মুকুল চৌধুরীর সৃজন যাত্রা

শিল্প-সংস্কৃতি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

আফসার নিজাম

মুকুল চৌধুরীর সৃজন ক্রিয়ার প্রারম্ভিকতা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। কবিতা চর্চা ও সাধনায় যখন তিনি নিয়োজিত তখন বাংলাদেশের সৃজনাকাশ নতুন রূপে বিবর্তন করে চলছে। তখনকার রাজনৈতিক বিকাশ কবিতার নয়া রূপায়ণের সঙ্গে তিনি সুখপ্রদভাবে অঙ্গীভুত হয়ে যান। একজন কবিজীবনে এটা গৌরবময় ইতিহাস নির্মাণের অনুষঙ্গ। কারণ তার কাব্যযৌবন আশির দশক। নতুন রাষ্ট্র নির্মাণে সত্তুর দশক ছিলো অস্থির। আশির দশ স্থিতিশীল হয়ে আসে। একমুখি চিন্তাকে ঠেলে বহুমুখি চিন্তার নয়া রূপায়ণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যেমন নির্মাণ হতে থাকে তেমনি মুকুলের চিন্তাশৈলী নির্মাণ হতে থাকে তার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের কাছে দখলদার বৃটিশরা পরাজিত হলে সাতচল্লিশে স্বাধীন হয় বাংলা। পাকিস্তান নামে সৃষ্টি হয় দেশ। ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রান্তে হয় পশ্চিম পাকিস্তান ও অন্য প্রান্তে হয় পূর্বপাকিস্তান। কলকাতা কেন্দ্রিক বন্ধ্যাত্বকে জয় করে পূর্বপাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রিক শুরু হয় সৃজন অগ্রগতি। তৈরি হয় নতুন বাংলা সাহিত্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এতোটা অগ্রগতি হয় যে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য সমাজকে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। এ সময় ভাষা-আন্দোলন শিল্প সাহিত্যকে নব ভাবনা ঐতিহ্য নিয়ে পথ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না ভাষা আন্দোলন কলকাতা থেকে পূর্বপাকিস্তানের সাহিত্যের সৃজনকে আলাদা করে দেয়। কলকাতা যখন চাটুকার সাহিত্য নিয়ে রোমান্টিসিজমে ভুগছে তখন পূর্বপাকিস্তানের সাহিত্য বিপ্লবীরূপ লাভ করছে। কার্যতই আলাদা হয়ে যায় ভারত বাংলার ভাষা আর পূর্বপাকিস্তানের বাংলা ভাষা।

সত্তর দশকে নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। একাত্তরের নতুন রাষ্ট্রটি বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। নতুন রাষ্ট্রের মধ্যে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। বিভাজনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অস্থির হয়ে যায় সমাজ। এ সময় এক প্রকার বন্ধ্যাত্ব নেমে আসে সৃজন মহল্লায়। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ে না। যেনো সৃজনশীল মানুষের সংখ্যা হঠাৎ করেই কমে গেছে দেশ থেকে। আশির দশকে রাজনৈতিক সামাজিক পট পরিবর্তন হতে থাকে। একমুখি রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বহুমুখি রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে আবার শুরু হয় সৃজনক্রিয়া। সাতচল্লিশে দেশ স্বাধীনের মতোই এ সময় নব কল্লোলে সৃজনশীল মানুষ তাদের সৃজনক্রিয়া গতি সঞ্চার করে।

এ সময় তরুণ কবি সাহিত্যিক শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মীরা একাত্তর পূর্ববর্তী সৃজনশীলদের থেকে রূপকল্প, শব্দচয়ন, বিষয় নির্বাচন থেকে সরে এসে নতুন ভাষা নির্মাণ শুরু করেন। একাত্তরের পর পরই ভাষা সাহিত্যকে ঐতিহ্য ধারা থেকে সরিয়ে নিয়ে সনাতন ধর্মের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করার যে হিন প্রচেষ্টা শুরু করে তার বিপরীতে ঐতিহ্য চেতনা নিয়ে শুরু হয় কাব্য সাহিত্য নির্মাণ। এই নির্মাণের অন্যতম কারিগর মুকুল চৌধুরী। এ সময় একঝাঁক তরুণ লেখকের আর্বিভাব হয়। তারা হলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, আবদুল হাই শিকদার, হাসান আলীম, সোলায়মান আহসান, বুলবুল সরওয়ার, রেজাউদ্দিন স্টালিন, আসাদ বিন হাফিজ, মোশাররফ হোসেন খান, মঈন চৌধুরী, মজিদ মাহমুদ, শাহীন রেজা,তমিজ উদদীন লোদী, আশরাফ আল দীন, আহমদ মতিউর রহমান, গাজী এনামুল হক, মহিউদ্দিন আকবর, চৌধুরী গোলাম মাওলা, মুজতাহিদ ফারুকী, গোলাম মোহাম্মদ, নাসির হেলাল প্রমুখ। আশির দশ তাই নতুন ফসল ফলার সময়। তাদের কবিতার বিষয়, চিত্রকল্প, অভিব্যক্তি, উপমা, প্রকরণ হয়ে উঠেছে ফলবান বৃক্ষ। তারা ছায়া পান কবি আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আফজাল চৌধুরীদের। নতুন এই আবর্তনময় সময়ের নানাবিধ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে মুকুল চৌধুরীর কাব্যমনন হয়ে উঠেছে ঐতিহ্য শৈল্পিক স্মারক।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অস্পষ্ট বন্দর’ বেরোয় ১৯৯১ সালে। আশির দশকের বাঁক পরিবর্তনে কাব্য সাধনা অব্যাহত থাকলেও গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পেতে সময় হয় নব্বই দশকে। প্রথম কাব্যই কাব্যরসিকদের চোখকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। অন্তর্মুখি ও আধ্যাত্মিক তৃষ্ণায় সমৃদ্ধ তার কবিতা হয়ে ওঠে ঐতিহ্য চেতনা মুখপত্র।

তোমার সন্ধান আমি আমাতেই পেয়েছি নিশ্চিত

প্রথম বয়সে প্রভু এই প্রাপ্তি অনিদ্র ভ্রমণ

সারাটি জীবন যেনো টেনে যেতে পারি এই দাঁড়।

প্রাপ্তি, অস্পষ্ট বন্দর

এই কাব্যগ্রন্থটি নব চিন্তা, পরিশীলিত ছন্দ, নব চিত্রকল্প আশির দশকের চিন্তার ঐক্যরূপ হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে। একাত্তর পরবর্তী যে শিকড়হীনতা পেয়ে বসেছিলো সৃজনশীলতায় তার থেকে মুখ ফিরিয়ে শেকড়ের দিকে ধাবিত হওয়ার স্মারক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। বাঁক ফেরার রাজনৈতিক মুক্ততা, নৈঃসঙ্গপীড়িত জীবন থেকে স্বাধীকার সবই তার কাব্য দৃশ্যত হয়ে এসেছে।

কাল রাতে

হাঁ কাল গভীর রাতে বয়ে যাওয়া ঊর্ধ্বমুখী ঝড়ের শাসনে

আমি এক তর্জনীর শাসানেরার ভঙ্গিটি দেখেছি

বকের ডানার মতো শুভ্র সফেদ এই অবয়ব

লালবাগ কেল্লাকেও গম্ভীর্যে হার মানিয়েছে।

প্রাচীন অশ্বথের জন্য, অস্পষ্ট বন্দর

মুকুল চৌধুরীর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল’ প্রকাশ পায় ১৯৯৪ সালে। তখন আরো এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে। এ সময়য়ে সংগ্রাম প্রত্যক্ষণ, মানুষের জেগে ওঠার সময়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির এক দারুণ আবেগে থরথর জাতি। সে সময়ে সৃজন নিয়ে হাজির হন কবি। নিম্নস্বরের মৃদু উচ্চারিত শব্দ তখন নতুন আবহ সৃষ্টি করে।

এখনও যেখানে স্লোগানে-মিছিলে আসঙ্গ তৃষ্ণা জেগে ওঠে

বোধের নদীতে ন্যায়ের বাতাস পাল তুলে গায় সাত্যের সংগীত

এখনও যেখানে স্বর্গীয় চুমোর প্রেমে মমতায় কেঁপে ওঠে তার ঢাল

অলৌকিক ব্রিজ- ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল

আশির দশকের কাব্যজগতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। ধর্মহীনতার থেকে বের হয়ে ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নেয় নবীন প্রজন্ম। এ সময়ের সৃজনশীল লেখকগণ তাদের লেখায় নিয়ে আসেন ঐশি জীবনের আলো। তার কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মনোজগতে বিস্তার লাভ করে প্রভুপ্রেম।

না ক্রোধ কিংবা ঘৃণা নয়

এখন প্রয়োজন

আবদুল মুত্তালিবের মতো আন্তরিক প্রার্থনার-

‘হে প্রভু, বান্দাহ্ নিজের ঘরের হেফাজত করে,

তুমি হেফাজত করো তোমার ঘর।’

ধিক্কার- ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল

মানুষের বিপ্লবী চেতনা জাগতিক পরিপ্রেক্ষিতে ঋদ্ধ হয়েছে তারই রূপকার হয়ে ওঠেছেন মুকুল চৌধুরী। তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘চা বারান্দার মুখ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। ছন্দের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় তার কবিতা। কিছুটা জাগতিক মোহ এখানে এসে উপস্থিত হয়। মানবিক চেতনার নবরূপ উন্মোচিত হয় এখানে। এতোদিনকার যে কাব্যজাল নির্মাণ করেন তার থেকে কিছুটা সরে বৃহত্তর মনোভঙ্গি গ্রহণ করেন।

আশ্বর্য এখনও আমি ক্ষণে ক্ষণে ভাবছি তোমাকে

শুনেছি পেয়েছো তুমি তার থেকে দিগন্ত উদাস,

স্পর্শহীন নির্জনতা, স্বপ্নমগ্ন নক্ষত্র বিলাস।

করুণ যন্ত্রণা তাই জ্বালা দেয় অপূর্ণ আমাকে।

স্বপ্নচিল-১- চা বারান্দার মুখ

কবিতা পাঠে যে মগ্নতা প্রয়োজন মুকুলের তা ছিলো। সাথে ছিলো দিক নির্দেশনা প্রদানকারী বটবৃক্ষ আফজাল চৌধুরী। সিলেটের পবিত্র মাটিতে কাব্যকলা চর্চা করেছেন নির্মোহ চিত্তে।

প্রখর সমালোচনা, পাঠের গভীরতা, আড্ডার বিতর্ক সব মিলিয়ে এক সৃজন আকাশ নির্মাণ করেছেন। আর এ কারণেই তার কাব্যভূবন হয়েছে রুচিশীল, ঐতিহ্যিক, ধর্মীয় সেজদাবনত। তার পাঠকরাও মিলেছে তার আত্মার সাথে, আত্মীয়তার মতো।

মুকুল চৌধুরীর পরবর্তী কবিতার বই ‘সোয়অ শ’ কোটি কবর’ ২০০৩ সালে, ‘অপার্থিব সফরনামা’ ২০১১ সালে, মাটির ঘটনা ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। আমরা জানি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের মতোই তার পরবর্তী সকল কাব্যগ্রন্থের ভাষাশৈলী, রুচিবোধ, বিষয় নির্বাচন ছিলো জীবনলগ্ন, দেশ, জাতি এবং উম্মাহর সংকট ও তার সমাধান কল্পে উপলব্ধ চেতনা আত্মশ্লোগান। এ জন্য তার কবিতা কখনো উচ্চকণ্ঠ কখন ম্রিয়মান, স্নেহধর্মী।

বর্তমান সমাজ জীবনে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, নিধর্মবাদীদের উত্থান, ষড়যন্ত্র ও আস্ফালন হয়েছে তার থেকে মুক্তি পেতে সৃজনশীল, রুচিসমৃদ্ধ সাহিত্য পাঠ করতে হলে ঐতিহ্যবাদী মুকুল চৌধুরী ও তার সমসাময়িক কবিদের কবিতা পাঠ আমাদের নতুন করে উজ্জীবিত করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *