মানবিক চিকিৎসক ডা. সায়েফ ও ভাটেরা জেনারেল হাসপাতাল

সাম্প্রতিক সিলেট
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

কানাডা প্রবাসী ডা. সায়েফ আহমদ একজন মানবিক চিকিৎসক। জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়টা কেটেছে সিলেট শহরে। পড়ালেখা করেছেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে। ছাত্রজীবন থেকেই মানবসেবার ব্রত নিয়ে কাজ করেন ক্লান্তহীন, দৃঢ়চিত্তে। অসহায় মানুষকে ভালোবেসে তিনি আনন্দিত, সেবা দিয়ে পরিতৃপ্ত।

আদর্শ সমাজ গঠনের অনুপম সংগঠক সায়েফ আহমদকে আশি ও নব্বই দশকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সিলেট থেকে জাতীয় দৈনিকে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন সময় মতবিনিময় হয়েছে। সামাজিক পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সাক্ষাৎকারও নিয়েছি।

যে কোন শিক্ষার্থী বা তাদের আত্মীয়দের হাসপাতালে সিট প্রয়োজন হলে এগিয়ে এসেছেন সায়েফ আহমদ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন হলে মেডিকেল ছাত্র হিসেবে সহজেই সে ব্যবস্থা করেছেন। কারো রক্তের প্রয়োজন, কারো আইসিইউ লাগবে, সব কিছুতেই তিনি যেন সহজ মাধ্যম। বহু পরিচিতদের দেখেছি বিভিন্ন প্রয়োজনে তার কাছে ছুটে যেতে। এলাকার মানুষের চিকিৎসার জন্য হন্য হয়েছেন। কখনো পরিশ্রান্ত বা অতিশয় ক্লান্ত হতে দেখিনি। তার কাছে কেউ আপন-পর ছিলনা। কোন লোভ বা প্রশংসার প্রত্যাশা কখনো পরিলক্ষিত হয়নি।

সায়েফ আহমদ যখন নিজেও চিকিৎসক হলেন তখন মানব সেবার পরিধি আরো বেড়ে গেল। নিজ গ্রামে চিকিৎসা শুরু করলেন। কেউ সামান্য টাকা দিলে আচ্ছা, না দিলেও সমস্যা নেই। সেবা দিয়েছেন যথার্থভাবে। তারপর বন্ধুদের পরামর্শে চলে এলেন সিলেট শহরে। এখানেও কুলাউড়ার মানুষের চিকিৎসার জন্য ছিলেন বিশেষভাবে নিবেদিত। সামগ্রীকভাবে সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করেছেন। সর্বস্তরের গরীব মেহনতি মানুষের দোওয়া ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এবং সফল সংগঠক হিসেবেও পেয়েছেন ব্যাপক খ্যাতি।

২০০০ সালে আমি চলে এলাম লন্ডন। ২০১৪ সালে ডা. সায়েফ আহমদ চলে গেলেন কানাডা। থাকেন দেশটির অন্টারিও প্রদেশের রাজধানী টরন্টো। মানবতার কল্যাণে কাজ করেন অহর্নিশ। এখন সুদূর কানাডা থেকে জন্মমাটি বাংলাদেশে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করছেন অত্যাধুনিক হাসপাতাল। মানবতার সেবার মহান লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি মননশীল মানুষদের সংঘবদ্ধ করেছেন তিনি। সকলের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ভাটেরা জেনারেল হাসপাতাল। আর এ লক্ষ্য আরো বহুদূর এগিয়ে নেয়ার জন্য চলতি সপ্তাহে ছুটে এসেছেন ব্রিটেন প্রবাসীদের কাছে।

এই চ্যারিটি চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য ডাঃ সায়েফ আহমদ পৈত্রিক বাড়ির ৩৫ ডেসিমেল জায়গা দান করেছেন। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মাত্র ২১ মাসে চিকিৎসা সেবা চালু হয়েছে। ২০২৩ সালের ৯ জুন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে ভাটেরা জেনারেল হাসপাতাল।

খ্যাতিমান সংগঠক ও মানবিক চিকিৎসক ডা. সায়েফ আহমদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে অত্যাধুনিক এবং পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়েছে। সাড়ে আট হাজার স্কয়ার ফিটের ১০ তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনের তিন তলায় চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয়েছে।

আপাতত ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আউটডোর মেডিকেল সার্ভিস এবং প্রতি শুক্রবার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে।

হাসপাতাল ভবনের নিচতলায় ১৭টি কক্ষ এখন প্রস্তুত হয়েছে। ১. এক্সরে: ইউরোপের স্বনামধন্য আগফা কোম্পানির সর্বাধুনিক ডিজিটাল এক্সরে মেশিনের সাহায্যে সকল ধরনের এক্সরে করার সুব্যবস্থা। ২. আল্ট্রাসনোগ্রাফি: সর্বাধুনিক আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন এবং দক্ষ সনোলজিস্টের সাহায্যে সকল ধরনের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার ব্যবস্থা। ৩. প্যাথলজি: সর্বাধুনিক কম্পিউটারাইজ মেশিনের সাহায্যে সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করার ব্যবস্থা। এতে যে সমস্ত কম্পিউটার মেশিন আছে তার মধ্যে ক) কম্পিউটার সেল কাউন্টার খ) বায়োকেমিস্ট্রি এনালাইজার গ) হরমোন এনালাইজার মেশিন। সিলেট এবং ঢাকার অত্যাধুনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই সমস্ত মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। ৪. অটো ইসিজি মেশিন: সর্বাধুনিক অটো ইসিজি মেশিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইসিজি রিপোর্ট প্রদান করা হয়। এই মেশিনারিজের মূল্য প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা ।

নিচতলায় বিশাল রিসেপশন ডেক্স ছাড়াও দশটি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চেম্বার রয়েছে। প্রতি শুক্রবার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ রোগী দেখেন। বর্তমানে আছেন সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আহমদ আল আমীন, গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাতিয়া রাহনুমা, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মামুন মিজানুর রহমান, ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাহিয়ান সাবির, চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তানভীর আহমেদ, চক্ষু কনসালটেন্ট অপটোমেট্রিস্ট খালেদ আল রকিব। কিছুদিনের মধ্যেই দন্ত বিভাগ এবং ফিজিওথেরাপি বিভাগ চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

এছাড়া শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন হাসপাতালের আবাসিক ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডাক্তার আলিম উদ্দিন সকাল-বিকাল রোগী দেখেন। মাত্র ১০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে ডাক্তার দেখানো যায় এবং সকল ডায়াগনস্টিক পরীক্ষায় ৩০% ছাড় দেওয়া হয়।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অফিস রুম, কম্পিউটার সার্ভার রুম ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবের প্রতিটি বিভাগ সহ রিসেপশনের কম্পিউটার সমূহ নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে সম্পৃক্ত। বিশাল ওয়েটিং রুমে প্রায় দুই শতাধিক বসার স্থান, দুইটি সিঁড়ি এবং একটি লিফটের ব্যবস্থা আছে। ভবিষ্যতে পিছনে আরেকটি সিঁড়ি এবং আরেকটি লিফটের ব্যবস্থা করা হবে ।

দোতলা এবং তিনতলার নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্ত। সকলের সহযোগিতা থাকলে এক বছরের মধ্যে রোগী ভর্তি এবং অপারেশনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে বলে কর্তৃপক্ষ আশাবাদী।

দ্বিতীয় তলায় রয়েছে সুপ্রশস্থ রিসেপশন, ওয়েটিং লবি, কর্তব্যরত ডাক্তার রুম, ইমারজেন্সি রুম, পরিচালকের রুম এবং ১১ টি রোগীর বিছানা।

তৃতীয় তলায় অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্স। এতে রয়েছে দুইটি বিশাল অপারেশন থিয়েটার, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ওয়েটিং রুম, একটি পোস্ট অপারেটিভ রুম, একটি লেবার রুম এবং কর্তব্যরত সেবিকার রুম।

• এই অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্সের দাতা হচ্ছেন ভাটেরা হোসেনপুর গ্রামের জনাব মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ৮০ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছেন।

তৃতীয় তলায় কেবিনে আটজন রোগী এবং ওয়ার্ডে ৬ জন রোগীর ব্যবস্থা আছে। ইনডোর রোগী ভর্তি শুরু হলে ২৫ জন ভর্তি রোগীর স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।

ইনডোর মেডিকেল সার্ভিস শুরু করার জন্য প্রয়োজনঃ ১) একটি অ্যাম্বুলেন্স ২) সমগ্র হাসপাতালে অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা ৩) এনেসথেসিয়া মেশিনসহ অপারেশন থিয়েটারের সমস্ত যন্ত্রপাতি ৪) লেবার রুমের যন্ত্রপাতি ৫) পোস্ট অপারেটিভ রুমের যাবতীয় সরঞ্জামাদি। ৬) ২৫টি বেড সহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি। এতে প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। টাকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সেবা প্রদানে কর্তৃপক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

অনুদান ও স্বীকৃতি: সাদাকায়ে জারিয়া হিসাবে ২৫ জন দাতা সদস্য ১০ লক্ষ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। ১ লক্ষ টাকার উপরে এবং ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দান করেছেন ৭৬ জন। মোট ৩৬২ জন দেশি-বিদেশি দাতা সদস্য এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। প্রতিটি কক্ষে ১০ লক্ষ টাকা দাতা সদস্যদের মনোনীত ব্যক্তির নাম ফলক টানানো আছে। হাসপাতালের প্রবেশপথে ১০ লক্ষ এবং ১ লক্ষ টাকা প্রদানকারী দাতাগনের নামের তালিকা সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

দেশ-বিদেশের সকল ভাই-বোনদের কাছে সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে দান করার জন্য ডাঃ সায়েফ আহমদ আকুল আবেদন জানিয়েছেন।

Bhatera General Hospital website: http://bhaterageneralhospital.com/ Facebook page of BGH: https://www.facebook.com/bhaterageneralhospital Please Donate: Bhatera General Hospital A/C No-4473901003408 Pubali Bank LTD, Bhatera bazar Branch.Moulvibazar, Sylhet, Bangladesh

* সাঈদ চৌধুরী- সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *