প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি- মিশরের ‘দ্যা গ্রেট পিরামিড অফ খুফুর’ কাছেই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে ‘দ্যা গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম বা জিইএম’-এর।
এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর বলা হচ্ছে, যেখানে এক লাখেরও বেশি প্রত্নসামগ্রী রাখা হয়েছে। প্রাক-রাজবংশীয় সময়ে থেকে গ্রীক ও রোমান যুগ পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার বছরের ইতিহাস সেখানে ঠাঁই পেয়েছে।
বিখ্যাত মিশরবিদরা বলছেন, এই জাদুঘর চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে অন্য দেশে থাকা মিশরের প্রত্নসামগ্রী ফিরিয়ে আনার দাবি জোরদার হবে। এর মধ্যে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে থাকা ‘রোসেট্টা স্টোন’ও রয়েছে। তবে দ্যা গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম সবচেয়ে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা হলো প্রাচীন মিশরের বালক সম্রাট তুতেনখামুনের অক্ষত সমাধি থেকে পাওয়া পুরো সংগ্রহের একসঙ্গে প্রদর্শন। ব্রিটিশ মিশরবিদ হাওয়ার্ড কার্টার এটি আবিষ্কারের পর এই প্রথম এটি প্রদর্শিত হচ্ছে।
এই পুরো সংগ্রহের মধ্যে আছে তুতেনখামুনের দর্শনীয় সোনার মুখোশ, সিংহাসন ও রথসহ মূল্যবান সব সামগ্রী। “কিভাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হয়েছে। কারণ সমাধিটি ১৯২২ সালে আবিষ্কারের পর এর সাড়ে ৫ হাজার সামগ্রীর মধ্যে ১ হাজার ৮০০র বেশি প্রদর্শন করা হয়েছে,” বলছিলেন আন্তর্জাতিক মিশরবিদ সমিতির সভাপতি এবং গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের সাবেক প্রধান ডঃ তারেক তওফিক।
“আমার ধারণায় ছিলো পুরো সমাধি সংগ্রহ প্রদর্শন। অর্থাৎ কিছুই আর গুদামে বা অন্য জাদুঘরে থাকবে না। যাতে শত বছর আগে হাওয়ার্ড কার্টার যেভাবে পেয়েছিলেন আপনি সেভাবেই তা দেখতে পারেন”।
প্রায় বারশ কোটি ডলার (১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে তৈরি করা এই জাদুঘর বছরে অন্তত আশি লাখ দর্শনার্থী দেখতে পারবেন। এটি মিশরের পর্যটনকে চাঙ্গা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। “দ্যা গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম মিশরবিদ্যা ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের নতুন সোনালী যুগের সূচনা করবে বলে আমরা আশা করি,” বলছিলেন গিজা পিরামিডের একজন গাইড আহমেদ সেদ্দিক।
তুতেনখামুনের প্রদর্শনী আর খুফুর সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৌকা বাদ দিয়ে গ্যালারীর বেশিরভাগ সামগ্রী গত বছর থেকেই দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা আছে। “আংশিক খোলা সত্ত্বেও আমি জাদুঘরে অনেকগুলো ট্যুরের আয়োজন করেছি। এখন এটি গৌরবের চূড়ায় পৌঁছাবে। যখন তুতেনখামুনের সংগ্রহ খোলা হবে তখন আপনি কল্পনা করতে পারবেন যে পুরো পৃথিবী ফিরে এসেছে। কারণ এটা একটি আইকনিক ফারাও, সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা,” বলছিলেন আহমেদ।
লন্ডন থেকে ভ্রমণে আসা স্যাম বলছিলেন, “আমরা সেখানে গিয়ে মিশরের প্রত্নসামগ্রী দেখার জন্য অপেক্ষা করছি”। আরেকজন ব্রিটিশ পর্যটক বলছিলেন যে তিনি এর আগে তাহরির স্কোয়ারে নিওক্লাসিক্যাল মিশরিয় জাদুঘরে তুতেনখামুনের প্রদর্শনী দেখেছিলেন। নতুন তৈরি হওয়া জাদুঘর প্রায় ৫ লাখ বর্গমিটারের, যা ৭০টি ফুটবল মাঠের সমান। দেয়ালে খোদাই করা হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় লিপি। অ্যালাবাস্টার পাথরের ত্রিভুজাকার নকশা আর প্র্রবেশদ্বারে করা হয়েছে পিরামিড আকৃতির।
এই জাদুঘরে আছে ৩২০০ বছরের পুরনো পুরোনো ও ১১ মিটার লম্বা মূর্তিটি সবচেয়ে বিখ্যাত ফারাও (সম্রাট) রামেসিস দ্য গ্রেটের। এটি ২০০৬ সালে কায়রো রেল স্টেশনের কাছ থেকে নতুন জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছিলো। বিশাল সিড়ির কাছে প্রাচীন রাজা রাণীদের মূর্তি এবং উপরের তলায় বিশাল জানালা থেকে দেখা যাবে গিজা পিরামিড।
নতুন এই জাদুঘরটির প্রস্তাব করা হয়েছিলো ১৯৯২ সালে। আর নির্মাণ শুরু হয় ২০০৫ সালে। ধারনা করা হয় যে এটি নির্মাণ শেষ করতে পিরামিড নির্মাণের মতো সময় লেগেছে। তবে এই প্রকল্প বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় ও পরে কোভিড মহামারি ও আঞ্চলিক যুদ্ধগুলোর সময়ে। “এটা ছিলো আমার স্বপ্ন। জাদুঘর পুরোপুরি চালু হয়েছে দেখে আমি সত্যিই খুশী,” বলছিলেন ডঃ জাহিদ হাওয়াস। তিনি দেশটিতে দীর্ঘদিন পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন।
“এখন আমি দুটি জিনিস চাই: প্রথমত, জাদুঘরগুলো চুরি করা প্রত্নবস্তু কেনা বন্ধ করুক; দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ মিউজিয়াম থাকা রোজেটা স্টোন, লুভ জাদুঘরে থাকা ডেনডেরা জোডিয়াক, এবং বার্লিন থেকে নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তি ফিরে আসুক,” বলেছেন তিনি।
দ্যা রোসেট্টা স্টোন ১৯৯৯ সালে পাওয়া গিয়েছিলো। এটি হায়রোগ্লিফিকস পাঠোদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। ফরাসি সেনারা এটি আবিস্কার করে। তবে পরে ব্রিটিশরা যুদ্ধের পর দখল করে নেয়। অন্যদিকে ডেনডেরা জোডিয়াক একটি প্রাচীন মিশরীয় আকাশ মানচিত্র। ১৮২১ সালে ফরাসিরা একটি মন্দির থেকে এটি কেটে নিয়ে গিয়েছিলো।
এছাড়া মিশরের অভিযোগ জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশরের ফারাও আখেনাতেনের স্ত্রী নেফারতিরির মূর্তি পাচার করে নিয়ে গিয়েছিলো। “ওই তিন দেশ থেকে এগুলো ফিরিয়ে আনা দরকার উপহার হিসেবে। মিশর বিশ্বকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে,” বলছিলেন ডঃ হাওয়াস। তবে ব্রিটিশ জাদুঘর বিবিসিকে বলেছে তারা এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাননি। বিবিসি

