ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা বিভাগের সম্প্রচারক দিলারা হাশেম’র চিরবিদায়

মতামত সময় টিভি সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাইফুর রহমান ওসমানী জিতু: ‘খবর পড়ছি দিলারা হাশেম…’, এক যাদুকরী আইকনিক সম্প্রচারক কন্ঠস্বরের ছন্দপতনে শোকাহত ওয়াশিংটন ডিসি’র ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগের পরিবারসহ বিশ্বের অগণিত দিলারা হাশেমের ভক্ত, শ্রোতা আর পাঠক-পাঠিকারা।

বেতার সম্প্রচারক দিলারা হাশেম গেলো শনিবার (১৯ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহে ওইন্না ইলাইহে রাজেউন)। ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগের বেতার ও টেলিভিশনের হারিয়ে যাওয়া প্রয়াত বেতার সম্প্রচারক ব্যক্তিত্বের মধ্যে অসংখ্য তারার মাঝে সংযোজিত হলো, আরো একটি নাম: দিলারা হাশেম। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৮৬ বছর।

দিলারা হাশেম ছিলেন, এক অসাধারণ বহুমূখী প্রতিভার বেতার ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্য চর্চা, বেতার ও টেলিভিশন সম্প্রচারক হিসাবে একজন জনপ্রিয় সংবাদ পাঠিকা ছাড়াও তিনি ছিলেন অনুবাদক, লেখিকা ও ঔপন্যাসিক। সমান্তরালভাবে, একজন ভালো সঙ্গীতশিল্পী হিসাবেও তিনি তার দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। রেডিও ও টেলিভিশনে সংবাদ পাঠিকা ছাড়াও তিনি পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য চর্চার কাজগুলো সচল রেখেছিলেন।

তাঁর বহুমূখী প্রতিভার প্রমান মেলে, ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়ের একটি বাংলা ছায়াছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাবও তিনি বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেন। যতদূর জানা যায়, পরিবারের কথা ভেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাবটি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৫৬ সালে দিলারা হাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

এক ঝলকে দিলারা হাশেমের বর্নাঢ্য জীবন কাহিনী:
১৯৬৫ সালে ‘ঘর মন জানালা’ নামে দিলারা হাশেমের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় এবং ১৯৭৩ সালে সে উপন্যাসটির গল্পের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে একটি চলচ্চিত্রও নির্মীত হয়েছিলো। এ উপন্যাসটি এতই জনপ্রিয়তা লাভ করে, যেটা পরবর্তিতে রুশ ও চীনা ভাষায় অনূবাদ করে প্রকাশ করা হয়। একজন প্রতিষ্ঠিত বেতার আর টেলিভিশন সম্প্রচারকের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে তিনি এক অনন্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৬ সালে দিলারা হাশেম ‘বাংলা একাডেমী’ পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হন।

কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেম রচিত উন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘বাদামী বিকেলের গল্প’, ‘আমলকীর মৌ’, ‘অনুক্ত পদাবলী’, ‘সদর অন্দর’, ‘শঙ্খ করাত’, ‘একদা এবং অনন্ত’, ‘স্তব্ধতার কানে কানে’, ‘কাকতালীয়-সহ বিভিন্ন উপন্যাস। তার লেখা গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে – ‘হলদে পাখির কান্না’, ‘সিন্ধু পারের কান্না’, ‘নায়ক’-সহ অনেক প্রকাশিত গল্প কাহিনী। তার রচিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ফেরারি’।

বাংলা সাহিত্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সম্প্রচারক ও ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেমের কাজের স্বীকৃতির অর্জনের তালিকায় রয়েছে:

* বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৬)
* শঙ্খচিল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪)
* উত্তর শিকাগো ‘কালচারাল এ্যান্ড লিটারারি ইঙ্ক’ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭)
* অলক্ত পুরস্কার (২০০৪)
* মুক্তধারা জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯)

বেতার সম্প্রচারক হিসাবে দিলারা হাশেম প্রথম কর্মজীবন শুরু ১৯৬৫ সালের দিকে, রেডিও পাকিস্তান করাচি থেকে বাংলা সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। পরে তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত বাংলা সংবাদ পাঠিকা হিসাবে কাজ করেন। এছাড়াও, বিবিসি লন্ডনেও তিনি সাময়িক সময়ের জন্য বাংলা সংবাদ পরিবেশন করেন। ১৯৭৬ সালে দিলারা হাশেম ভয়েস অফ আমেরিকায় বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। একটানা ৩৫ বছর পর ২০১১ সালে তিনি ভয়েস অফ আমেরিকা, বাংলা বিভাগ থেকে অবসর নেন।

ওয়াশিংটন ডিসিতে ভিওএ’র কার্যালয় পরিদর্শন ও সম্প্রচারক দিলারা হাশেমের সঙ্গে পরিচয়ের কিছু স্মরনীয় মূহূর্ত….
১৯৯৮ সালে আমার ব্যক্তিগত সুযোগ হয়েছিলো, সম্প্রচারক দিলারা হাশেমের সঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসিতে ভিওএর কার্য্যালয় সরাসরি পরিচিত হবার। আর এটি সম্ভব হয়েছিলো, ভয়েস অফ আমেরিকার একজন সংবাদ প্রতিনিধি হয়ে কাজ করার সুবাদে। ১৯৮৬ সালের কথা। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বেতার -টেলিভিশন সম্প্রচারক এবং আবৃত্তিকার ইকবাল বাহার চৌধুরী তখন ভয়েস আমেরিকার বাংলা বিভাগ প্রধানের দায়িত্বে।

একদিন ইকবাল ভাই ওয়াশিংটন থেকে আমাকে ফোন করে জানালেন, ভয়েস অফ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল লস এন্জেলেস সংবাদ প্রতিনিধি নিয়োগের জন্য প্রার্থীর প্রয়োজন। আমি সে প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতে আগ্রহী কিনা? ইকবাল ভাইয়ের কাছ থেকে এ কথা শুনে, সত্যি বলতে কি, আমি অনেকটা ভাব-বিহব্বল হয়ে গিয়েছিলাম! ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে আমার কাজ করার এ লুকায়িত স্বপ্ন ছিলো- দীর্ঘদিনের।

৭০’র দশকে তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং এর পাশাপাশি আমি তখন বাংলাদেশ বেতারেরও একজন নিয়মিত অনুষ্ঠান ঘোষক। ‘সুখী সংসার’ নামে সান্ধ্যকালীন এক ঘন্টার একটি বেতার অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠান সঞ্চালক। আমার সহকারী অনুষ্ঠান ঘোষিকাদের মধ্যে ছিলেন, শাহিদা আরবী, নিলুফার করিম, লাকী ইনাম, অন্জলী মোস্তফাসহ আরো বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ঘোষিকা।

বেতারের অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা ও সাহস সঞ্চার করে ভিওএ’র বাংলা বিভাগে বেতার সম্প্রচারক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য একবার ঢাকা থেকে পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। কিন্তু, কৃতকার্য হতে পারিনি। তবে প্রাপ্তি হিসাবে আমি যে কিছুই পাইনি, তা অবশ্য বলা যাবে না! তার কারণ, দুঃখ প্রকাশ করে ‘আবেদন নামুঞ্জুর’ করার চিঠি যে এত সুন্দর করে লেখা সম্ভব, সে স্বাদটুকু পেলাম ওয়াশিংটন ডিসির ভিওএ’র বাংলা বিভাগের অফিস থেকে পাঠানো আমার নামে নীল খামের ভেতরে লেখা অপারগতার এক চিঠির মাধ্যমে। আকাঙ্খিত কাজটি না পাবার যে কষ্ট আমি সাময়িক পেয়েছিলাম, সেটা ভিওএ’র অপারগতার চমৎকার চিঠি, নিঃসন্দেহে আমার আহত হৃদয়ে সে বেদনাটুকু মুছে দিয়েছিলো।যাই হোক, ফিরে আসি ইকবাল ভাইয়ের প্রস্তাবের কথায়! আমার তো ইকবাল ভাইয়ের কথা শুনে মনে হলো, এ যেনো অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! ১৯৮৬ সালে ইকবাল বাহার চৌধুরী তিনি আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে ভয়েস অফ আমেরিকার লস এন্জেলেস প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ দেন। তারপর থেকে ভিওএ’র পরিবারের সাথে আমার দীর্ঘ ২১ বছর পথচলা।

তবে একটি কথা না বললেই নয়। আজও আমার নিজেরই ভাবতে অবাক লাগে, ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ হয়ে সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করার যে ইচ্ছা আর আকাঙ্খা বাংলাদেশ থেকে যেটা সফল হয়নি, আমেরিকার মাটিতে সেটা সম্ভব হলো কিভাবে? পরম করুনাময় আল্লাহ মহা-পরিকল্পনাকারী! তিনিই সম্ভবত: আমার ধৈর্য্য ধারনের পুরস্কার হিসাবে, আমেরিকার মাটিতে মহান করুনাময় আমার স্বপ্ন পূরণ করলেন। শুকরিয়া আদায় করছি, মহান প্রতিপালকের কাছে।

ওয়াশিংটন ডিসি শহরে এসে পৌঁছুবার পর রোকেয়া আপা আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন, ভিওএ’র অফিসে আমি যেনো সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচারের কিছু আগে স্টুডিওতে চলে আসি। তাহলে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার দৃশ্যগুলো সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাবো। এছাড়াও, ওয়াশিংটন ডিসির প্রধান স্টুডিও থেকে কাজ করার আলাপ আলোচনা ও সম্ভাবতা যাচাইয়ের উদ্দেশেও ভিওএ’র স্টুডিও ভ্রমনের আরো একটি অন্তঃনিহীত কারন ছিলো। এমনি ধরনের একটা লুকায়িত ইচ্ছা বহুদিন আমি মনে মনে ধারণ করে রেখেছিলাম।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, ৭০’র দশকে বাংলাদেশ থেকে রেডিওতে সর্ট ওয়েভ ও মিডিয়াম ওয়েভ মিটার ব্যন্ডে ইথারে ভেসে আসা বেতার অনুষ্ঠান শোনার অভিজ্ঞতার কথা। ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি, ডয়েচ ভেলে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবানী কলকাতা আর সিলোন ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের ‘আমিন সাইয়ানী’ পরিবেশিত ‘বিনাকা গীতমালা’ বেতার অনুষ্ঠানগুলো রেডিওতে শোনার অভিজ্ঞতা আপনাদের অনেকেরই হয়ত মনে আছে?

বিশেষ করে সর্ট ওয়েভ মিটার ব্যান্ড থেকে প্রচারিত বেতার অনুষ্ঠানগুলো শুনতে গেলে শব্দের আসা-যাওয়ার লুকোচুরির মধ্যে কেমন যেনো একটা-নস্টালজিক মজার ব্যাপার ছিলো। আগ্রহ হতো, যেখান থেকে এ অনুষ্ঠানগুলো প্রচার করা হয়, তা যদি কখনো কাছাকাছি থেকে দেখার সুযোগ পেতাম! আর এর যোগসূত্রের একটি বিরাট অংশ জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো, ‘ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব’।

ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব:
বাংলাদেশে ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠানের সর্বশেষ তথ্যগুলো পেতাম, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রথম সারির দৈনিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব’র দ্বারা প্রেরিত সংবাদের মাধ্যমে। ‘ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব’ সমগ্র বাংলাদেশে জনহিতকর কার্যক্রম ছাড়াও তাদের শাখাগুলোর মাধ্যমে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বেতার অনুষ্ঠান প্রচার ও প্রসারে -এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র বাংলাদেশে ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব’র ইতিবাচক ও সম্প্রসারণের ফলে ভিওএ ওয়াশিংটন বাংলা বিভাগ ও ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাবগুলোর মধ্যে শ্রোতাদের কৌতুহলী তথ্য আদান-প্রদান এবং সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছিলো।

এ সংগঠনের বাড়তি সুযোগ হিসাবে সংগঠনের সকল সদস্য-সদস্যদের ছিলো ‘গোপন পাশ’, বলা যেতে পারে ‘Back Stage Pass’। অর্থ্যাৎ, তাদের প্রিয় বেতার সম্প্রচারকরা ঢাকায় এলে, তাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজনে সরাসরি অংশগ্রহনের সূযোগ, ভক্তদের কৌতুহলী প্রশ্ন আর মুহূর্তটিকে স্মরনীয় করার জন্য সম্প্রচারকদের সাথে ছবি তোলার বিশেষ সুবিধা। আর এই সংগঠনটির নেতৃত্ব দেন, বর্তমান নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বিশিষ্ঠ সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরণ। ‘ভয়েস অব আমেরিকা ফ্যান ক্লাব’ সমগ্র বাংলাদেশে একটি সুসংগঠিত সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সম্প্রচারকের পরিচিতি এবং শ্রোতাদের জনমত যাচাইয়ে পরিসংখ্যান সংগ্রহে- এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। সেখান থেকে বিভিন্ন তথ্যাদি ভয়েস অফ আমেরিকা সম্পর্কে নতুন শ্রোতাদের আরো বেশী আগ্রহী করে তোলে।

অবশেষে, এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ! লস এঞ্জেলস শহর থেকে সরাসরি ওয়াশিংটন ডিসি যাত্রা। গন্তব্যস্থল: ভয়েস অফ আমেরিকা ৩৩০, ইন্ডিপেন্ডেন্টস এ্যভেনিউ, ওয়াশিংটন ডিসি। ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা বিভাগের প্রধান কার্যালয়।

ওয়াশিংটন ডিসি শহরে এসে একটি হোটেল আমি অবস্থান নেই। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আমি ভয়েস অফ আমেরিকার ইন্ডিপেন্ডেন্টস এ্যভেনিউর মূল ভবনে এসে পৌঁছুলাম। নিরাপত্তা বেস্টনি পেরিয়ে সরাসরি ইকবাল ভাইয়ের অফিস কক্ষে। আমাকে দেখেই ইকবাল ভাই স্মিত হেসে বললেন, ‘তা’হলে তুমি এসে গেছো?’ কুশল বিনিময়ের পর বললেন, ‘ওপাশে রোকেয়া আছে, যাও তার সাথে দেখা করে এসো?’

রোকেয়া আপা আমাকে দেখে ভীষণ খুশী হলেন। ১৯৮৪ সালে রোকেয়া আপার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়, লস এঞ্জেলস অলিম্পিক অনুষ্ঠানে। খেলার সংবাদ ও তথ্য সংগ্রহের জন্য রোকেয়া আপা ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে যোগ দিতে এসেছিলেন। আর আমি সে সময়টিতে, অলিম্পিক নিরাপত্তা কর্মী হিসাবেও বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও অলিম্পিক পল্লীগুলোতে কর্মরত ছিলাম।

যা হোক, রোকেয়া আপা আমাকে জানালেন কিছু সময়ের পর অনুষ্ঠান শুরু হবে, চলো তোমাকে আমাদের স্টুডিওটা চট করে দেখিয়ে নিয়ে আসি। রোকেয়া আপার সাথে আমি ভিওএ’র স্টুডিওটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। দেখলাম প্রত্যেক সম্প্রচারকদের জন্য রয়েছে আলাদা ডেস্ক, কম্পিউটার আর টেলিফোন। সেখানে বসেই তারা তাদের সংবাদ তৈরী করার কাজগুলো সমপন্ন করছেন।

রোকেয়া আপা পরিচয় করিয়ে দিলেন, অনেক ভিওএ’র কর্মকর্তার সঙ্গে, যাদের বেতারে কন্ঠ শুনেছি, কিন্তু কখনো সরাসরি দেখার সুযোগ ঘটেনি। ভিওএ’র অফিস কার্যালয়ে সেদিন আমি ছিলাম, একমাত্র অপরিচিত মূখ। স্বাভাবিকভাবে আমাকে দেখে অনেকের চেনার কথা নয়। রেডিওতে আমার কন্ঠের সাথে হয়ত অনেকে পরিচিত, কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলোনা। তাই নাম বলার সাথে সাথে অনেকে বলে উঠলেন ‘ও! আপনি সেই জিতু’? স্টুডিওটি আমি একা একা ঘুরে দেখছিলাম। দেখলাম সবার মধ্যে অনেক ব্যস্ততা, কেননা কিছুক্ষন পর সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রসারিত হবে। সেদিনের প্রতিটি মূহূর্তগুলো ছিলো, আমার জীবনের এক স্মরনীয় ঘটনা।

একটি ছোট্ট বুথের সামনে এগিয়ে যেতেই আমার চোখ কিছুক্ষনের জন্য স্থির হয়ে গেলো, অনেকটা থমকে গেলাম! দেখতে পেলাম এক পরিচিত মূখ। মাথা নিচু করে আনমনে তিনি টেবিলে কিছু লিখছেন। টেবিল ল্যাম্পের আলোতে চেহারাটা বেশ উজ্জ্বল মনে হলো। চোখে চশমা পড়ে আনমনে বসে কাজ করছেন। ভাবলাম এসেছি যখন, তখন দেখা করেই যাই। কেননা, জীবনে এ সুযোগ আমার আবার না-ও আসতে পারে! চিনতে আমার আর বাকি রইলো না, তিনিই সে বিখ্যাত সম্প্রচারক, দিলারা হাশেম।

আমি ক্ষীন স্বরে দিলারা আপাকে সালাম দিতেই, আমার দিকে একটু হেসে তাকিয়ে আমাকে চেনার চেস্টা করছিলেন? আমার পরিচয় দিতেই, বলে উঠলেন ‘ও তুমি সেই জিতু, আমাদের লস এন্জেলেসের সংবাদদাতা… তোমার কথা অনেক শুনেছি রোকেয়া আপা আর ইকবাল ভাইয়ের কাছে। তোমার পাঠানো প্রতিবেদনগুলো বেশ ভালো হচ্ছে … ইত্যাদি ইত্যাদি’। এমন একজন প্রখ্যাত বেতার সম্প্রচারকের কাছ থেকে এ ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরনামূলক মন্তব্য আমার জন্য ছিলো- এক বাড়তি পাওনা। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, “বসো”। এই প্রথম দিলারা আপার সাথে সরাসরি পরিচয় হলো। এরপর চলে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেকটা বিরামহীন আলোচনা।

আমি দিলারা আপার সম্পর্কে বরাবরই জানতাম একজন অভিজ্ঞ বেতার ও টেলিভিশন সম্প্রচারক। কিন্তু দীর্ঘ আলাপের পরিপ্রক্ষিতে সেদিনই জানাতে পারলাম, তিনি একজন বেতার সম্প্রচারকই নন, তার পাশাপাশি একজন জনপ্রিয় লেখিকা। তার লেখা অনেক বইও প্রকাশিত হয়েছে। এটি ছিলো আমার অক্ষমতা, দিলারা আপার সম্পর্কে লেখালেখির বিষয়টি সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা না থাকার বিষয়টি। সাময়িক আলাপচারিতায় তিনি এতই আন্তরীক ছিলেন যে, বোঝার উপায় নেই মনে হচ্ছিলো ওঁনার সঙ্গে যেনো আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়।

যতদূর মনে পড়ে ৬০’র দশকে পাকিস্তান রেডিওতে তৎকালীন বাংলা সংবাদ পড়তেন, সরকার কবীরউদ্দিন ও দিলারা হাশেম। আমার অনেক কৌতুহলী প্রশ্ন ছিলো, বিশেষ করে করাচীর বাংলা সংবাদ পাঠিকা, বিবিসি বাংলা বিভাগ, বাংলাদেশ বেতার আর বাংলাদেশ টেলিভিশনে এ দীর্ঘ সময়ে কিছু স্মৃতিচারণ করার। তন্ময় হয়ে শুনছিলাম আপার কথাগুলো।

সে প্রসংগে তিনি জানালেন একটি নতুন বই লেখার কাজ করছেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকার প্রধান স্টুডিওতে আমার দূ’বার যাবার সুযোগে হয়েছিলো। সেখানে দিলারা আপা-সহ ইকবাল বাহার চৌধুরী, রোকেয়া হায়দার, সরকার কবিরউদ্দিন, মাসুমা খাতুন, ইকবাল আহমেদ, সেগুপ্তা নাসরিন কুইন, আনিস আহমেদ, অসীম চক্রবর্তী, তাহিরা কিবরিয়া-সহ আরো অনেক প্রখ্যাত ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগের সম্প্রচারকদের সাথে আমার ব্যক্তিগত সরাসরি আলাপ- পরিচয় হয়। এছাড়াও, লস এঞ্জেলস থেকে সংবাদ প্রেরণের পূর্ব মূহুর্তে টেলিফোনে নতুন আগত ভিওএ পরিবারের সদস্য আহসানুল হক, সেলিম হোসেন’সহ অনেকেরই সাথে পরিচয় হয়। সে এক অনন্য অনুভূতি। একই জায়গায় ভয়েস অফ আমেরিকার অধিকাংশ তারকা সম্প্রচারকদের পাওয়া, সত্যি কল্পনাতীত!

ফেইসবুকে দিলারা হাশেমের মৃত্যুর সংবাদ দেখে অনেকটা হতবাক! আজ বিশেষ করে ভীষন মনে পড়ছে, ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস আমেরিকার স্টুডিওতে দিলারা হাশেমের সঙ্গে সে স্মৃতিগুলোর কথা। তিনি চলে গেছেন সত্যি, আর কোনদিন ফিরে আসবেন না। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে তাঁর রেখে যাওয়া বিভিন্ন প্রকাশিত গল্পের বই, উপন্যাস, সাহিত্য আর শিল্পকর্মের মাঝে । দোয়া করি, আল্লাহ যেনো ওঁনাকে বেহেস্তের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমিন।

দিলারা হাশেম
জন্ম: ২৫ আগস্ট ১৯৩৬
মৃত্যু: ১৯ মার্চ ২০২২।

প্রতিবেদক:
সাইফুর রহমান ওসমানী জিতু
প্রাক্তন ভিওএ লস এঞ্জেলসের সংবাদদাতা,
ভয়েস অফ আমেরিকা (বাংলা বিভাগ)
ওয়াশংটন ডিসি।

 

 

 

 

* তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *