মুকুল চৌধুরী : ঐতিহ্য ও প্রেমের সাহসী কবি ।। ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

প্রবন্ধ-কলাম শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আশির দশকের অন্যতম কবি মুকুল চৌধুরী। সাহিত্যের নতুন বাঁক নির্মাণে আশির দশকের যে লক্ষণীয় ভূমিকা, তার অন্যতম কারিগর হিসেবে তাকে সার্থক অভিযাত্রী বলে আখ্যায়িত করা যায়। কাব্যচিন্তার স্বকীয় ঢঙ, জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়বস্তুর সন্নিবেশন, ভাষায় সরলতা এবং মানিবক শিল্পকলার আধুনিক প্রয়োগ তার কাব্যশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। সেইসাথে বিল-হাওড়ের জলজউদ্ভিদ এবং শাপলা-পদ্মের ঘ্রাণ মিশ্রিত কাদাপানি বিধৌত শব্দের সাথে শহুরে জাঁকজমকপূর্ণ ঝলমলে শব্দের সুসম বুনন তার কবিতাকে স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে উপস্থাপিত করেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ অস্পষ্ট বন্দর থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত অষ্টম কাব্যগ্রন্থ মাটির ঘটনা পর্যন্ত প্রতিটি গ্রন্থে নিজেকে উৎরে যাবার সফল প্রয়াস তার সম্পর্কে আরো বেশি আশাবাদী করে তুলেছে।

ছয়দশকের বর্ণাঢ্য জীবন পেরিয়ে আসা একজন কবির জন্য কম সময় নয়। বলা চলে সাহিত্যের কাক্সিক্ষত চূঁড়া স্পর্শ করার স্বাপ্নিক বাকমোহনা। মূল্যায়নের কাঠগড়ায় তাকে উপস্থাপনের মোক্ষম সময়ও বটে। সেই সূত্রেই বলা যায়, ১৯৫৮ সালের ২২ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করে মুকুল চৌধুরী এখন একজন পরিণত কবিপুরুষ। আটটি কাব্যগ্রন্থ, পাঁচটি কিশোরগ্রন্থ, সাতটি প্রবন্ধ-গবেষণাগ্রন্থ এবং বেশ কয়েকটি সম্পাদিত গ্রন্থ মিলে ইতোমধ্যে তার গ্রন্থসংখ্যা ছাব্বিশে পৌঁছে গেছে। তাইতো কবি হিসেবে মূল্যায়নের নিমিত্তে প্রকাশিত আটটি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে ২০১৮ সালে সিলেটের নাগরী প্রকাশ করেছে তার কবিতাসমগ্র। কবিতাসমগ্রতে যুক্ত করা হয়েছে পাঠমূল্যায়ন এবং পরিশিষ্ট। এক মলাটের কোরাসবন্ধনে কবিকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনার ও বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করেছে বৈকি। কবিতার সাথে কবির নিবিড় সম্পর্কের এক অনবদ্য দলীল এ কবিতাসমগ্র।

কবিতাকে জৌলুসের সার্থকতায় পৌঁছে দেয় ইতিহাসপ্রেম এবং ঐতিহ্যগাঁথুনী। আধুনিক কাব্যপরিভাষায় ঐতিহ্যের ব্যবহারে কবি মুকুল চৌধুরী সফলতার চমক দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ঐতিহ্যসচেতন কবি হিসেবে ফররুখ আহমদ যে ধরনের মিথকে সামনে এনেছেন কবি মুকুল চৌধুরী সেখান থেকে আরো একধাপ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। দেশজ ঐহিত্যের মাখামাখি তার কবিতায়। ‘একদিন আমার পিতার বয়সী এক বৃদ্ধ কৃষক বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিস্কার নামাযে যোগ দিতে গ্রীষ্মদিনের ৪৮ মাইল উষর পথ ভেঙে এসেছিলেন রাজধানীর জাতীয় ঈদগায়।’ সেইসাথে স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন বিশ্বাসের মৌল শেকড়ে। ‘শব্দের ঘুম আসহাব-এ-কাহাফের গিরিগুহা যেন।’ তাইতো সময়কে ধারণ করে সমকালীন প্রেক্ষাপটের সাথে ইতিহাস-ঐতিহ্যের আকর্ষণীয় সেতুবন্ধন তার অন্যতম কাব্যবৈশিষ্ট্য। ইতিহাসের গলিপথ হেঁটে সমকালকে চিত্রিত করতে কবি উল্লেখ করেনÑ

আবু জেহেলের তাঁবু থেকে সত্যের মৃত্যুদ- ঘোষণা করে

বেরিয়ে আসছে বিভেদ সৃষ্টিকারী কালো শয়তান।

এগিয়ে আসছে দাম্ভিক আবরাহা, তার হস্তীবাহিনী এবং

আকাশের একঝাঁক আবাবিল- বেহেশ্তের পক্ষীকুল।

[মূর্খতার আইয়ামে, কবিতাসমগ্র, পৃ. ৫৩]

কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের অচলায়তন পরিস্থিতির উদাহরণ টানতে গিয়ে কবি ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তিনি উল্লেখ করেন-

স্পেনবাসীর কান্নাঝরা পানিতে রানি ইসাবেলা যখন

গোসল করছিল তখন সেই দৃশ্য দেখার জন্য তো দুনিয়াতে

হাহাশ্বাস ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অথচ

মারাঠাদের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের স্বাজাত্যবোধের বদলে যখন

নিপীড়ন আর প্রেমহীনতার পুরস্কার ঘোষিত হয় তখন

একদল শৃগাল-শাবক তালি বাজানোর জন্য শিবাজীর শক্তিতে উঠে দাঁড়ায়।

তোমাদের কোনও কোনও পিতৃপুরুষও এই শৃগাল-শাবকের দলে ভিড়ে

একদিন তালিয়া বাজাতে বাজাতে দৈত্যের উদরে মাথা ঢুকিয়েছিল।

[কাশ্মীরি যুবক এবং নব্য উপনিবেশের গল্প, কবিতাসমগ্র, পৃ. ৭৮]

নান্দনিকতার সাথে ঐতিহ্যকে ধারণ করাই আধুনিকতা। কিন্তু এ সংজ্ঞাকে পিছনে ফেলে সর্বস্ব হারিয়ে অনুকরণপ্রিয়তাকেই আধুনিকতা বলে উল্লাস করে থাকেন অনেকেই। বিদেশী সংস্কৃতির কাছে মাথা বিক্রি করার মাহোৎসবের বিষয়টিকে কবি মুকুল চৌধুরী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে প্রতিবাদ করেছেন। কবিতায় যে দেশজ চেতনা তারই স্ফুরণ দেখা যায় তার কবিতার ছত্রে ছত্রে। কবি অত্যন্ত ক্ষোভের সাথেই উল্লেখ করেন-

আমাদের ঐতিহ্য থেকে গাছের ছালের মতো

কারা যেন তুলে নিতে চায় সব স্নিগ্ধ ক্লোরোফিল

আমাদের অস্তিত্বের ইট ধরে টানে

পলেস্তরা খসে গেছে আর কংক্রিট খিলখিল হাসে

পঙ্গপাল শস্য খেয়ে ফিরবার পথে

বৃষ্টিভেজা আলপথে বসিয়েছে ইঁদুরের দাঁত।

[পিতামহ আমাকে বলুন, কবিতাসমগ্র, পৃ. ২৩]

পাললিক জনপদের বোধ-বিশ্বাস এবং সহজাত ধর্মীয় অনুভূতির শৈল্পিক উপস্থাপনায় বেশ পারঙ্গমতা লক্ষ্য করা যায় কবি মুকুল চৌধুরীর কবিতায়। স্বদেশ, স্বজাতি, মাটি ও মানুষ, পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিত এবং জনম-লীর সামগ্রিক চেতনাবোধের নান্দনিক উপস্থাপন একজন বড় কবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবি মুকুল চৌধুরীর কবিতার পরতে পরতে সে সবের নিখুঁত চিত্র ভেসে ওঠে। ‘এইতো আমার প্রথম এবং শেষ খেয়ার সতীর্থ। এক সূর্যস্নাত সকালে ঝড়ের লেশমাত্র ছিল না, নদীর নিঃশ্বাসে ছিল ঘুমন্ত শিশুর নাকডাকা। অথচ হাওয়ার বিলাপে মেয়েটি কাঁদছে, আদমের বিবরণে ঝরে পড়ছে অনুতপ্ত বরফ।’ তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্বইজতেমাকে ঘিরে তিনি যে নান্দনিক উপস্থাপনা দেখিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত অন্য কোন কবির কবিতায় খুব একটা চোখে পড়ে না।

লাখ-বিশেক উত্থিত হাতের ফোঁকর গলে

যূথবদ্ধ মুমিন মুখের স্রোতস্বিনী কণ্ঠ থেকে

একক যশস্বী স্বর ‘রব্বানা’ উচ্চারিত হয়

তুরাগ নদীর তীরে উপচে পড়ে বুভুক্ষ চিত্তের সব শিল্পিত আবেগ

দুর্বার-দুর্জয় এই শব্দের যুগান্ত প্লাবনে যেন ধুয়ে মুছে যাবে সব অকেজো ভড়ং।

[তুরাগ নদীর তীরে, কবিতাসমগ্র, পৃ. ৪৭]

স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বমানবতাকে ধারণ করার এক সফল প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায় কবি মুকুল চৌধুরীর কবিতায়। বিশ্বাসী চেতনার মানুষেরা মার খাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে। অত্যন্ত কষ্টের সাথে তাইতো তিনি বলে ওঠেনÑ আমরা কবরবাসী হচ্ছি আরাকানে, আমরা কবরবাসী হচ্ছি হিন্দুস্থানে/ আমরা কবরবাসী হচ্ছি কাশ্মীরে, আমরা কবরবাসী হচ্ছি বসনিয়ায়/ আমরা কবরবাসী হচ্ছি ফিলিস্তিনে, মিন্দানাওয়ের নিদ্রাহীন বস্তিতেও। [সোয়া শ’ কোটি কবর, কবিতাসমগ্র, পৃ. ১৫০]। ভয়-শংকার খোলস থেকে বেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবার এক সাহসী উচ্চারণে সবাইকে জাগ্রত হবার আহ্বান জানিয়েছেন কবি মুকুল চৌধুরী। তবে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি ফররুখ আহমদ কিংবা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো করে নয়Ñ তার কবিবন্ধু মতিউর রহমান মল্লিকের ঢঙে কবি উচ্চারণ করেন-

ডানাওয়ালা উড়ন্ত ঘোড়ার চেয়ে

বর্ষার উদ্দাম স্রোত অনেক ভালো;

অস্তাচলগামী সূর্যের চেয়ে দ্বাদশীর চাঁদ

নির্বোধ বন্ধুর চেয়ে নির্মম শত্রু এবং

পূর্ণগ্রাস দুপুরের কালে মেঘের চেয়ে ঘনকৃষ্ণ অমাবস্যার রাত।

[কেবিন নম্বর-৫০৮, কবিতাসমগ্র, পৃ. ১৭১]

প্রত্যেক বড় কবিই একেকজন শব্দকারিগর। যুতসই শব্দের সাথে উপমা-উৎপ্রেক্ষার সুবিন্যস্ত কল্পচিত্র তাঁদের কাব্যময়তাকে উসকে দেয়। কবি মুকুল চৌধুরী নান্দনিকভাবেই তার কবিতায় সে কারিশমাটি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। তার কবিতার শরীরে গেঁথে আছে অসাধারণ শব্দদ্যোতনা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং অনুপ্রাসের অনুরণন। ‘আমার কৈশোর থেকে অহরহ ঝরে পড়ে বৈশাখের আম।’ ‘চাঁদের লণ্ঠন থেকে মাছের ঝাঁকের মতো/ ভেসে আসে নিশিথের ব্যাকুল আবেগ।’ ‘পাথরেও কান্না আছে, আগুনের দাহে আছে প্রেম/ অথচ আমাকে তুমি চোখের আরশিতে মেখে/ কপট বিবাদী দাহ ছুঁড়ে দিলে বিষাদের গৃহে।’ “জানালা খুলেছি, কাঠের পাল্লার ফাঁকে আটকে আছে শব্দের মহিমা। দূরে মাঠ, কিশোরীরা দল বেঁধেছে যেন গুচ্ছ-ঘাসের উপমা, ঋতু-মঞ্জুরি যেন-বা ফুটেছে বসন্ত-বাগান জুড়ে।” এছড়াও ‘আয়েশী চাঁদ, শামুক গুটানো লজ্জা, প্রজাপতি রোদের পেখম, সলাজ পূর্ণিমা, শব্দের কারিকা-খচিত আলপনা’ এমন অসাধারণ সব শব্দকাব্য জুড়ে আছে তার কবিতার শিরা-উপশিরায়। ২৬তম বিবাহ বার্ষিকীতে স্ত্রী উপাকে উৎসর্গ করে কবি যে প্রেমের ‘প্রণয়-কাব্য’ রচনা করেছেন, নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাসাহিত্যে বিবাহ-উত্তর বাসর রাতের শ্রেষ্ঠ কবিতা এটি। তাইতো তিনি গর্বের সাথেই উচ্চারণ করেন-

আমার আছে শব্দের করাত।

আমার আছে উপমার বল্লম।

আমার আছে উৎপ্রেক্ষার শানিত চাবুক।

আমি এখন এ সব শব্দাস্ত্র নিয়েই তোমাদের

অশরীরী শিংয়ের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ে যাবো।

[শব্দাস্ত্র, কবিতাসমগ্র, পৃ. ১০৫]

আবেগ কবিতার অন্যতম বাহন হলেও অযথা আদিখ্যেতার সমাবেশ দেখা যায় না মুকুল চৌধুরীর কবিতায়। পরিমিতি জ্ঞানের স্বল্প-দৈর্ঘ্য সমীক্ষায় তিনি সফল। তবে ভাষার সরলতা তাকে মাঝে মাঝে হোঁচট খাওয়ানোর চেষ্টা করে। সে বিষয়ে আরো একটু সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে। আশার দিক হচ্ছেÑ সময়ের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে শেষকাব্যগ্রন্থ মাটির ঘটনা’য় তাকে বয়সের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেই দেখা গেছে। তাইতো কবি আল মাহমুদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতেই পারিÑ ‘মুকুল চৌধুরী প্রতিভাবান কবি। মুকুল চৌধুরী বিবেকমান কবি। মুকুল চৌধুরীর দেখার চোখ আছে। মুকুল চৌধুরী স্বপ্ন ও কল্পনাকে সাজাতে জানেন। তার ভাষা নমনীয় এবং ভাষার যে ছন্দ চাতুরী, তার কবিতায় তাও বহমান। এই গুণগুলো নিয়ে একজন কবি বড় কবি হতে পারেন। মুকুল চৌধুরীর এই গুণগুলোকে আমি শ্রদ্ধা করি। এবং আমি মনে করি যে, মুকুল চৌধুরী একজন প্রকৃত কবি। আমাদের মধ্যে যে কয়জন প্রকৃত কবি আবির্ভূত হয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।’ [আল মাহমুদ, মুকুল চৌধুরীর কবিতা, কবিতাসমগ্র, পৃ. ২০৯]। তাইতো কবি মুকুল চৌধুরীর চোখে মুখে শব্দের নক্ষত্রপুঞ্জ ছায়াপথ সাজায়, সাজায় নতুনত্বের গ্যালক্সি-আকাশ। সেই আকাশে শাদা কইতর ওড়ে মানবিক পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। সত্যিকার অর্থেই তিনি সমকালীন কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্যিক রাহবার, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সওদাগর, মানবিক প্রেমের সাহসী কবি।

* ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *