বাংলাদেশের মিডিয়া ও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের এক ভরসা এবং আস্থার নাম মোঃ আব্দুল হান্নান। যিনি দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন সাউন্ড বা মিউজিক স্টুডিওতে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের বিভিন্ন ট্রাবলশুটিং এর সমাধান দিয়ে আসছেন। দেশের শীর্ষ তারকা নগরবাউল জেমস, মানাম আহমেদ, রিপন খান, লাবু রহমান, ওয়ারফেইজ ব্যান্ডের বাবনা করিম, রোমেল আলি, ইবরার টিপু, অর্ণব থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মিউজিশিয়ানই তার কাছ থেকে দীর্ঘদিন যাবত এসকল টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়ে আসছেন। যার ফলে তিনি দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন সকলের ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতার এক নাম।
মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে কম্পিউটার কেনার পর নিজেই যখন জটিলতায় পড়েন তখন তা অন্য একজনের মাধ্যমে সমাধানের পর কম্পিউটারের প্রতি তার দুর্বলতা শুরু হয়। নিজেই তখন নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কাজ করতে লাগলেন। তখন কিন্তু ইন্টারনেটের এতো সহজলভ্যতা ছিলেনা। তাই নিজে নিজেই হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার এর মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হতো।

এসব নিয়ে তার আগ্রহ, অভিজ্ঞতা ও বর্তমান সময়ের ব্যস্ততা নিয়ে আড্ডা দিয়েছেন সময়২৪.কো.ইউকে এর সাথে।
আগেই জেনেছি কম্পিউটার ও সফটওয়্যারের ট্রাবলশুটিং নিয়ে আগ্রহ জন্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে। সে সময়ে (২০০৭-২০১২ পর্যন্ত) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে কম্পিউটারের নানা সমস্যার সমাধানের নাম ছিলো মোঃ আব্দুল হান্নান। যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির এক পরিচিত মুখে পরিনত হন।
এই বিষয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমার একটি সফটওয়্যারের খুব বেশি প্রয়োজন হয়। যার সাইজ ছিলো ৪জিবি। যা তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনেটের যে স্পিড ছিলো তাতে ডাউনলোড করা অসম্ভবই ছিলো। তখন আমি খুঁজতে খুঁজতে সাইন্সল্যাবে সফটওয়্যার পয়েন্ট নামে কম্পিউটারের একটি দোকান পাই। সেখান থেকে উইন্ডোজ ভিসতার সেই সফটওয়্যারটি আমি ১ দিনের ব্যবধানে ডাউনলোড করে সংগ্রহ করি।
🔲 বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনা ছেড়ে প্রফেশনাল ফিল্ডের যাত্রা শুরু যেভাবে….
মোঃ আব্দুল হান্নানঃ উইন্ডোজ ভিসতা অপারেটিং সিসটেমের ঐ সফটওয়্যারটি যে দোকান থেকে ডাউনলোড করি তিনি যখন বুঝলেন আমি মোটামুটি কাজ বুঝি ও কাজে ভালোই দক্ষতা রয়েছে তখন তিনি আমাকে তার শো-রুমে পর্টটাইম সময় দেওয়ার জন্য অফার করলেন। কারণ, তিনি নিজে একটি চাকরি করতেন বলে শো-রুমে তেমন একটা সময় দিতে পারতেন না। আমার যেহেতু মিউজিক সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করতাম তাই দেখতাম সে সময়ে DAW, VST, VSTi খুব বেশি ছিলো না। তবে কিছু VSTi তখনও অনেক বড় ফাইল ছিলো। এরপর কাজ করতে করতে আমি ২০১৩ থেকে ম্যাক অপারেটিং সিসটেম (Mac operating systems) নিয়ে কাজ শুরু করি।

🔲 সাউন্ড, অডিও বা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি যাই বলি না কেন, কিভাবে মিউজিশিয়ানদের নিকট এতো আস্থার নাম হলেন….
মোঃ আব্দুল হান্নানঃ আমি কিন্তু গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতশিল্পী, মিউজিক ডিরেক্টর বা মিউজিক কম্পোজার অথবা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নই। যেহেতু আমি কোন মিউজিশিয়ান না সেহেতু কারো কোন প্রজেক্ট বা কাজ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাই সকলে যে ধরনের সমস্যায় পড়েন সে সমস্যাগুলো আমার সাথে শেয়ার করেন। আমার মূল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সবার সমস্যার সমাধান করা। যার ফলে এই শাখাগুলোর কেউ না হয়েও সবার আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হই। আমার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার এটাই হলো মূল কারণ।

তখন সে সময়ে যারা মিউজিক সফটওয়্যারে কাজ করতেন তারা যখন জটিলতায় পড়তেন তাদের সে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য তেমন কাউকে পেতেন না। আর যারা ছিলেন তারাও সবসময় সবাইকে সময় দিতে পারতেন না। আর আমি যেহেতু এই বিষয়ে আস্তে আস্তে দক্ষ হয়ে উঠি তখন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কমবেশি অনেকের সাথেই আমার একটি সখ্যতা গড়ে উঠে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে আমি শোরুম ছেড়ে ফিল্ড লেভেলে সার্ভিস দেওয়া শুরু করি। যা আমাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।
২০১৩ থেকে আমি যখন Apple এর অপারেটিং সিসটেম নিয়ে যখন কাজ শুরু করি তখন দেখতে পাই অনেকে Apple ব্যবহার করার সামর্থ্য নেই। তখন Window operating system কে ম্যাক অপারেটিং সিসটেম (Mac operating systems) বা ম্যাক পিসিতে রুপান্তর করার একটি সিসটেম ছিলো, যাকে বলা হতো Hackintosh. যদিও অ্যাপল এটিকে কখনোই উৎসাহিত করতোনা। কারণ, অ্যাপল যে Hardware গুলো ব্যবহার করতো তার মধ্যে তারা ২০০২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত Apple Intel এর Processor ব্যবহার করতো।
এমন কিছু জিনিস মিলিয়ে আমরা Windows operating system দিয়ে Apple বা Mac এর Operating System করে ফেলতাম।
সার্ভিস দেওয়ার এক পর্যায়ে আমি বর্তমান সময়ের স্বনামধন্য সংগীতপরিচালক ইমন চৌধুরীকে এই সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা দেওয়া শুরু করলাম। এছাড়াও আমার বিষয়ে ব্যাপকভাবে সবার কাছে রেফারেন্স দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, রেজওয়ান সাজ্জাদ ভাই, সালেহ আহমেদ সামি, সোহাগ চক্রবর্তী প্রমুখ। সার্ভিস, কমিটমেন্টের কারণে উনারা আমার জন্য এতো এতো প্রচার করেছেন। আমি উনাদের কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ।
🔲 মিউজিক সফটওয়্যারের এতো কিছু জানেন কিভাবে….
মোঃ আব্দুল হান্নানঃ আসলে আমি মিউজিকের ‘ম’ও জানিনা। কিন্তু আমি সবসময় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের ভেতরেই বাস করি। এগুলোকে মনেপ্রাণে ধারণ করি। আমার বাসায় হাজার হাজার জিবি সফটওয়্যার রয়েছে। সে সকল সফটয়্যোরে কাজ করতে করতে আমি খুব ভালোভাবে জানি কোন সফটওয়্যার দিয়ে কোন কাজটি করলে তার আউটপুট কেমন হবে? আমি সবার সাথে কাজ করতে করতে সবার সাইকোলজি খুব ভালোভাবে বুঝে গেছি। কারণ মিউজিক্যাল ওয়ার্ল্ডে হাজার রকমের সফটওয়্যার রয়েছে। আপনি কোথা থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে শেষ করবেন তার কোন কূলকিনারা পাবেন না। এখানে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের কম্বিনেশন না হলে কাজ করে সুবিধা করা যাবেনা। আমি এই কাজটি খুব সহজে করে দেই বলে সবাই আমার উপর আস্থা রাখেন।
🔲 একেক মিউজিশিয়ান একেকটি সফটওয়্যারকে ভালো বলেন, আপনার দৃষ্টিতে এর কারণ কি….
মোঃ আব্দুল হান্নানঃ পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত অনেক বড় বড় মিউজিক বা অডিও সফটওয়্যার এসেছে। এগুলার প্রতিটি কিন্তু ভালো। একেকটির ব্যবহার একেক রকম বলে অনেকের মনে হয় কোনটা ভালো আবার কোনটা ভালোনা। কিন্তু আসলে বিষয়টি তেমন নয়। প্রতিটি সফটওয়্যারের কোন না কোন স্পেশালিটি আছে। যার দরুন এমনটি মনে হয়।
🔲 যে সকল মিউজিশিয়ান স্টুডিও ওয়ার্ক করেন তাদের প্রত্যেকেরই উতিত আপনি যে সেবা দিচ্ছেন তা সম্পর্কে জানা। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি….
🔲 আমরা সবসময় বলি, এটি হচ্ছে আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি। আসলে কি আমাদের দেশে সে অর্থে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি হতে পেরছে….
মোঃ আব্দুল হান্নানঃ দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সংগীতাঙ্গন এখনও সে অর্থে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে নাই। যেমন হলিউডে যাওয়ার দরকার নেই এই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখবেন বলিউড মিডিয়া, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা কেমন। তারা সেখানে যেভাবে লগ্নি করে, যেভাবে প্রমোশন করে, বিজনেস করে তার পুরোটাই প্রফেশনালিজম বজায় রেখে করে। যার ফলে তাদের সকল কিছুতেই সামঞ্জস্যতা রয়েছে। আমাদের এখানে পৃষ্ঠপোষকতার বড়ই অভাব।
স্বাক্ষাৎকার গ্রহণঃ ফাহিম ফয়সাল
নির্বাহী সম্পাদক, সময়