মুসা আল হাফিজ কবি নাকি পুরোহিত? ।। মোহাম্মদ মহি উদ্দিন

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাত.

আপাদমস্তক আশাবাদের কবি বলে অভিহিত রবার্ট ব্রাউনিং (১৮১২-১৮৮৯) এর কবিতায় ঘুরফিরে যা আসছে তা হচ্ছে- ধর্মীয় আশাবাদ। The Patriot কবিতায় আমরা কী দেখি? কবিতার নায়ক যে কিনা মাত্র বছর খানেক আগে বীরের বেশে শহরে এসেছিল। দেশবাসীও বীরোচিতভাবে তাকে গ্রহন করে। বছর খানেক অতিক্রান্ত হতে না হতেই ভুল বুঝে তার স্বজাতি বীরত্বের গায়ে খলনায়কের তকমা লাগিয়ে দেয়। শহরে আসার সময় ফুল জুটলেও এখন পাথরের আঘাতে তাকে দেয়া হচ্ছে বিদায়ী সম্ভাষণ! মানুষের ভুল বিচারে সে যখন মর্মাহত, ক্ষতবিক্ষত ঠিক তখন মনে আশার ঝিলিক- জাগতিক না পাওয়ায় বা বিপদে লুকিয়ে আছে উত্তম প্রতিদান, উতকৃষ্ট মূল্যায়ন। পরম করুনাময়ের ফয়ছালাই তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ।

মুসা আল-হাফিজ যেন রবার্ট ব্রাউনিং এর রোহানি কবি-বন্ধু‚ যিনি কিনা অপ্রত্যাশিত বিপদকে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। আত্মজীবনী কবিতায় তিনি লিখেন

‘ও পিতা!
ইউসুফের রক্ত ঝরিয়েছে তার ভাইগণ
নেকড়ের কোনো দোষ নেই!

ও ইউসুফ!
এরা তোমারই ভাই
যদিও নেকড়ের অধিক!

তোমাকে শেষ করার
আয়োজনে হয়তো
রয়েছে মহাশুরু!

যাও,
মৃত্যুকূপের অন্ধকারে
আছে মিশর জয়ের চাবি!’

কবি মুসা আল-হাফিজের কবিতায় ধর্মীয় আশাবাদ তীব্র। আধারের বুকে একজন কবি হবেন দ্বীপশিখা। আর সেই দ্বীপশিখার উৎসমূল যখন অধ্যাত্মিকতার নূরের সাথে একাকার, তখন কোনো হতাশাই আর পথ রোধ করতে পারে না। যার বহিঃপ্রকাশ কবি মুসা আল হাফিজ করেছেন এভাবে-

‘আলকাতরা অন্ধকারে বিশ্বাসের জয় লিখে
রক্তের পিপাসা সেই আমার আমির খোঁজে
ইবলিস, জল্লাদ, বেশ্যা আর আগুনের বিরুদ্ধে
ছুড়ে দিলাম সত্তার অমিয় জিকির

হারানো আমির নৃত্যে মেতে উঠল রাতের হৃদয়।’ (রাত্রের কবিতা)।

The Patriot কবিতার নায়কের মতই কবি মুসা আল হাফিজের পুরুস্কৃত হওয়ার জায়গা- স্রষ্টা। এভাবে কবি যখন ঋষি হন আর ঋষি যখন কবি হন, পাঠকরা ভাগ্যবান হন। পুরোহিত-কবি মুসা আল হাফিজ পাঠককে করে তুলেন প্রার্থনার সঙ্গী, প্রেমার্থী যে প্রেম নিবেদিত হয় প্রভুর দিকে। সেই প্রেম প্রভু ও মানুষে, মানুষ ও সৃষ্টিজগতে একাকার। পরস্পর পরস্পরের পরমাত্মীয়।

আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের দিকপাল, যার কথা কিংবা যার কবিতা বাদ দিলে অপূর্ণ থেকে যাবে ইংরেজি আধুনিক সাহিত্য; তিনি হলেন নোবেল লরিয়েট টি. এস. এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫)। আমেরিকার সেইন্ট লুইস শহরে জন্ম হলেও ইংল্যান্ডের লন্ডনের মাটি থেকে মাথা তুলেছে তার কাব্য প্রতিভা। ফলে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন লন্ডনবাসী কবি পরিচয়। তার বিখ্যাত সেই The Waste Land কবিতা সম্পর্কে আমরা জানি। যেটি পৃথিবীকে দেখিয়েছিল কবিতা আর অকবিতার তফাৎ। একভাগে ছিল পড়াশুনাবিমুখ কবিদের অকবিতা আর অন্যদিকে ছিল মহর্ষির মত প্রাজ্ঞ কবিদের নির্মিত কবিতা। কবিতাটি পাঠকদের জন্যে এনেছিল জীবনের বার্তা; কবিদের জন্যে ছিল কবিতা শেখার বার্তা।

মুসা আল হাফিজের কবিতা ফ্যাক্ট ও ফ্যান্টাসির ভারসাম্যের মিশেল। যার ফলে উপস্থাপিত বয়ান কাল্পনিক না হয়ে, হয়ে ওঠে প্রমাণিক। এমনকি ক্রিয়েটিভ লেখালেখির পয়েটিক লাইসেন্স এর অজুহাত দেখিয়ে মনগড়া কথা বলেন না তিনি। সাধারণ গদ্যেও তার চরিত্র একই। ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্যে ব্যাপক দখল থাকার কারণে, প্রয়োজনীয় রেফারেন্স এনে নিজের চিন্তাকে করে তুলেন নৈর্ব্যক্তিক। তিনি অনুঘটকের ন্যায় ভূমিকা পালন করে পাঠককে সত্যনিষ্ট উপলব্দির দিকে অনুগামী করে তুলেন। লেখকের প্রাজ্ঞতা বা ধ্যনের সমস্তটুকু কলমের কালিতে উপস্তাপিত হতে অনেক সময় হেরফের হয়! এ ক্ষেত্রে মুসা আল হাফিজ অনন্য। তার কবিতা অগ্রসর পাঠকের। তিনি তরল ও সস্তা আবেগের ফেনা নিয়ে ব্যবসা করেন না। শব্দের অপচয় ও মর্মের অপমান তার কাব্যে নাজায়েজ।

মুসা আল হাফিজের অভিব্যাক্তি টিএস এলিয়টের মতো হয়ে উঠে সর্বজনীন। উচ্চমার্গীয় চিন্তা আর উপযুক্ত শব্দচয়নের মিত্রতা আছে তার রচনায়। উচ্চমর্গীয় গভীর দার্শনিক চিন্তাকে পাঠকের বোধগম্যতায় নিয়ে আসতে পারা খুব দুরহ ব্যাপার। এটা যে কোন কবির জন্য কঠিন। কারণ উচ্চমর্গীয় চিন্তা দৈনন্দিন শব্দে প্রকাশিত হতে চায় না আর দৈনন্দিন জীবনের শব্দগুলো সুগভীর তাত্ত্বিক আলোচনা উপস্থাপন করতে পারে না। তাই বাংলা সাহিত্য উচুমানের লেখা আর পাঠকের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের দুস্তর ব্যবধান। কবি মুসা আল হাফিজ এমন কবি যার শব্দচয়ন, উপমা, বলার ভঙিমা ধারণ করেছে উচ্চমার্গীয় দার্শনিক আলাপ, একই সাথে প্রোতিত হয়েছে পাঠকের অন্তরে! কবি মুসা আল হাফিজ এর লেখা হয়ে উঠছে, অরো হয়ে উঠবে, চাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের সুচিন্তার, সুদ্ধতার পথিকৃত।

The Waste Land কবিতায় টি. এস. এলিয়ট ১ম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইংল্যান্ড তথা গোটা ইউরোপের যন্ত্রনা, হাহাকার, হতাশা, বিকৃত যৌন কর্ম, পাপাচার, নৈতিক অধঃপতনে জর্জরিত অন্তঃসারশূন্য যাপিত জীবনের রীতি নীতি, অমানবিকতার আস্ফালন ইত্যাদি ফটোগ্রাফারের মত তুলে ধরেছেন। চারুশিল্পির মত শব্দের বুননে চিত্রিত করেছেন বাস্তবতা। কীভাবে মানুষগুলো ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের পবিত্রতা থেকে ছিটকে পড়ে লন্ডন শহর তথা পৃথিবীকে নরক বানিয়েছে। আধুনিক মানুষ সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি টেড় না পেলেও টি. এস. এলিয়ট তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে টেড় পেয়েছেন বলেই প্রশ্নাকুল মনে জানতে চেয়েছেন-

‘এখানে তো শুধু তুমি আর আমি
তাহলে উনি কে যে তোমার সাথে হাঁটছে?
গুনলে তো দেখি তুমি আর আমিই
কিন্তু যখনি সামনে থাকাই যেন কোনো এক সত্তা
সর্বদা আমাদের সাথে থাকে!’

একই কন্ঠস্বর কবি মুসা আল হাফিজের সেজদা কবিতায়-

‘যারা জানতে চান আমার অস্তিত্ব, সবার ভাবনায় আমি আছি।
আমার অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করছেন
তাদের মধ্যে যেমন আছি,
তেমনি যারা স্বীকার করছেন, তাদের মধ্যেও আছি!
আমাকে যে প্রমাণ করতে হচ্ছে আমার থাকা-
এটাই আমার থাকার প্রমাণ!’

সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের এমন মাধুর্যপূর্ণ কাব্যিক উপস্থপনা দেখে পাঠকরা ভাবুক না হয়ে পারে না! টি. এস. এলিয়ট আধুনিক মানুষ তথা সভ্যতার সমস্যা তুলে ধরেই দায়িত্ব শেষ করেন নি, দিয়েছেন সমাধানও। সমাধানের মূলমন্ত্র দিতে গিয়ে বেছে নিয়েছেন ভারতীয় উপনিষদের ধর্মীয় উপাখ্যান। কোনো এক সময় উত্তর ভারত খরা এবং দুর্ভিক্ষে জর্জড়িত ছিল। আক্রান্ত মানুষ ফরিয়াদ করেছিল পরমাত্মার কাছে।

প্রার্থনা কবুল হলো। অধিশ্বর বজ্রধ্বনির মধ্য দিয়ে সুধালেন একই শব্দ তিনবার- Da, Da, Da। এই শব্দগুলোর রয়েছে উপদেশমূলক অর্ন্তনিহিত অর্থ- প্রথম Da বলতে Datta যার অর্থ মানবকুলকে আত্মউৎসর্গীত মনোবাসনা রপ্ত করতে হবে; দ্বিতীয় Da বলতে Dayadhavam যার অর্থ সৃষ্টিকুলের প্রতি সহানুভুতিশীল হতে হবে; তৃতীয় Da বলতে Damyata যার অর্থ মানুষকে সংযমী হতে হবে। কবিতার শেষ অংশে বর্ণিত উপনিষদের এই ঘটনাটি প্রতিকী অর্থে বলা হয়েছে।

এককথায় যদি বলি তাহলে বলা চলে আধুনিক ইউরোপের মানুষকে তথা গোটা পৃথিবীর প্রতি টি. এস. এলিয়টের আহবান ছিল- হে মানবকুল যদি পরিত্রান পেতে চাও, চলে এসো ধর্মীয় অনুশাসনের ছায়াতলে! টিএস এলিয়টের মত কবি মুসা আল হাফিজের কাব্যদৃষ্টিও ধারণ করেছে আশপাশ- ক্ষুধা, শ্রেণীশোষণ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক নৈতিক স্খলন যার সমাধান হিসেবে কবি মুসা আল হাফিজও কাব্যের শৈলীতে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন ধর্মীয় প্রেসক্রিপসন। তাই তার কবিতা রঙ্গলীলা না হয়ে, হয়ে উঠেছে মানবমুক্তির পরিত্রাণপত্র। যা এসেছে কবি আর ঋষি মনের যুগলবন্ধী থেকে। তাই বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধুনিক কবি ও পুরোহিতের নাম- মুসা আল হাফিজ।

আট.

ধর্ম এবং কবিতার সম্পর্ক নিয়ে বাংলা সাহিত্যে একদম খোলাখুলি কথা বলেছেন ড. হুমায়ুন আজাদ। যদিও তাঁর মধ্যে অতিমাত্রার স্ববিরোধ আছে। প্রথাবিরুধী লেখক হিসেবে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তর্কে আমরা তার উদাহরণ প্রায়ই আনি। তাই তার প্রসঙ্গ এখানে না টেনে পারছি না।

ব্যক্তি হুমায়ুন আজাদ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অন্যদের মত ভন্ডামি না করে তার অবস্থানটা পরিস্কার করেছেন। লেখক হুমায়ুন আজাদ লেখায়ও পাঠককে তার অবস্থান পরিস্কার করে সততা দেখিয়েছেন, যেখানে অন্য অবিশ্বাসীরা সৎ সাহস না দেখিয়ে পাঠকের সাথে করেছেন প্রতারণা। ধর্মে বা বিশ্বাসে হুমায়ুন আজাদের আপত্তি থাকলেও, সাহিত্যে ধর্মের প্রভাব স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। তার লেখা একটা লাইন আমার অবিশ্বাস বই থেকে উদ্ধৃতি করতে ইচ্ছে হচ্ছে- ”বিশ্বের সাহিত্যের বড়ো অংশ দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ভিত্তির উপর…।”

ভাষাবিদ, সমালোচক এবং কবি হুমায়ুন আজাদ তার আমার অবিশ্বাস বইয়ে কবুল করেছেন যে, টি. এস. এলিয়টের কবিতায় ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মের প্রতি অঙ্গীকার কতো গভীর। এই বিশ্বাসটুকু তার ভালো লাগেনি। তা সত্তেও আজাদ অকপটে স্বীকার করেছেন টি. এস. এলিয়টের কাব্য প্রতিভার কথা। আজাদ লিখেছেন- ‘টি. এস. এলিয়টের অজস্র চিত্রকল্প আর উক্তিতে আমি মুগ্ধ…। … এগুলো ষাটের দশকে যেভাবে আলোড়িত করত আমাকে, যেভাবে আমার চোখের সামনে দাঁড় করাত অবনর্ণীয় দৃশ্যের পর দৃশ্য, আজো করে…। …আজো আমি গুন গুন করতে ভালোবাসি- “Here is no water but only rock/Rock and no water and sandy road”…“Who is the third who walks always beside you?”

এভাবে হুমায়ুন আজাদ- কবিতার ভাষ্যকে মেনে না নিলেও কবিতার সৌন্দর্য তথা টি. এস. এলিয়টের কাব্য প্রতিভার সমাদর করতে কার্পণ্য করেননি। তাছাড়া হুমায়ুন আজাদ এই বইয়ে- কবিতায় ধর্মীয় বিশ্বাস বা দর্শন এর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি থাকা নিয়ে আরেকটু খোলাসা করেছেন- ”দর্শন বাজে হয়েও কবিতা অসাধারণ হতে পারে, আর গুরুগম্ভীর দারুণ দর্শনসম্পন্ন হয়েও কবিতা হতে পারে শোচনীয়রুপে নিকৃষ্ট।” অর্থ্যাৎ কবিতায় কতখানি বিশ্বাস কতখানি অবিশ্বাস আছে, তার চেয়ে বড় কথা- কবিতায় শিল্পমান কতখানি আছে সেটা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হুমায়ুন আজাদ তার বক্তব্যের সততা ধরে রাখতে পারেননি কবি আল-মাহমুদের বেলায়। অচিরেই হুমায়ুন আজাদের খলিফারা মুসা আল-হাফিজের প্রশ্নেও একই পথে হাটবেন।

কেননা কবি মুসা আল হাফিজের কবিতার যে কাব্যশৈলী তা অস্বীকার করা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে কবি মুসা আল হাফিজের বেলায় হুমায়ুন আজাদের মতই স্ববিরোধীতা করা ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প হাতে নেই। আধুনিক বাংলা কবিতা নামে ১৯৯৪ সালে হুমায়ুন আজাদের একটি সংকলন বের হয়। যেখানে দাবি করা হয় – ”এ যাবৎ আধুনিক কবিতার যত সংকলন বের হয়েছে এমনকি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক কবিতা (১৯৫৪) এর সংকলনটিও ত্রুটি বহন করে। কেননা এখানে সংমিশ্রন ঘটেছে কবিতা ও অকবিতার।”

আমি অতীতের প্রকাশিত কবিতা সংকলনের অসম্পূর্ণতা কিংবা পূর্ণতার ব্যাপারে বলতে চাচ্ছি না। আমি বলতে চাচ্ছি- এই সংকলন নিয়ে। এই সংকলনে সবার জায়গা হলো ।অথচ আধুনিক কবিতার পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ খ্যাত আল মাহমুদ এর জায়গা হলো না। কেন হলো না? তার কবিতা আধুনিক হয়নি বলে? তার কবিতা অকবিতা বলে? চিত্রকল্প, রুপক, উপমা, অণুপ্রাস বিবর্জিত বলে? তার জায়গা হয়নি কেন, তা না বললেও পাঠকরা বুঝে নিয়েছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রলেপ কবিতায় ছিল বলেই বাতিল করা হয় আল-মাহমুদকে।

কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ উপন্যাসে সোনালি কবিনকে ব্যঙ্গ করে, আল মাহমুদকে- আলি মাহমুদ বলে, কবিতার মঞ্চ থেকে হুমায়ুন আজাদ ফেলে দিতে চেয়েছেন। কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাসান রশিদের কবি হওয়ার জন্যে রক্তমাংশের ঊর্ধ্বে উঠার যে সংগ্রাম, তা বাংলা সাহিত্যে অভূতপূর্ব। হুমায়ুন আজাদের সামগ্রিক কাব্য দর্শনের সাথে আল- মাহমুদকে অস্বীকার করার ব্যাপারটা হূমায়ুন আজাদের নিজেরই স্ববিরোধীতা। ধর্মীয় বিশ্বাস অপ্রিয় হওয়ার পরেও টিএস এলিয়ট এর কাব্য প্রতিভাকে গ্রহণ করতে পারলে আল-মাহমুদকে নয় কেন? আল-মাহমুদ কে বাদ দিতে যেয়ে আজাদের বইয়ের পূর্ণতাই বাদ পড়ে গেছে।

ফিরে আসি মুসা আল হাফিজের কথায়। যারা বর্তমানে ধর্মকে উৎখাত করা বা যৌনতার বিকৃত বর্ণনা দেয়া বা আবহমান বাংলার সংস্কৃতির বুকে চাবুক মারাকে মনে করেন কবিতা বা আধুনিক কবিতা, তাদের জন্যে মুসা আল হাফিজ পয়েটিক ডিফেন্সের নাম। কবি আল মাহমুদের সময়ে ডানে বামে তাঁর সমকক্ষ মেধাবী ছিলেন।আল মাহমুদ সবাইকে ছাপিয়ে উঠে এসেছেন। কিন্তু কবি মুসা আল হাফিজের সময়টা একান্ত তার। নিছক কবিতা দিয়ে তাকে সংজ্ঞায়িত করার কোনো সুযোগ নেই।তার চিন্তার জগতটা অনালোচিত হলেও বিপুলা। তাঁর গভীরতা, ব্যাপ্তি ও বহুমাত্রিকতার তুলনা করবো, এমন প্রতিভার সন্ধান মিলছে না, অদুর ভবিষ্যতেও দেখছি না।

ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস , সংস্কৃতি, সাহিত্য এই পাচটা শাখাকে একসাথে ধারন করে কলম ধরার নজির বাংলা সাহিত্যে খুব একটা নেই। বরং উল্টোটা ঘটেছে, বিরোধ বেঁধেছে, লেখকের এক জ্ঞান পথ রোধ করেছে আরেক জ্ঞানের। না চাইলেও ব্যাক্তি লেখকরা চিন্তায় তৈরী করেছেন বৈরিতা! অনেকেই বহুমাত্রিত জোতির্ময় হতে যেয়ে থুবড়ে পড়েছেন, মুখ থুবরে পড়ার প্রথম সারিতে আছেন অনেকেই, সেদিকে যাচ্ছি না। মুসা আল হাফিজ এখানে ব্যতিক্রম। তিনি অনেকটা শেক্সপিয়ারের মত ওয়ান ম্যান শো। তাই তাকে মোকাবেলার জ্ঞানীয় পথ বন্ধ, তাই অজ্ঞতার কোন ভয়ঙ্কর পথ কেউ বেছে নেয় কিনা, আমি জানি না। তাই প্রার্থনা রেখে গেলাম কবি মুসা আল হাফিজ এর জন্যে।

নয়.

গ্রিক থেকে শুরু করে পুরো ইউরোপের কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে অলিম্পিয়াসে বাসরত দেব-দেবীদের কল্পকাহিনী। শুধু কি কবিতায়? অলিম্পিয়াস তথা পৌরাণিক কাহিনী প্রচারে অনেকটা পাদ্রিসুলভ ভূমিকা পালন করেছে পুরো ইংরেজি সাহিত্য! তাইতো ইংরেজি সাহিত্যের নির্যাস পেতে হলে আগে গিলতে হয় গ্রীক পুরানের ভেতর- বাহির। সেখানে আমরা কেন নিজের ধর্মীয় বোধকে, ধর্মীয় অনুষঙ্গকে (যা সাহিত্য রচনার উর্বর পটভূমি হতে পারত সব লেখকদের জন্যে। যেটা ইতোমধ্যে কবি মুসা আল হাফিজ করে দেখিয়েছেন!) শত্রু বানিয়ে খুনের গোপন বাসনা লালন করছি?

কবিতায় ধর্ম আনলেই আপনি সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবেন, এমন না। আমাদের মহামতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি বাংলা সাহিত্যের পুরো আকাশজুড়ে বিরাজমান, যখন Song Offerings এ ঋষির মত অঞ্জলি দিয়ে যাচ্ছিলেন, প্রতিটি শব্দের ভেতরে, তখন সচেতন পাঠক সাম্প্রদায়িকতা খুঁজে পায় নি, পেয়েছে একজন কবির কাব্যিক আরাধনা। যার মধ্যে দিয়ে সকল ধর্মের মানুষ একটা পথের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করেছে। ইউরোপও তাই দেখেছে, বস্তুবাদের জোয়ারে তারা যখন কুলহারা, তখন রবীন্দ্রনাথের আরাধনায় তথা বিশ্বাসের নৌকায় উঠতে চেয়েছে, এ জন্যেই তো সেকালের প্রতিষ্টিত ইংরেজ কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, নোবেল কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন যোগ্য রবীন্দ্রনাথের গলায় পুরুস্কারটি পরিয়ে দিতে। Song Offerings এর দ্বিতীয় মুদ্রণে ডব্লিউ. বি. ইয়েটস ভুমিকাও লিখে দিয়েছিলেন। ডব্লিউ. বি. ইয়েটস আলোড়িত হয়ে বলেছিলেন- “Translations from Rabindranath Tagore have stirred my blood as nothing has for years…”

১৯১৩ সালে মূলত রবীন্দ্রনাথকে পুরুস্কার দেয়া হয়নি! তাহলে কাকে দেয়া হলো? সৃষ্টিকর্তার প্রতি রবীন্দ্রনাথের নিবেদিত আত্মসমপর্ণ এবং তার শিল্পমূল্যকে সেদিন পুরুস্কৃত করা হয়েছিল। তাই তো ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের কবিতার ব্যাপারে অকপটে বলতে পেরেছিলেন- “কবিতাগুলো এমন মাটি থেকে জন্মেছে, যেখানে কবিতা আর ধর্ম একই বাঁধনে বাঁধা ( … they yet appear as much the growth of the common soil as the grass and the rushes. A tradition, where poetry and religion are the same thing)।”

যেনতেন কেউ মন্তব্যটা করলে ছুড়ে ফেলা যেত, বলেছেন বিংশ শতাব্দির অন্যতাম মেধাবী একজন কবি। আমাদের আদি বই চর্যাপদ এ যদি ফিরে তাকাই সেখানেও তো একটা ধর্মের গুণকীর্তনই পাই। যদিও আজকাল সেই চর্যাপদেরও যত্ন নেই। কবি মুসা আল-হাফিজ শেকড়মুখী কবি তাই তো ব্যথিত হচ্ছেন তার আদি কবিদের প্রতি সমকালীনদের উদাসীনতা দেখে। লিখছেন-

‘নদীও তো কোথাও আবৃত্তি করছে না চর্যাপদ
একটি ক্ষুধার্ত ভ্রমর জানিয়ে গেল
বাগানে একটি ফুলও আর ফুটবে না
রাত্রির নিঝুম প্রহরে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ (ইনসাফের প্রতি খোলা চিঠি)।

ডব্লিউ. বি. ইয়েটস এর কথাকে একটু বর্ধিত করে আমি বলব- নদীতে যেভাবে ভেতর থেকে আপন মনে চর জেগে উঠে, প্রত্যেক দেশের কবিতাও তেমনি আপনা আপনিই জেগে উঠবে তার মাটি ও মানুষ থেকে। আরেকটু গভীর করে বললে- প্রতিটি বাঙালির অন্তর খুঁড়লে অতিন্দ্রিয় আধ্যাত্মিকতার ঘ্রানের ছড়াছড়িই তো পাই। সুতরাং কবিতায় ধর্মীয় বিষয় আসাটা অপরিহার্য। আর সেটিই করেছেন কবি মুসা আল হাফিজ । এটা নিয়ে বাকা চোখে তাকানোর সুযোগ কই?

হ্যাঁ তাকানোর একটা ক্ষেত্র আছে, তা হলো- শিল্পমান। বিষয়গত দিক এর পাশাপাশি কবি মুসা আল হাফিজের কবিতার অন্তর্ছন্দ, গঠনশৈলী, শব্দ-সমন্বয়, অর্থের দ্যোতনা, বহুমাত্রিক রিদম, রুপক, চিত্রকল্প উপমা, মেটাফর, অনুপ্রাস, কনসিট- তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারবে না যে কোনো সr সমালোচক।

দশ.

আমি বিশ্বাস করি সময়ের পালাবদলে জীবন ধারা এবং কবিতার ধারায় পরিবর্তন হবেই। কবিতা বিভিন্ন বাক নেবে, যেটা আগেও নিয়েছে এবং এটাই জীবন এবং কবিতার অনিবার্য নিয়তি। তবে এতে কবিতার ভাষা, তাল- লয়, ঢং বদল হলেও সত্যের বদল হয় না। কেননা সত্যের শুরু ও শেষ স্বরূপ একই। তাই মুসা আল-হাফিজ প্রাসঙ্গিক আছেন, থাকবেন। কেননা নদী যেমন জলকে বহন করে, তার কবিতা তেমনি সুন্দর ও সত্যকে বহন করেছে, যা প্রবাহমান থাকবে অনাদিকাল।

আমরা আমাদের যুগের পথে হাঁটব। তবে নিজের স্বকীয় পথ তৈরী করতে হলে জানতে হবে পূর্বসুরীদের পথ। অনেকগুলো পথ জানা হলে নিজের পথটা বেরিয়ে আসবে সহজে সঠিকভাবে; আর এই পথ হবে টেকসই, না হয় কোথাও ফারাক থেকে যাবে। প্রয়োজনে আমরা অতিক্রম করব পূর্বসুরীদেরও। তবে এই অতিক্রমটা তাদেরকে জেনে, অবহেলা করে নয়। না হয় এটা অতিক্রমের বদলে হবে বিচ্ছিন্নতা। কবিতা কোনো বিচ্ছিন্ন শাখা নয়, তার আছে সুগভীর শেকড়। এই ক্ষেত্রে শেকড় সন্ধানী কবি মুসা আল হাফিজ এর কবিতা অতীত আর বর্তমানের সেতু হয়ে উঠেছে।

পাঠকরা ভাববেন না যে আমি ইংরেজি কবিতার ধর্মীয় ব্যাপারগুলো এনেছি মুসা আল হাফিজকে সেনাপতি বানিয়ে বাংলা কবিতায় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। আমি কৃষকের লাঙ্গল ছুয়ে বলছি, শ্রমিকের দেশপ্রেম মাখা ঘাম ছুয়ে বলছি, আমার গর্ভধারিনী মা’কে ছুয়ে বলছি এবং আমার ভবিষ্যতব্য কবরের মাটি ছুয়ে বলছি- আমি এসকল প্রসঙ্গ এনেছি- কবিতাকে রক্ষা করতে।

অপ্রিয় হলেও সত্য, বর্তমানে একটা মেধাবী প্রজন্ম সাহিত্য চর্চায় নামলেও তাদেরকে ধর্মবিদ্বেষী করে তাদের মেধাকে একমুখী করে কী ক্ষতিটা না-ই করছেন কেউ কেউ! গোত্র বিশেষের লাভ হলেও ক্ষতি হচ্ছে কবিতার তথা পুরো বাংলা সাহিত্যের। আমার কথাগুলো সবাইকে যে মেনে নিতে হবে , তা নয়। উপলব্দির ব্যাপারে ভিন্নমত থাকতে পারে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার বক্তব্য মানতেই হবে এমন চরমপন্থাতে আমি নাই। বোধের ব্যাপারে চূড়ান্ত বলতেও কিছু নেই। কেউ যদি মনে করে আমি যে পথে হেঁটেছি এটাই একমাত্র পথ, এই পথেই সবাইকে হাঁটতে হবে, এটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়, যদিও এই বাতুলতা অনেকেই লালন করেন আজকাল। প্রগতিশীলতার কয়েকটা মাপকাটির মধ্যে একটা অন্যতম মাপকাটি হচ্ছে- সহনশীলতা। এটা কবিতা-প্রেমী বা কবিতা-কর্মীদের মধ্যে থাকা চাই। ক্ষুদ্র চিন্তা মানুষকে ক্ষুদ্র করে। অন্যদিকে সহনশীল চিন্তা মানুষকে বড় করে। মানুষ, পৃথিবী তথা মহাবিশ্বের চেয়েও বড়- একমাত্র চিন্তার ব্যাপকতার বলেই।

সর্বশেষ একটা পরিচিত গল্প দিয়ে কবি মুসা আল হাফিজের কাব্যমূল্যায়ন শেষ করতে চাই। কনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব) সর্বজনবিদিত চীনের একজন লেখক ও দার্শনিক। যার জ্ঞান ও সদগুণ তার চারপাশকে বিমোহিত করে রেখেছিল। তার কাছে একবার অগণিত অনুসারি এসে হাজির হন। তারা জানতে চান- ”আপনি নিশ্চয়ই স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা জানেন। এই রাস্তার ব্যাপারে আমাদের বলুন!”

কনফুসিয়াস আসলে স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা জানেন না। এই না জানাকে কী করে এই শুভাকাঙ্খিদের সামনে বলবেন, তিনি বুঝতে পারছেন না। অনুসারীরা এই সত্য মেনে নিতেও সম্ভবত প্রস্তুত না। একদিন তিনি নিজ সন্তানকে ডাকলেন। বললেন বাবা অনুসারীদের সত্যটা বলতে না পারলেও অন্তত তোমার কাছে বলতে আমার দ্বিধা নেই । আমি সত্যি স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা জানি না। তবে এই নাও একখানা বই। যেটা তোমাকে এবং তোমাদেরকে স্বর্গে যাওয়ারর রাস্তা দেখালে দেখাতেও পারে! বইটি ছিল কবিতার। ঠিক একইভাবে আমিও পাঠকদেরকে বলতে চাই- এই নাও কবি মুসা আল-হাফিজের কবিতার বই, তার আত্মায় যে সত্যের আওয়াজ রয়েছে, তাতে স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা পেলেও পেতে পারেন।

* মোহাম্মদ মহি উদ্দিন পিএইচডি গবেষক, এডুকেশনাল লিডারশীপ, পলিসি এন্ড টেকনলজি স্টাডিজ, আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র mohi.sust6049@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *