যুদ্ধ বাধলে ইউরোপ জ্বালানি পাবে কোথায়

ইউরোপ সময় সংবাদ
শেয়ার করুন

ইউক্রনে সংকটের কী হবে, এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া—কেউই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি; বরং দুই পক্ষই সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এরই মধ্যে কয়েক দিন ধরে আলোচনায় এসেছে নর্ড স্ট্রিম–২ পাইপলাইন। রাশিয়া থেকে গ্যাস নিতে এই পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে জার্মানি পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি দুই দেশই বলছে, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে হামলা চালায়, তবে নর্ড স্ট্রিম–২ পাইপলাইন চালুর কাজ পিছিয়ে যাবে।

এর মধ্য দিয়ে মূলত রাশিয়াকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতাটা একটু ভিন্নও বটে; কারণ ইউরোপের বাজারে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি রপ্তানি করে রাশিয়া।

ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্যই সেটা বলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যে চারটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে, সেগুলো হলো রাশিয়া, নরওয়ে, আলেজরিয়া ও কাতার। এর মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে আসে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ আর নরওয়ে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাকি যেসব দেশ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আসে, তা শতাংশের হিসাবে ১০-এর কম। একই চিত্র অপরিশোধিত তেলের ক্ষেত্রেও।

রাশিয়ার কাছ থেকে আমদানি করা হয় ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর কোনো দেশ থেকেই আমদানি করা অপরিশোধিত তেলের পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি নয়। এ ছাড়া ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ কাঠ ও কয়লা আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২০১৯ সালের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই কাঠ ও কয়লা আমদানি করা হয় ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

অর্থাৎ ইউক্রেনে হামলা চালালে ইউরোপ যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে এর মাশুল শুধু রাশিয়া একা গুনবে, এমনটা নয়। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালের ইসরায়েল-আবর যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। ছয় দিনের ওই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়া ও আলজেরিয়া একজোট হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পশ্চিম জার্মানিতে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৩ সালে আবারও আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধে। আবারও যুক্তরাষ্ট্রে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় আরব দেশগুলো। কারণ হলো ওই সময় ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ায় আরব দেশগুলো নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। যদিও এর প্রভাব পড়ে বিশ্বজুড়ে; সারা বিশ্বেই তেলের দাম বেড়ে যায়।
👉ডায়নামিক ওয়েবসাইট দিয়েই গড়ে তুলুন আপনার প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসার ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি। সেবা দেয়ার জন্য সবসময় আপনার পাশে আছে ‘ভার্সডসফট’।
সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলেছে। তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের জোট ওপেক আরও সংগঠিত হয়েছে, নীতি নির্ধারণে পরিবর্তন হয়েছে। তবে এমন সংকট তৈরির ঝুঁকি কি একেবারে কমে গেছে? এর উত্তর পাওয়া যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সময়ের পদক্ষেপেই। রাশিয়া যদি ইউক্রেনে হামলা চালায়, তবে ইউরোপে জ্বালানিসংকট দেখা দিতে পারে—বিষয়টি মাথায় রেখে তরলীকৃত গ্যাস পেতে কাতারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।

স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ সংকট সমাধানে বা কাতার থেকে গ্যাস পেতে দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্বালানি নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা আমোস হোচস্টাইনও এ কাজে নেমে পড়েছেন।

শুধু কাতারের সঙ্গে সঙ্গে নয়; গ্যাস পেতে আরও কয়েকটি আলোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া যদি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে এ ঘাটতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের এ নিয়ে মাথাব্যথার কারণও রয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপকে বেশ কিছু নিশ্চয়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে একটি হলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় বা রাশিয়া যদি যুদ্ধে জড়ায় এবং এর কারণে ইউরোপে জ্বালানিসংকট দেখা দিলে তা পূরণে সাহায্য করবে যুক্তরাষ্ট্র।

যুদ্ধে বেসামরিক মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়—এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যুদ্ধে যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর মধ্য অন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ও জ্বালানি সরবরাহ অবকাঠামো। এ কারণে ইউক্রেন-রাশিয়া প্রকারান্তরে পশ্চিমা বিশ্ব-রাশিয়া যুদ্ধে জড়ালে জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত বা এই অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না—এ নিশ্চয়তা নেই।
👉আপনার ব্যবসা বা কোম্পানি প্রোফাইল ওয়েবসাইট তৈরির জন্য আপনার পাশে সবসময় আছে ‘ভার্সডসফট’।
এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা বলেছেন জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হেবেক। গতকাল বুধবার তিনি বলেন, এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে জার্মানির অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ নিয়ে সরাসরি কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেছেন, ‘আমার ইউরোপীয় মিত্ররা গ্যাস সরবরাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তাদের গ্যাসের জোগান আসে রাশিয়া থেকে।’ এ ইস্যুতে গত মঙ্গলবার জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাঁখোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বরিস জনসন।

সামরিক অস্ত্রের বাইরে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই প্রাকৃতিক গ্যাসকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অস্ত্র।

আর রাশিয়া যে এ অস্ত্র ব্যবহার করবে, এর ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইউক্রেন হয়ে যে গ্যাস ইউরোপে যায়, তার সরবরাহ অর্ধেক করেছে রাশিয়া। এ ছাড়া ইউরোপের দেশগুলোর ভয়ের আরেকটি কারণ হলো সেখানে তুষারপাত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়বে এ অঞ্চলের দেশগুলো।

এ কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্র যতটা তোড়জোড় চালাচ্ছে, ইউরোপের দেশগুলো এ ক্ষেত্রে ততটাই হিসেবি। কারণ, তার অন্যতম চিন্তার জায়গা—জ্বালানি আসবে কোথা থেকে?

সূত্র: বিবিসি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওয়েবসাইট, রয়টার্স, এএফপি, দ্য গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *