সাঈদ চৌধুরী
বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধা, বিয়ানীবাজার প্রেসকাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কথাসাহিত্যিক আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলামের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল লেখক, মেধাবী সাংবাদিক ও সুন্দর মনের মানুষ।
নিজের জীবন এবং স্ত্রী-সন্তানের সান্নিধ্যের মায়া ত্যাগ করে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পর দেশেরে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। এলাকার সাধারণ মানুষের সাধ্যমত উপকার করেছেন।
আশির দশকে জেনারেল এরশাদ তখন সেনাপ্রধান। সামরিক শাসনের কবলে দেশ। কঠোর সেন্সরশিপ চলছে সংবাদপত্রে। রাজনৈতিক রিপোর্ট লেখালেখির ওপর আরোপ করা হয়েছে কৌশলগত বিধি নিষেধ। এ বিষয়ে এক আড্ডায় আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয় সিলেটের ডাকে। সাথে ছিলেন লেখক-সাংবাদিক আব্দুল বাসিত।
উপস্থিত অনেকে বললেন রাজনীতি ছাড়া সংবাদপত্র জমছেনা। আকাদ্দাস ভাই কলকাতার একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট দেখিয়ে বললেন, গ্রামীন জন জীবনকে নিয়ে এলে রাজনীতি বিষয়ক লেখার দরকার পড়বেনা। তবে হৃদয়গ্রাহী রিপোর্ট হতে হবে, ডেপথ রিপোর্ট যাকে বলে।
সেই থেকে তার সাথে হৃদ্যতা। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বহুবার দেখা হয়েছে। তিনি পরম আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলতেন। বিয়ানীবাজার থেকে নদী তীর হয়ে জকিগঞ্জ সীমান্তের আমলসীদ পর্যন্ত সুরমা কুশিয়ারা ও বরাক নদীর ভাঙ্গন প্রসঙ্গে তিন দিনের সিরিজ রিপোর্ট করতে গিয়ে তার অভিমত নিয়ে ছিলাম। অনেক তথ্য দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৪-৯৫ সালে বরাক ড্যাম নিয়ে আমি যখন সিরিজ প্রতিবেদন করি, তখন আমার সাথে ছিলেন বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবে টানা তিন বারের সভাপতি সাংবাদিক আব্দুর রহিম। তিনি আমার সাথে জকিগঞ্জ সীনান্তে গিয়েছেন। তখনও আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম বরাক ড্যামের ভয়াবহতার আশংকা তুলে ধরেছেন অকপটে।
১৯৯৬ সালের ২৬ জুলাই জকিগঞ্জ উপজেলার তেলীখালে বিডিআর কর্তৃক জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। মর্মান্তিক হতাহতের খবর পেয়ে আমি দ্রুত সরেজমিন ছুটে যাই। বিয়ানীবাজার থেকে আব্দুর রহিম ও জাকিগন্জ থেকে ফয়জুর রহমান খছরু কয়েকজন বন্ধু সহ অংশ গ্রহন করেন।
জকিগঞ্জ উপজেলার বীরশ্রী ইউনিয়নে সীমান্ত ফাঁড়ি লক্ষীবাজার ক্যাম্পের ৩৬ রাইফেলস্ ব্যাটেলিয়নের একদল সীমান্ত রক্ষীর বেপরোয়া গুলি বর্ষণে বহু মানুষ হতাহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল হাফিজ, আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, বশির ও মাহবুব। আহতদের মধ্যে আছদ আলী মেম্বার ও মুছব্বির আলী মেম্বার পরে মারা যান। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এমএ লতিফ চৌধুরী ও বজলুর রহমান চৌধুরী (বজলু মিয়া) এবং ও হারিছ আলী মেম্বার দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
গুরুতর আহতদের মধ্যে আরো ছিলেন আজিজুর রহমান, আব্দুর নুর, আব্দুল কদ্দুছ, আসাদ উদ্দিন, এবাদুর রহমান, খলিলুর রহমান, চুনু মিয়া, ছদরুল হক চৌধুরী, ছাইফ উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, তুফাজ্জল হোসেন এখই মিয়া, পুতুল মিয়া, বদরুল ইসলাম, মতছিম আলী পাখী মিয়া, মস্তাক আহমদ আব্দুর নূর, মুজাহিদ আলী, রিয়াজ উদ্দিন, রুবেল আহমদ, রেহান উদ্দিন, সফিকুল হক, সাইম উদ্দিন, সামছু হক, হুসন মিয়া প্রমুখ।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর পর বিডিআর সদস্যরা বারহাল ইউপি চেয়ারম্যান এমএ লতিফ চৌধুরী সহ ছদরুল হক চৌধুরী, মিজান আলী, মুছব্বির আলী মেম্বার, আছদ আলী মেম্বার, হারিছ আলী মেম্বার ও মতছিম আলী পাখী মিয়া প্রমুখকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরে নিয়ে যায়। এদের সাথে আরো বহু মানুষকে আসামী করে বিডিআর সুবেদার ওয়াজিদ আলী বাদী হয়ে জকিগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
দৈনিক জালালাবাদে আমরা লীড নিউজ করি। দুপুরের আগে সব পত্রিকা বিক্রি হয়ে যায়। গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ ও কানাইঘাটে জালালাবাদ ফটো কপি করে বিতরণ করা হয়। আমাদের প্রতিবেদনের পর সরকার কিশোরগঞ্জের জেলা জজ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
তেলীখাল হত্যাকান্ডের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য মাওলানা ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধে একদল ষড়যন্ত্র শুরু করে। আমাদের প্রতিবেদনে ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়। ফলে ঘোলা জলে কেউ মাছ শিকার করতে পারেনি।
দৈনিক সংগামে আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী, সাবেক ভূমিমন্ত্রী এমএ হকের ছেলে রেয়াজুল হক, জকিগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাসুক উদ্দিন আহমদ, চারখাই ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মুহিত চৌধুরী (মনু মিয়া), মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান বাবুশ্রী জগদানন্দ পুরকায়স্ত, কাজল শাহ ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস ছোবহান তাপাদার (রানা মিয়া) সহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য তুলে ধরি।
আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম এক্ষেত্রে সরাসরি কোন অভিমত না দিলেও তথ্য সংগ্রহে আমাদের অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। সে সময় বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জে বন্যায় ফসলহানির ব্যাপারে একটি শক্তিশালী প্রতিবেদনের জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। তখন সাংবাদিক আব্দুর রহিম সহ স্থানীয়দের নিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর মধ্যবর্তী জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও কানাইঘাটের বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল ক্ষতির কারণ নিয়ে প্রতিবেদন করেছি।
অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে ডুবাই হাওর, ফুলতার হাওর, বালাই হাওর, মজুমদারী হাওর, মৈলাট হাওর সহ বিভিন্ন হাওরে ক্ষতিগ্রস্থ চাষাবাদের চিত্র প্রকাশ করেছি। ছাগলী খাল, তেলীখাল, দাশের খাল, নাপিতের খাল, মন্দির খাল, ময়ই খাল, মাদার খাল, রহিমপুরী খাল, সেনাপতিখাল প্রভুতি এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের বক্তব্য তুলে ধরেছি।
অসাধারণ সাহসী দেশপ্রেমিক এবং নির্ভীক মানুষ আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম যেমন লিখেন ভালো, তেমনি বলেন ভালো। আমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির আবেগে গড়ে উঠেছে তার মনোজগত। বিশাল হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছেন জন্ম মাটি বিয়ানীবাজারের মানুষ, পশু-পাখি-মাঠ-ঘাট আর অনাবিল প্রকৃতিকে। যে কোনো বিষয়ে তার বিশ্লেষণ ছিল হৃদয়গ্রাহী। ১৯৮৫/৮৬ সালে দৈনিক সিলেটের ডাকে মিতালাপী ছদ্মনামে অতএব শীরোনামে এবং সাপ্তাহিক যুগভেরীতে আ স জাফরী নামে দৃষ্টিপাত কলামে তিনি ছিলেন বেশ সরব। যদিও কথা সাহিত্যিক হিসেবেই তার সুখ্যাতি বেশি।
জীবদ্দশায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যায় ৯, এর মধ্যে ছোট গল্প, নাটক, উপন্যাস ও স্মৃতিচারণ ধর্মী গ্রন্থ রয়েছে। মৃত্যুর পর দু খণ্ডে সমগ্র রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। বেরিয়েছে একটি স্মারক গ্রন্থ। প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ : ১. নয়া দুনিয়া (উপন্যাস)-১৯৫৩-তমদ্দুন লাইব্রেরী, ঢাকা। ২. নীরব নদী (বড় গল্প)-১৯৬৫-নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা। ৩. পঞ্চবিংশতি (ছোট গল্প)-১৯৬৭-হাফিজ বুক সেন্টার, ঢাকা। ৪. মাটির চেরাগ (নাটক)-১৯৬৯-পয়গাম প্রেস, ঢাকা। ৫. সবুর দুনিয়া (কিশোর উপন্যাস)-১৯৮৪-বাংলা একাডেমী, ঢাকা। ৬. বন্দী জীবনের কিছু কথা (স্মৃতিচারণ)-১৯৮৭-নওরোজ সাহিত্য সংসদ, ঢাকা। ৭. কারাগার থেকে বেরিয়ে (স্মৃতিচারণ)-১৯৮৯-কাফেলা প্রকাশনী, সিলেট। ৮. চালচিত্র (গল্প)-১৯৮৯- তাজুল মোহাম্মদ ও খালেদ জাফরী, সিলেট। ৯. রাক্ষূসে বন্যা এবং (যুগল উপন্যাস)-১৯৯৭-আমরা ক’জনা, সিলেট।
মঞ্চস্থ নাটক : ‘সোনার বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। আসামের করিমগঞ্জ থেকে সাপ্তাহিক মুক্তবাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনন্য অবদান রেখেছেন।
১৯২২ সালের ২২ নভেম্বর সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম। ২০০০ সালের ২ অগাস্ট ভোরে ইন্তেকাল করেন তিনি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
মরহুম আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম একটি আলোকিত নাম। অগ্রজদের কাছে তিনি যেমন প্রিয়, তেমনি অনুজদের কাছেও শ্রদ্ধেয়। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
* সাঈদ চৌধুরী- সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক