মায়ের চলে যাওয়া ।। আফসার নিজাম

প্রবন্ধ-কলাম শিল্প-সংস্কৃতি
শেয়ার করুন

আজকের মতোই ছিল সে দিনটি। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে সুর্য উঠেছিল। পাখিরা বাসা ছেরে উড়াল দিয়েছিলো আকাশে। মা ঘুমিয়েছিলো বিছানায়। মা অসুস্থ। দীর্ঘ ছ’মাস ধরে বিছানায়। তাঁর দুটি কিডনি অচল। ডায়াবেটিক। হৃদযন্ত্রে ব্লক। চোখ একটি আর দেখতে পায় না। মায়ের সেবায় ৫ বোনের ঘুম নেই। সাবাই পালা করে সেবা করে। মা সার্বক্ষণিক আমাকে পাশে চায়। আমি অসহায়। অফিসে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে থাকি। অফিস থেকে এসে মায়ের পাশে বসি। গল্প করি। মা অনেক গল্প করে। বিশেষ করে আব্বার গল্প।

আব্বা ইন্তেকাল করেছে ২০০১, ১২ ফেব্রুয়ারি। আব্বা ও মায়ের মধ্য গভীর প্রম ছিল। আমাদের এলাকার মহিলা পুরুষরা উদাহরন দিত বলত- ‘ভাইজু আর ভায়ুজরে দেখছ না, হেগো মধ্য কেমন মহব্বত।’ আমি সন্তান হয়েও সেই মহব্বতের জন্য হিংসা করতাম। আমি ভাবতাম- আমি বংশের একমাত্র ছেলে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবে মা। আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবে বাবা।

কিন্তু আমার মনে হতো মা আমার চেয়ে বাবাকে বেশি ভালোবাসে। বাবা আমার চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে। বাবা মাকে দেখেছি রাতকে রাত গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছে। গভীর রাতে দুজনে মিলে নামাজ পড়ছে। প্রতি রাতে এ দৃশ্য দেখে আমি ইর্ষাকাতর হয়ে উঠতাম। এতো গভীর প্রেম মুহম্মদ স ও আয়েশা রা, লাইলী-মজনু, রাঁধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুলেখা ছারা আর দেখিনি। আমার মা তাই বাবার গল্প ছারা আর কিছুই বলতো না। আর একটি প্রেম তাঁর মধ্যে বিরাজ করতো। আল্লাহ প্রেম। মা এই প্রেময়তার মাঝেই আমাদের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে লালন করেছেন। আমরা এই স্নেহ ভালোবাসা থেকে আজ অনেক দূরে।

হেপি নিউয়ার। সবাই আনন্দে দিনটি কাটাচ্ছে। শুধু আমার বুকে মা হারাবার বেদনা গুমরে উঠে। চোখের কোণে শিশিরের মতো পানি জমে ওঠে। এরপর ঝরনার মতো নেমে আসে অশ্রুধারা।

২০০৯ সালের এদিনেও আমি অফিসে যাচ্ছিলাম। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মায়ে কাছে গেলাম। মা করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মা কিছু বলবা। মা কিছু বলে না। মা কিছু খাইবা। মা কিছু বলে না। ইশারায় কাছে ডাকে। তারপর বুকে জরিয়ে ধরে। মায়ের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। আমার শার্ট ভিজে যায়। আমিও কাঁদি। আমার বোনরাও কাঁদে। মা এবার কথা বলে। সবাই মিলে মিশে থেকো। মায়ের বুক থেকে নেমে আসলাম। মা অনেক আদর করলো। চলে গেলাম অফিসে।

১০টা দিকে সেজো আপা ফোন দেয়। তুই চইলা আয়। মায়ের অবস্থা ভালা না। সাথে সাথে বাসার দিকে রওয়ানা দেই। দৌড়ে গিয়ে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ি। মা কেঁদে ওঠে। আদর করে। কিছু একটা বলতে চায়। কিছুই বলতে পারে না। আমি পানি দেই। মা পানি খায়। আমি কালেমা পড়ি। মা সাথে সাথে পড়ে। তারপর… চিৎকারে ফেটে পরে সারা বাড়ি। কান্নায় ভারি হয়ে আসে। আমার আর কিছু মনে পরে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *