২০২৫ সালের নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির জয় শুধু প্রশাসনিক রদবদলের প্রতীক নয়, বরং এটি ইতিহাসের নৈতিক রূপান্তরের এক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। আফ্রিকাজাত, দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত, ৩৪ বছর বয়সি একজন মুসলিম গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম নগরীটির নেতা নির্বাচিত করা পশ্চিমা রাজনৈতিক পরিসরে এক বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
দশকের পর দশক ধরে পাশ্চাত্যের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে হিসাব-নিকাশ ও ভয়ের রাজনীতিতে-‘অন্যের’ প্রতি ভয়, নিজস্বতা প্রকাশের ভয় এবং নৈতিক স্পষ্টতার প্রতি সংশয়ে। মামদানির বিজয় এ সবকিছুকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এটি নিছক একটি রাজনৈতিক বিজয় নয়, এটি ছিল একটি ইশতেহার, যাতে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এ প্রজন্ম আর তার আত্মপরিচয়কে গোপন করবে না, বিশ্বাসের কারণে অনুতপ্ত হবে না, কিংবা গ্রহণযোগ্যতার লোভে নিজের সত্তাকে লুকিয়ে রাখবে না।

শ্রেণিবিন্যাসের পিঞ্জর ভাঙা এক জীবন
পশ্চিমা রাজনৈতিক পরিসরে যেখানে দৃশ্যমান মুসলিম পরিচয় এখনো সন্দেহ এবং অস্বস্তির বিষয়, সেখানে মামদানির বহুমাত্রিক পরিচয় সহজেই রাজনৈতিক ‘ঝুঁকি’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু তিনি এ পরিচয়কে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং তা নিজের শক্তিতে রূপান্তর করেছেন। প্রচারণার চরম পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা বলবে, আমি আদর্শ প্রার্থী নই। আমি তরুণ, যদিও বয়সের সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। আমি মুসলিম। আমি একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী এবং সব থেকে জঘন্য বিষয় হলো, এর কোনো কিছুর জন্যই আমি ক্ষমা চাইতে রাজি নই।’
সেই উচ্চারণ নিউইয়র্কের সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে-যেখানে সংখ্যালঘু ‘অন্য’দের আজও পরামর্শ দেওয়া হয়, যেন তারা নিজেদের দৃশ্যমানতা কমিয়ে রাখে। তিনি দৃশ্যমান করে তুললেন সেই পরিচয়, যেটি অন্যদের লুকাতে বলা হয়। আর মানুষ তার সেই সততা ও সাহসকে সম্মান জানিয়েছে-ভোটের মাধ্যমে, বিশ্বাসের মাধ্যমে।

নিষিদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে, মিলনের পথ নির্মাণ
মামদানির বিজয় একাধিক ঐতিহাসিক সীমারেখা অতিক্রম করেছে : তিনি নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র, প্রথম দক্ষিণ এশীয়, প্রথম আফ্রিকান-জন্মগ্রহণকারী এবং শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সি। তবে তার রাজনৈতিক অভিযাত্রায় কখনো ‘প্রথম’ হওয়ার বিষয় মুখ্য ছিল না- ছিল এই ‘প্রথম’ হওয়ার অর্থ কী হতে পারে, সে বিষয়ে। যেখানে ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য এবং রাজনৈতিক বিভাজন ক্রমবর্ধমান, সেখানে মামদানি বিভাজনের দেওয়াল না তুলে সংহতির সেতু নির্মাণ করেছেন। তার বার্তা ছিল স্পষ্ট ও প্রতিবাদী : ‘নিজেকে লুকিয়ে নয়, দৃশ্যমান হয়েই নেতৃত্ব দাও।’ এ বার্তা একটা ঝাঁকুনি দিল সেই উচ্ছল প্রজন্মকে, যারা ‘চুপচাপ মানিয়ে নাও’ শুনতে শুনতে ক্লান্ত।
তিনি সমগ্র নিউইয়র্কবাসীর বহুবিধ বাস্তবতা-বাসস্থান সংকটে থাকা ভাড়াটে, জীবনযাত্রার ব্যয়বহুলতায় বিপর্যস্ত তরুণ এবং মৌলিক মর্যাদার বাইরে ছিটকে পড়া প্রবীণ-এসব শ্রেণিকে একত্রিত করেছেন। এ সমস্যাগুলো কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়; বরং শহরের অভিন্ন যন্ত্রণা। বাসস্থান, জীবনযাত্রার ব্যয়, পরিবহণ ও ন্যায়সংগত সুযোগ-এ বাস্তব সমস্যাগুলোকেই মামদানি তার প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছিলেন। তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল এক বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক ঐক্যজোট-যা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির সম্ভাবনা ও সৌন্দর্য। তিনি নিজের পরিচয়ের ভার বহন করে জয়ী হননি-বরং সেই পরিচয়কেই সৎভাবে ন্যায় ও আশার বৃহত্তর বুননে জুড়ে দিয়ে জয়লাভ করেছেন।

বাংলাদেশ ও প্রবাসীদের জন্য শিক্ষণীয় বার্তা
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজন্মগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। ২০২৪ সালে জেন-জি-এর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ ২.০’ গঠনের যে আন্দোলন সূচিত হয়, তা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং এক নৈতিক পুনর্জাগরণ-যেখানে হতাশাবাদ, দুর্নীতিপরায়ণতা ও নিয়তিবাদকে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
দেশের ভেতরে এবং বিদেশে থাকা-সব বাংলাদেশির জন্য মামদানির উদাহরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে আবার মনে করিয়ে দেয় : ইতিবাচক ইন্টিগ্রেশন মানেই সাংস্কৃতিক আত্মসমর্পণ নয় এবং নাগরিক অংশগ্রহণ মানেই ইসলামকে হারিয়ে ফেলা নয়। একজন ব্যক্তি তার বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও নৈতিক চেতনায় দৃঢ় অবস্থান নিয়েও নাগরিক পরিসরে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। এটি আত্তীকরণ নয়; এটিই হলো খাঁটি নাগরিকত্ব।

আগামী দিনের পরীক্ষা
বৃহৎ রাজনৈতিক বিজয় প্রায়ই গভীর বিশ্লেষণ ও প্রত্যাশার জন্ম দেয়। মামদানির উচ্চাকাক্সক্ষা সাহসী, কিন্তু তা নিউইয়র্ক শহরের গভীরভাবে প্রোথিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে পারে। এ প্রশাসনিক দায়িত্ব তার নৈতিক দৃঢ়তা ও বাস্তবতাবোধের এক যুগপৎ পরীক্ষায় পরিণত হবে।
জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি থাকবেন অব্যাহতভাবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যেই তাকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন এবং ফেডারেল তহবিল বরাদ্দ থেকে বিরত রাখার হুমকি দিয়েছেন-যা ডেমোক্রেটদের ভয় দেখানোর এবং পুরোনো বিভাজন জোরদার করার প্রচেষ্টা। আগামী সময়ই নির্ধারণ করবে মামদানি তার রাজনৈতিক আন্দোলনের নৈতিক প্রেরণাকে কার্যকর ও স্থায়ী নীতিমালায় রূপ দিতে সক্ষম হবেন কি না।

এক নতুন যুগের মাইলফলক
জোহরান মামদানির বিজয় নিউইয়র্কের স্থানীয় রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক বয়ানের অংশ হয়ে উঠেছে-যেখানে প্রামাণিকতা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকার আত্মপক্ষ সমর্থন বা ভয়ের প্রয়োজন ছাড়াই জনপরিসরে সহাবস্থান করতে পারে। এ বার্তা গভীরভাবে আশাব্যঞ্জক-বিশেষত আমেরিকার বহুত্ববাদী সমাজ, মুসলিম বিশ্ব এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য।

তার জয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র যখন শীর্ষে অবস্থান করে, তখন এটি একটি নৈতিক উদ্যোগ। এটি প্রতিটি তরুণ আদর্শবাদী, প্রতিটি অভিবাসীর সন্তান এবং সাধারণ কল্যাণে বিশ্বাসীকে বলে : তুমি দৃশ্যমান, মূলবোধে যুক্ত এবং গর্বিত হতে পার-এবং তবুও নেতৃত্ব দিতে পার। তুমি তোমার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রজ্ঞা, তোমার বিশ্বাসের গভীরতা এবং জনসেবার আহ্বান-এসব একসঙ্গে বহন করতে পার।
পুনর্জাগরণের পথযাত্রীদের জন্য-হোক ঢাকা, লন্ডন কিংবা নিউইয়র্ক-এটি শুধু অনুপ্রেরণার মুহূর্ত নয়; এটি এক নৈতিক রূপরেখা। এটি প্রমাণ করে যে, বিবেক, সাহস ও সামাজিক সংহতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনীতি বা জনসেবা এখনো জয়ী হতে পারে। ‘যদি তিনি নিউইয়র্কে পারেন, তবে আমরাও পারি-আমাদের নিজ নিজ জায়গায়’।
ড. মোহম্মদ আবদুল বারী ব্রিটিশ বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, গ্রন্থকার ও প্যারেনটিং কনসালটেন্ট

