সেই ‘টিনা’ ফ্যাক্টরও (‘দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ’) এবারের ভোটে সেভাবে কাজ করেনি। কারণ রাহুল গান্ধী ছিলেন, তার নেতৃত্বে কংগ্রেসও ছিল উজ্জীবিত ভূমিকায়।
উত্তরপ্রদেশে যেমন রাহুল গান্ধী ও সমাজবাদী পার্টির তরুণ নেতা অখিলেশ ইয়াদবের ‘জুটি’ রাজ্যে দারুণ হিট – তাদের দুই দলের জোট সেখানে ৪৩টি আসন পেয়ে বিজেপিকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। কংগ্রেস যেখানে একটা সময় ওই রাজ্যে অস্তিত্ত্ব বাঁচানোর জন্য লড়ছিল, সেখান থেকেই তারা এবার পাঠাচ্ছে ছ’জন এমপিকে।
সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটও যেভাবে শেষ পর্যন্ত ২৩২টি আসন পেয়েছে, সেটাও অনেকেই ভাবতে পারেননি। এই জোটের বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস যেভাবে অন্য শরিকদের মান-অভিমান ও ‘ইগো’কে মর্যাদা দিয়ে শেষ পর্যন্ত জোটটাকে মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সে জন্য রাহুল গান্ধীর কুশলী নেতৃত্বর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের এই ‘পুনরুত্থান’ যে তৃতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদীর অগ্রযাত্রা অনেকটা প্রতিহত হওয়ার একটা বড় কারণ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এযাবত রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনকেও বিশ্লেষকরা মোটামুটি দুভাগে ভাগ করেন। প্রথম পর্বের ছেলেমানুষি, খামখেয়ালিপনা, সিরিয়াসনেসের অভাব – এগুলোকে কাটিয়ে উঠে গত তিন-চার বছরে তিনি যেন অনেক পরিণত, বিচক্ষণ হয়েছেন এবং অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি আসতে পেরেছেন এটা তার সমালোচকরাও আজকাল স্বীকার করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৩.০-কে যে এখন বিস্তর বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে, তার পেছনে এই রাহুল গান্ধী ২.০-র সত্যিই খুব বড় অবদান আছে! – বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি