মুসলিম নেতা ওয়াইসির টক্কর নিতে হায়দ্রাবাদে হিন্দুত্বের মাধবীলতা

এশিয়া সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

শুভজ্যোতি ঘোষ বিবিসি নিউজ

প্রায় সাড়ে চারশো বছরের প্রাচীন শহর হায়দ্রাবাদে আইকনিক চারমিনার, মক্কা মসজিদ ও তার আশেপাশে যে ঘিঞ্জি ‘ওল্ড সিটি’ এলাকা, সেখানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বাসিন্দাই মুসলিম। ডেকান মালভূমিতে কুতুব শাহী বংশের প্রতিষ্ঠিত এই নগরীটি দীর্ঘকাল মুঘল ও নিজামদের শাসনে ছিল, ফলে বহু বছর ধরেই হায়দ্রাবাদ ভারতে ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবনচর্যার একটি প্রধান কেন্দ্রও বটে।

গত চল্লিশ বছর ধরে একটানা ভারতের পার্লামেন্টে এই হায়দ্রাবাদ আসনটির প্রতিনিধিত্ব করছে ওয়াইসি পরিবার, যারা অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) নামে রাজনৈতিক দলটির প্রতিষ্ঠাতা। শহরে অবশ্য দলটিকে ছোট করে সবাই ‘মজলিস’ নামেই ডাকে।

১৯৮৪ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদের এমপি ছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন ওয়াইসি। বয়সের কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি সরে দাঁড়ানোর পর গত বিশ বছর ধরে হায়দ্রাবাদের এমপি তারই বড় ছেলে, আসাদউদ্দিন সালাউদ্দিন ওয়াইসি।

এবারেও তিনি ওই একই আসনে লড়ছেন, আর ঘটনাচক্রে শহরে ভোটগ্রহণের দিনটিতেই (১৩ মে) ওয়াইসি ৫৫তে পা রাখছেন।

২০০৪ থেকে হায়দ্রাবাদে ওয়াইসির জয়ের ব্যবধানও ক্রমশই বেড়েছে। প্রথমবার লোকসভা ভোটে লড়ে তিনি জিতেছিলেন লাখখানেক ভোটে, আর ২০১৯ সালে সেই মার্জিন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২ লক্ষ ৮২ হাজারে।
বিগত দুই দশকে ওয়াইসি হায়দ্রাবাদেই শুধু নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলেননি, সমগ্র ভারতেও মুসলিম সমাজের অন্যতম প্রধান একজন নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

অযোধ্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত রায়, তিন তালাক নিষিদ্ধ করতে পার্লামেন্টে আইন, জঙ্গি সন্দেহে মুসলিম যুবকদের বিনা বিচারে আটকে রাখা কিংবা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউসিসি) চালু করার উদ্যোগ– মুসলিম সমাজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন অজস্র ইস্যুতে যিনি সবার আগে বা সব চেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তিনি অবশ্যই আসাদউদ্দিন ওয়াইসি।

কেউ কেউ এমনও বলেন, একদা ভারতীয় মুসলিমদের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডকেও এককভাবে ছাপিয়ে গেছেন এই একজন রাজনীতিবিদ। তবে রাজনৈতিক স্তরে তার সমালোচনাও আছে বিস্তর।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি স্থির করেছে, তারা হায়দ্রাবাদ আসনে এহেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি-কে কিছুতেই ‘ওয়াকওভার’ দেবে না। দেশে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ারও আনেক আগে তারা ঘোষণা করেছে, হায়দ্রাবাদ আসনে ওয়াইসির বিরুদ্ধে লড়বেন সমাজকর্মী, শিল্পপতি ও ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী কোম্পেলা মাধবীলতা – যিনি রাজনীতিতে একেবারেই নবাগত।

হায়দ্রাবাদের মতো হাই-প্রোফাইল আসনে তিনি কীভাবে বিজেপির মনোনয়ন পেলেন তা খুব একটা স্পষ্ট নয়।
তবে মাধবীলতার নাম ঘোষণার পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, আরএসএস ক্যাডাররা মাধবীলতার প্রচারে দিন-রাত এক করে দিচ্ছেন – এবং হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রে বিজেপি যেরকম উজ্জীবিত ও প্যাশনেট ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে তা আগে কখনো দেখা যায়নি।

এই প্রচারণায় খুব সূক্ষ্মভাবে হিন্দুত্বের তাসকে যেমন ব্যবহার করা হচ্ছে, তেমনি বিশেষ করে মুসলিম মহিলাদের ভোট টানতেও মাধবীলতা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছেন না। এরই মধ্যে রামনবমীর মিছিল থেকে আকাশে ছোড়া মাধবীলতার একটি ‘কাল্পনিক তিরে’র নিশানা ছিল রাস্তার পাশের একটি মসজিদ– এমন একটি অভিযোগকে ঘিরেও তোলপাড় পড়ে গেছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, যার জেরে পুলিশ স্টেশনেও হাজিরা দিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। এই উত্তপ্ত নির্বাচনি আবহেই শহরের সাম্প্রদায়িক বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে ‘রাজাকার’ নামে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত একটি মুভি– যেখানে নিজাম শাসনের একেবারে শেষ পর্বে তার মুসলিম মিলিশিয়া বাহিনীর চালানো ‘অত্যাচার ও নির্যাতনের’ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

সমালোচকরা যদিও ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ বা ‘কাশ্মীর ফাইলসের’ মতোই এটিকেও আপাদমস্তক ‘প্রোপাগান্ডা ফিল্ম’ বলেই বর্ণনা করছেন, ঘটনা হলো হায়দ্রাবাদের সব মাল্টিপ্লেক্স ও সিনেমাহলে ‘রাজাকার’ রমরম করে চলছে। অনেকে তো এমনও বলছেন, ইসলামোফোবিয়ার সব মাত্রাই ছাড়িয়ে গেছে ‘রাজাকার’।

সব মিলিয়ে হায়দ্রাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনি লড়াই এবারে একটা সম্পূর্ণ অন্য রকম মাত্রা নিয়েছে– হাইভোল্টেজ সেই প্রচারযুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার ছায়াও পড়ছে অবধারিতভাবে।

‘নকিব-ই-মিল্লাত’ না কি ‘ভোট-কাটুয়া’?

হায়দ্রাবাদে আসাদউদ্দিন ওয়াইসির অনুগামী ও দলীয় সমর্থকরা তাকে ‘নকিব-ই-মিল্লাত’ নামেও ডাকেন। এই কথাটার মানে, সম্প্রদায়ের নেতা। মুসলিম সমাজের জন্য বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি যেভাবে দীর্ঘকাল ধরে নিরলস আন্দোলন করে যাচ্ছেন, তাতে এই খেতাব তাকেই মানায়– এটা নিয়ে ওয়াইসির অনুগামীদের অন্তত কোনও সংশয় নেই।

তবে জাতীয় রাজনীতির পরিসরে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি-র আর একটা পরিচয়ও আছে, সেটা ‘ভোট-কাটুয়া’ বা ‘বিজেপির বি-টিমে’র। আসলে এআইএমআইএম দলটিকে তিনি যবে থেকে হায়দ্রাবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ বা কর্নাটকের মতো বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছেন– তখন থেকেই তাকে এই অপবাদও শুনতে হচ্ছে।

কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি বা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মতো যে দলগুলির মুসলিমদের মধ্যে শক্ত জনভিত্তি আছে, মুসলিম ভোটে ভাগ বসিয়ে ওয়াইসির দল আসলে তাদের হারিয়ে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে– এটাই তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ।

এই দলগুলোই আসাদউদ্দিন ওয়াইসিকে ভোট-কাটুয়া বা বিজেপির বি-টিম বলে বর্ণনা করে থাকে, ওয়াইসি যে অভিযোগ সব সময় দৃঢ়ভাবে নাকচ করে এসেছেন। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে তিনি যে একই সঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত একটি চরিত্র, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

বিবিসিকে তিনি একবার এমনও বলেছিলেন, “খুব ছোটবেলা থেকে আমি বাড়ির সামনে আরএসএস গুন্ডাদের নোংরা স্লোগান দিতে শুনেছি। ওদের প্রতিবাদ করে জেলে পর্যন্ত গিয়েছি।” “ফলে কীভাবে বিজেপি-আরএসএসের মোকাবিলা করতে হবে, সেটা অন্তত আমায় কংগ্রেসের কাছে শিখতে হবে না!”

বস্তুত কংগ্রেস-সহ দেশের অনেকগুলো বিরোধী দল মিলে এবারের ভোটের আগে ‘ইন্ডিয়া’ নামে যে জোট তৈরি করেছে, এআইএমআইএম তারও শরিক হয়নি। ইন্ডিয়া জোটের কোনও বৈঠকেও মুখ দেখাননি ওয়াইসি।

হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক শাহিদ মিও কিন্তু মনে করেন, জাতীয় রাজনীতিতে ওয়াইসি-কে নিয়ে যাই বিতর্ক থাকুক– হায়দ্রাবাদের মুসলিমদের কাছে অন্তত তিনিই শাহেনশাহ!

অধ্যাপক মিও বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ওয়াইসি পরিবার এই শহরে একটা রাজনৈতিক খানদানের প্রতীক।”
“আর শুধু রাজনীতিবিদ বা এমপি হিসেবে তার ভূমিকাই নয়, পারিবারিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি কিংবা ট্রাস্টের হাসপাতালে গরিব মুসলিম রোগীদের ভর্তি করানো– এই সব নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি ওল্ড সিটিতে এমন একটা ইকোসিস্টেম তৈরি করে ফেলেছেন, যার ফলে আজও হায়দ্রাবাদের ভোটাররা ওয়াইসি বলতে অজ্ঞান,” জানাচ্ছেন শাহিদ মিও।

তবে ইসলামিক স্টেটের কথিত ‘টেরর মডিউলে’ জড়িত পাঁচজন মুসলিম যুবককে আইনি সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে ওয়াইসিকে অতীতে জেলেও যেতে হয়েছে। ইসলামি জীবনচর্যার বিভিন্ন রক্ষণশীল দিককে সমর্থন করার জন্যও তিনি সমালোচিত হয়েছেন।

এই একই আসাদউদ্দিন ওয়াইসি আবার ভারতে মুসলিম তীর্থযাত্রীদের হজের সরকারি ভর্তুকি তুলে দিয়ে সেই টাকা মুসলিম মেয়েদের শিক্ষায় খরচ করারও সুপারিশ করেছেন। দেশে বিফ নিষিদ্ধ করার দাবির বিরুদ্ধেও তার জোরালো অবস্থান সুবিদিত।

এবারের ভোটের প্রচারেও হায়দ্রাবাদে গলির ভেতর একটি গরুর মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াইসি বিক্রেতাকে বলেছিলেন, “কী সব ঠিকঠাক চলছে তো? কেটে যাও, কেটে যাও!” সেই ভিডিও নিমেষে ভাইরাল হয়েছিল যথারীতি, এবং নিজের ভোটারদের কাছে তার জনপ্রিয়তাও বাড়িয়েছিল।

লন্ডনের লিঙ্কনস ইন থেকে পাশ করা ব্যারিস্টার ও ছয় সন্তানের পিতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও অত্যন্ত দক্ষ। সুবক্তা এই সাংসদ একজন গড়পরতা এমপি-র চেয়ে সভায় প্রায় চারগুণ বেশি প্রশ্ন তুলেছেন, ১৫তম লোকসভায় পেয়েছেন সেরা সাংসদের পুরস্কারও। এবারে এমপি বা এমএলএ পদের জন্য তিনি জীবনের সপ্তম নির্বাচনে লড়ছেন।

গত তিরিশ বছরে কোনওদিন তাকে ভোটে জেতা নিয়ে প্রায় ভাবতেই হয়নি, কিন্তু এবারে হায়দ্রাবাদে তাকে যে বেশ অন্য রকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই!
মাধবীলতার হিন্দুত্ব তির

গত ২রা মার্চ বিজেপির প্রকাশিত প্রার্থী তালিকায় যখন হায়দ্রাবাদ আসনে কোম্পেলা মাধবীলতার নাম ঘোষণা করা হয়, তখন দলের অনেক পুরনো নেতা-কর্মীই চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তিনি আবার কে?”

আসলে মাধবীলতার নাম যখন হায়দ্রাবাদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হয়, তিনি বিজেপি-র সদস্যই ছিলেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি দলে যোগ দিয়েছেন সদ্যই। তবে বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক আরএসএসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি তিনি নিজেকে ‘আরএসএসের কন্যা’ বলেও পরিচয় দিয়েছেন।

আরএসএসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, সঙ্ঘের ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’ নামে যে শাখাটি রয়েছে, তার প্রধান এবং আরএসএসের প্রবীণ নেতা ইন্দ্রেশ কুমারই মাধবীলতার নাম হায়দ্রাবাদ আসনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। আসলে তিন তালাক নিষিদ্ধ করার জন্য যখন আইনের খসড়া তৈরির কাজ হচ্ছিল, তখন ভুক্তভোগী মুসলিম নারীদের সঙ্গে কথা বলে বহু ‘কেস স্টাডি’ তৈরির কাজে মাধবীলতা যুক্ত ছিলেন।

মুসলিম নারীদের সঙ্গে দীর্ঘকাল কাজ করার অভিজ্ঞতার সুবাদে বিবাহবিচ্ছিন্না নারীদের ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন কীভাবে সম্ভব, তা নিয়েও মাধবীলতার প্রচুর গবেষণা ছিল এবং আইনের খসড়ায় সেগুলো মূল্যবান ‘ইনপুট’ হিসেবে কাজ করেছিল। সেটার ভিত্তিতেই বিজেপির প্রার্থী হয়েও তিনি কিন্তু এখন বিশেষ করে হায়দ্রাবাদের মুসলিম নারীদের কাছেও ভোট চাইছেন।

প্রার্থী পদে তার নাম ঘোষিত হওয়ার পরেই মাধবীলতাকে জাতীয় পর্যায়ের একটি টেলিভিশন শো ‘আপ কি আদালতে’ আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং জনপ্রিয় টিভি অ্যাঙ্কর রজত শর্মা তাকে সেই অনুষ্ঠানে সাজানো কাঠগড়ায় বসিয়ে জেরা করেন।

ওই শো প্রচারিত হওয়ার পর দিনই প্রধানমন্ত্রী মোদী টুইট করেন, “অসাধারণ একটি এপিসোড। মাধবীলতাজি, আপনি অসাধারণ যুক্তি ও আবেগ দিয়ে কয়েকটি বলিষ্ঠ পয়েন্ট তুলে ধরেছেন। আপনাকে শুভেচ্ছা!” তিনি দেশবাসীকে ওই এপিসোডের রিপিট টেলিকাস্ট দেখারও আহ্বান জানান। মাধবীলতাও প্রায় রাতারাতি জাতীয় স্তরে একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন।

ফলে হায়দ্রাবাদে মাধবীলতার ‘রাজনৈতিক লঞ্চিং’ যে একটি সুপরিকল্পিত ও পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমনিতে মাধবীলতা অবশ্য তেলেঙ্গানার সুপরিচিত বিরিঞ্চি হসপিটাল গ্রুপের চেয়ারপার্সন, জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এবং ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পীও। মনোনয়ন পেশ করার সময় তিনি নিজের নামেই ২২১ কোটি রুপির বিশাল সম্পত্তির হিসেব দিয়েছেন।

ব্যতিক্রমী এই নারী নিজের তিন ছেলেমেয়েকেও কখনও স্কুলে পাঠাননি, ‘হোম স্কুলিং’ করিয়েই আইআইটি-তে পড়তে পাঠিয়েছেন। তবে তার বেড়ে ওঠা অত্যন্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে। হায়দ্রাবাদের ওল্ড সিটিতেই ইয়াকুতপুরার সন্তোষনগর কলোনিতে অতি সাধারণ একটি পরিবারে তার জন্ম, প্রচারের সময় যে কথা তিনি মাঝে মাঝেই উল্লেখ করছেন।

প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই শহরের অলিতে গলিতে প্রচারে গিয়ে তিনি বারেবারে একটা কথাই বলছেন, এই যে ওয়াইসি প্রতিবার লক্ষ লক্ষ ভোটে জেতেন তার বেশিটাই জাল বা ভুয়া ভোটের ভিত্তিতে। এটা বন্ধ করা গেলে হায়দ্রাবাদে বিজেপির জেতা সম্ভব বলেও দাবি করছেন মাধবীলতা।

বস্তুত গত দেড় বছরে হায়দ্রাবাদের ভোটার তালিকা থেকে নির্বাচন কমিশন কয়েক লক্ষ নাম বাদও দিয়েছে– যাদের অনেকেই হয়তো আর বেঁচে নেই, বা যারা আর সেখানে থাকেনও না। এই পদক্ষেপ বিজেপিকে বেশ আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। তবে রামনবমীর দিন (১৭ এপ্রিল) বিজেপির মিছিলে মাধবীলতার ‘ছোড়া’ একটি ‘তির’-কে ঘিরেই এখন বিতর্ক তুঙ্গে।

সে দিন সন্ধ্যায় হুডখোলা গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে মাধবীলতা হিন্দুদের দেবতা রামচন্দ্রের ভঙ্গিতে আকাশে একটি কাল্পনিক তির ছুড়ে দেখিয়েছিলেন। পরে ভিডিওতে দেখা গেছে, যে দিকে লক্ষ্য করে তিনি তিরটি ছোড়েন তার বেশ কাছেই ছিল সিদ্দিয়াম্বর বাজার মসজিদ।

মসজিদে তির ছোড়ার ভঙ্গি করে তিনি সাম্প্রদায়িক পরিবেশ বিষিয়ে তুলছেন, এই অভিযোগে মাধবীলতার বিরুদ্ধে এফআইআর-ও রুজু হয়েছে। তিনি থানায় নিয়মমাফিক হাজিরাও দিয়েছেন।

হায়দ্রাবাদের বর্ষীয়ান সাংবাদিক টি এস সুধীর অবশ্য এই ঘটনাতে মাধবীলতাকে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতে রাজি। “আপনি যদি ভালো করে ভাইরাল ভিডিওটা দেখেন, তাহলে বুঝবেন মাধবীলতা যখন ওই ভঙ্গিটা করছেন, তার ফ্রেমে কিন্তু মসজিদ নেই। ক্যামেরা এরপর বিশ থেকে ত্রিশ ডিগ্রি প্যান করলে তখনই কেবল মসজিদটা দেখা যাচ্ছে।”

“আর তিনি একজন ভরতনাট্যম শিল্পীও। কাজেই রামচন্দ্রের জন্মদিনে ভক্তদের উজ্জীবিত করতে যদি নাচের ভঙ্গিমায় রামচন্দ্রের মতো তির ছুড়েও থাকেন, তাহলে তাকে বোধহয় দোষ দেওয়া যায় না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। তবে এই কাল্পনিক তির যে হায়দ্রাবাদের ভোটযুদ্ধে ধর্মের ন্যারেটিভকে আরও প্রবলভাবে নিয়ে এসেছে, তা টি এস সুধীরও মানছেন।

সিনেমাহলে যখন ‘রাজাকার’

রাজপথে যখন চলছে ওয়াইসি বনাম মাধবীলতার হাইভোল্টেজ ক্যাম্পেইন, তখন শহরের সিনেমা হলগুলোতে রমরম করে চলছে একটি বিতর্কিত বহুভাষী সিনেমা– যার পুরো নাম ‘রাজাকার : আ সাইলেন্ট জেনোসাইড অব হায়দ্রাবাদ’।

১৯৪৭-এ ভারতের স্বাধীনতার পরও পুরো এক বছর হায়দ্রাবাদ নিজামের শাসনাধীন ছিল। ‘৪৮র সেপ্টেম্বরে তখনকার উপপ্রধানমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল হায়দ্রাবাদে সেনা পাঠিয়ে ‘অপারেশন পোলো’-র মাধ্যমে হায়দ্রাবাদের ভারতভুক্তি ঘটান।

হায়দ্রাবাদের শেষ নিজাম মীর ওসমান আলি খানের অনুগত মিলিশিয়া বাহিনী ‘রাজাকার’ ওই সময় শহরের হিন্দু প্রজাদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেই কাহিনি নিয়েই তৈরি হয়েছে এই ছবিটি। সেই রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন কাশিম রাজভি, যিনি আবার এআইএমআইএম দলের রাজনৈতিক পূর্বসূরী ‘এমআইএম’-এরও নেতা ছিলেন।

তবে এই ছবিটি বানানো যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই, তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। রাজাকার ছবির প্রযোজকও তেলেঙ্গানার প্রথম সারির একজন বিজেপি নেতা, গুদুর নারায়ণ রেড্ডি। ছবির নির্মাতাদের প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল তেলেঙ্গানায় গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটিকে মুক্তি দেওয়া। তখন ‘রাজাকারে’র দুটি ট্রেলার নিয়েও তীব্র আপত্তি উঠেছিল, তবে ছবিটি সে সময় মুক্তি পায়নি।

অবশেষে লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার ঠিক একদিন আগে হায়দ্রাবাদ-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে এই ছবিটি মুক্তি পায়। ‘রাজাকারে’র মুক্তি আটকাতে চেয়ে অনেক অ্যাক্টিভিস্ট জনস্বার্থ মামলাও দায়ের করেন, কিন্তু তেলেঙ্গানা হাইকোর্ট তা আমলে নেয়নি।

দক্ষিণ ভারতের বিশিষ্ট ফিল্ম ক্রিটিক স্বরূপ কোদুরের বলতে কোনও দ্বিধাই নেই, রাজাকার আসলে একটি আগাপাশতলা ‘প্রোপাগান্ডা মুভি’ – যেখানে ইতিহাসকে মারাত্মকভাবে বিকৃত করা হয়েছে। “ছবিতে প্রতিটি মুসলিম চরিত্রের চোখমুখ থেকে হিংসা ঠিকরে পড়ে, হিন্দুদের গলা কেটে ফেলার পর বা হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করার পর তারা ফেটে পড়ে পৈশাচিক উল্লাসে”, বিবিসিকে বলছিলেন স্বরূপ কোদুর।

“আবার হায়দ্রাবাদ মুক্ত হওয়ার পর কম করে যে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মুসলিমকে জবাই করা হয়েছিল, তার কোনও উল্লেখও ছবিটিতে নেই”, আরও জানাচ্ছেন তিনি।

দ্য নিউজমিনিট পোর্টালেও রাজাকার ছবিটিকে একটি ‘উগ্র হিন্দুত্ব প্রোজেক্টে’র অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। “ছবিতে প্রতিটি মুসলিমকে সাঙ্ঘাতিক ভিলেন আর প্রতিটি হিন্দুকে প্রায় সাধুসন্তের মতো দেখিয়ে খুব মোটা দাগে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেওয়া হয়েছে”, পরিষ্কার জানাচ্ছে তারা।

এদিকে এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার ক’দিন পরেই হায়দ্রাবাদে ভোটের প্রচারে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলে গেছেন, “সর্দার প্যাটেল পঁচাত্তর বছর আগে হায়দ্রাবাদকে রাজাকার-মুক্ত করে গেছেন, এখন সেই একই দায়িত্ব আপনাদের কাঁধে!” আজকের ‘রাজাকার’ বলতে তিনি যে ওয়াইসি পরিবারকেই বুঝিয়েছেন, সেটা হায়দ্রাবাদে কারও বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি।

ছাড়া পেলে তিনি পাকিস্তানে চলে যাবেন, এই শর্তে যখন কাশিম রাজভি ১৯৫৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পান তখন তার জায়গায় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দাদা, আবদুল ওয়াহেদ ওয়াইসি।

কাশিম রাজভির সেই কলঙ্কিত উত্তরাধিকারের বোঝা আজও কিন্তু ওয়াইসি পরিবারকে বহন করে যেতে হয়।
যে কারণে ওয়াইসি এখনও নিয়ম করে বিভিন্ন জনসভায় বলে থাকেন, “কাকে আপনারা রাজাকার বলতে চাইছেন? মনে রাখবেন, রাজাকার কাশিম রাজভি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা বহুকাল আগে পাকিস্তানে চলে গেছেন।”

“আর আমরা যারা ভারতে রয়ে গেছি, তারা সাচ্চা দেশপ্রেমী। এই মুলুককে নিজের মনে করি বলেই আমরা এখানে থেকে গেছি”, নিজের দেশভক্তির প্রমাণ দিয়ে এখনও বলতে হয় তাকে।
কী হতে পারে হায়দ্রাবাদে ভোটের ফল?

মাধবীলতার জন্য বিজেপির সুসংগঠিত প্রচার, বড় বড় জনসভা আর দরজায় দরজায় গিয়ে ভোটভিক্ষার পরও হায়দ্রাবাদে আসাদউদ্দিন ওয়াইসিকে হারাতে হলে আসলেই একটা বিরাট অঘটন ঘটাতে হবে। হায়দ্রাবাদ লোকসভা কেন্দ্রটি যে সাতটি বিধানসভা আসন নিয়ে গঠিত, তার ছটিতেই এখন রয়েছেন এআইএমআইএম বিধায়করা। বাকি একটিমাত্র আসন বিজেপির দখলে।

আর যেহেতু মোট ভোটারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই মুসলিম, তাই মুসলিম ভোট কিছুটা অন্তত না-পেলে এখানে জেতা প্রায় অসম্ভব। যে কারণে ওল্ড সিটির মুসলিম মহল্লাগুলোতেও মাটি কামড়ে প্রচার করছেন মাধবীলতা। ‘তির ছোড়ার’ জন্য কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে তার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন।

তাছাড়া লড়াইতে যেহেতু কংগ্রেস ও ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির প্রার্থীরাও রয়েছেন, তারাও কিছুটা ওয়াইসির মুসলিম ভোটে ভাগ বসাবেন বলে বিজেপি আশা করছে। তেলেঙ্গানার প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমরনাথ কে মেনন তাই মনে করেন, হায়দ্রাবাদে বিজেপির জয় হয়তো ‘খুব খুব কঠিন – কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়!’

বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “এই কেন্দ্রের সাতটি আসনের মধ্যে দুটিতে – নামপল্লী আর ইয়াকুতপুরাতে ওয়াইসির দল কিন্তু গত ডিসেম্বরের বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়েছে একেবারে কান ঘেঁষে। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল দুটোতেই তারা হেরে যাবে।”

“আর হিন্দু-অধ্যুষিত গোসামহল আসনটি তো গত দশ বছর ধরেই বিজেপির দখলে। মুসলিম-বিদ্বেষী নেতা হিসেবে পরিচিত টি রাজা সিং সেখানকার বিধায়ক, যার বিরুদ্ধে অন্তত ১০৪খানা ফৌজদারি মামলাই আছে।”
ফলে তিনি মনে করছেন সাতটির মধ্যে তিনটিতে বিজেপি জিততেই পারে – আর বাকি চারটিতে মোটামুটি ভালো ভোট পেলে হায়দ্রাবাদ লোকসভা আসনেও জেতার আশাও তারা করতেই পারে।

অধ্যাপক শাহিদ মিও আবার বলছেন, ছ’মাস আগের বিধানসভা ভোট দিয়ে এখনকার লোকসভা নির্বাচনকে বিচার করলে ভুল হবে। “বিধানসভায় কিন্তু ওয়াইসি নিজে প্রার্থী ছিলেন না, এটা খেয়াল রাখতে হবে। আসাদউদ্দিন ওয়াইসি নিজে দাঁড়ানো মানে কম করে পাঁচ-সাত শতাংশ বাড়তি ভোট তার দিকে চলে আসা, এই জিনিস আমরা আগেও দেখেছি”, বলছিলেন তিনি।

তরুণ বয়সে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি খুব ভাল ফাস্ট বোলার ছিলেন, দক্ষিণ ভারতের ইউনিভার্সিটি টিমের হয়ে তিনি এক সময় জাতীয় স্তরের টুর্নামেন্টেও চুটিয়ে খেলেছেন। চলতি আইপিএলের পরিভাষা ধার করে শাহিদ মিও তাই হাসতে হাসতে যোগ করেন, “ক্রিকেটার ওয়াইসির বিরুদ্ধে মাধবীলতা বড়জোর একজন ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ হতে পারেন, কিন্তু ম্যাচ বার করতে পারবেন বলে মনে হয় না।”

তবে এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়, বিজেপি যাকে তাদের দলীয় রাজনীতিতে এত সম্ভাবনাময় বলে মনে করছে, সেই মাধবীলতাকে শুরুতেই ওয়াইসির বিরুদ্ধে এত কঠিন লড়াইয়ে কেন ঠেলে দেওয়া হল? কোম্পেলা মাধবীলতা নিজে যার জবাবে বলেছেন, “আমাকে আসাদউদ্দিন ওয়াইসির বিরুদ্ধে প্রার্থী করে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে, ওয়াইসি আর যা-ই হোন, আমাদের বি-টিম নন। তাকে আমরা পরিষ্কার হারাতে চাই!”

ওয়াইসির দলের নির্বাচনি প্রতীক হলো সবুজ রঙের ঘুড়ি, হিন্দিতে যাকে বলে ‘পতঙ্গ’। মাধবীলতার ছোড়া তিরে সেই ঘুড়ি ভোঁকাট্টা হবে – বা হায়দ্রাবাদ ‘কাটি পতঙ্গ’ দেখতে পাবে – সেই সম্ভাবনা অবশ্যই ক্ষীণ।

তবে ধর্মের ন্যারেটিভে একটা জোরদার ভোটের লড়াই বোধহয় দুটো দলেরই এই অস্বস্তিকর বদনাম – যে তারা গোপনে একে অন্যের মদতদাতা – তা কিছুটা ঘোচাতে পারবে! (হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফায়, আগামী ১৩ মে। ভোটগণনা বাকি দেশের সঙ্গে এক সাথেই, ৪ঠা জুন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *