‘ভারত-চীনের সার্টিফিকেট নিয়েও সাত পার্সেন্ট ভোট পায়নি আওয়ামী লীগ’

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

মুকিমুল আহসান

তিন মাস পর হাতে কালো পতাকা নিয়ে আবারো রাস্তায়ে নেমেছে বাংলাদেশের সরকার বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। এই কর্মসূচি থেকেই সংসদ বাতিলের দাবিতে ৩০ জানুয়ারি আবারো কর্মসূচি ঘোষণা করে নির্বাচন বর্জন করা এই দলটি।

বিএনপির এই কর্মসূচির প্রতিবাদে আগের মতোই পাল্টা শান্তি সমাবেশে করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এসময় ৩০ জানুয়ারি বিএনপির কালো পতাকা মিছিলের বিরুদ্ধে লাল সবুজ পতাকা নিয়ে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন দলটি।

শনিবার দুপুরে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে কর্মসূচি শুরুর আগে বক্তব্য দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। যেখানে তারা দাবি করেন, “ভারত-চীনের সার্টিফিকেট নিয়েও সাত পার্সেন্ট ভোট পায়নি আওয়ামী লীগ”।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভাপতি গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এসময় বলেন, “এই নির্বাচনে মাত্র সাত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশের বাকি ৯৩ ভাগ মানুষ বিএনপির পক্ষে। সেটি এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে’।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয় বিএনপির এই কর্মসূচি থেকে।

আর এর জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “বিএনপির আন্দোলন মানুষ মানে না। ৪১ দশমিক আট পার্সেন্ট ভোটারের ভোটে শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচিত হয়েছে”।

তিন মাস পর বিএনপির কর্মসূচিতে যে চিত্র দেখা গেলো

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তি, সংসদ বাতিলের দাবিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় গত সপ্তাহে।

বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ একসাথে এই কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচি উপলক্ষে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে মঞ্চ তৈরি করা হয়। এতে অংশ নিতে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেন নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সবার হাতেই ছিল কালো পতাকা। কেউ কেউ দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অংশ নেন সমাবেশে।

দুপুর দুইটায় কর্মসূচির সময় থাকলেও বেলা ১২টা থেকেই প্রধান কার্যালয়ের সামনে মিছিল নিয়ে অনেকেই জড়ো হতে থাকেন। স্লোগান দেন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাতিল ও কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবি জানিয়ে।

দুপুর দুইটার পরপরই কাকরাইলের নাইটেঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল এলাকা পর্যন্ত রাস্তার এক পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

নির্বাচনের আগে গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচিগুলোতে বিএনপি নেতাকর্মীদের উপস্থিতি যেমন ছিল, তিন মাস পর এই কর্মসূচিতে সেই তুলনায় নেতাকর্মীদের সংখ্যা ছিল কম।

২৮ অক্টোবরের সেই কর্মসূচির পর গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা। দলীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকের ওপর যে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে সেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই ছিলেন অনুপস্থিত।

দুপুর দুইটায় মোনাজাতের মাধ্যমে শুরু হয় কর্মসূচি। পরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে কালো পতাকা মিছিল করে বিএনপি। মিছিলটি নাইটেঙ্গেল মোড় হয়ে ফকিরাপুল-আরামবাগ মোড় ঘুরে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়।

যা বলছেন বিএনপি কর্মীরা

বিএনপিকর্মী বশিরুল আলম টিটু এসেছিলেন এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মামলা-হামলা নির্যাতনের পরও বিএনপি নেতাকর্মীদের আন্দোলনের মাঠ থেকে এক বিন্দুও সরাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বরং বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় সাধারণ মানুষ সাড়া দিয়েছে, এটাই বিএনপির আন্দোলনের সফলতা”।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিএনপি কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। ভয়ভীতির পর এতো মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে বিএনপি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েনি। নেতাকর্মীদের এই মনোবল আন্দোলনকে বেগবান করবে”।

“এই আন্দোলনে হঠাৎ করেই সরকারের পতন ঘটবে”, এমন আশাবাদের কথা জানান মি. খোকন।

ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেন কালো পতাকা হাতে। পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে অনেককেই স্লোগান দিতে দেখা যায়।

স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক জাকির হোসাইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের মুক্তি এবং সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতেই আমরা অনড় আছি। সেই দাবিকে সামনে নিয়েই আমরা কালো পতাকা মিছিল করছি”।

“তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীরা জেল, জুলুম ও নির্যাতন শিকার হচ্ছে। তাদের জেল থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছি। তাদেরকে বের করে আনার মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের নতুন করে আশার সঞ্চার হবে। বিবিসিকে বলছিলেন মি. হোসাইন।

কী বলছেন নেতারা?

সরকারের পদত্যাগ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা ইস্যুতে বক্তব্য দেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে নতুন আন্দোলন কর্মসূচিও ঘোষণা করে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বলেন, “তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি সৃষ্টি করেছে, দেশকে বিভাজন করেছে। আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো। সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজাতে মাঠে নেমেছে বিএনপি”।

মি. খান বলেন, “দেশের সাধারণ মানুষ এই সরকারকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা গায়ের জোরে, পুলিশ দিয়ে, রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে যে নির্বাচন করেছে জনগণ তা চায়নি। এজন্য সাধারণ মানুষ নির্বাচন বর্জন করেছে।

ক্ষমতার জন্য বিএনপি রাজনীতি করে না দাবি করে দলটির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “বিএনপি একদলীয় শাসনের পরিবর্তন চায় একটিমাত্র কারণে, বাংলাদেশের মানুষ কখনো একদলীয় শাসন বরদাস্ত করেনি, করবেও না”।

বিএনপির এই কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, “দেশের স্বাধীনতা এখন প্রায় বিপন্ন। কয়েকটি দেশের সার্টিফিকেট নিয়ে নির্বাচন বৈধতা নেয়ার সুযোগ নেই। এটি জনগণের নয়, চীন-ভারত আর রাশিয়ার সরকার হচ্ছে আওয়ামী লীগ”।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “সংবিধান রক্ষার নয়, লুটপাট, দুর্নীতি আর পাচারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সাতই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ”।

বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যের জবাব দিতে দেখা গেছে দলটির নেতাদের।

“বিএনপিকে ভয় দেখানোর কিছু নাই। পুলিশি পাহারা ছাড়া বের হতে পারে না আওয়ামী লীগ। মামলা দিয়ে কোনো লাভ হবে না”, বলেন মি. রায়।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের নয়, চীন রাশিয়া ভারতের সরকার। তাই এই সরকারকে মানতে বাধ্য নয় জনগণ। পরিষ্কার কথা, দেশের সমস্যা দেশের মানুষই সমাধান করবে।

বাংলাদেশের মানুষ যদি স্বীকৃতি না দেয় তবে বিদেশিদের সার্টিফিকেটে লাভ হবে না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য।

“দ্বিতীয় দফায় আন্দোলন শুরু হলো। বিজয় নিয়েই ঘরে ফিরবে জনগণ”, বলেন মি. রায়

এতে ঢাকা মহানগর, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও বক্তব্য দেন। যেখানে তারা নির্বাচন বাতিল করে নতুন ভোটের দাবি জানান। এছাড়াও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানানো হয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল ও পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে আগামী ৩০ জানুয়ারি মঙ্গলবার সারাদেশের মহানগর, থানা, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভায় আবারো কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।

সমমনাদের কর্মসূচি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

বিএনপির এর আগের কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে তৎপরতা ও প্রস্তুতি দেখা যেতে এবার তার খুব একটা চোখে পড়েনি।

নাইটেঙ্গেল মোড় ও ফকিরাপুল মোড়ের দুই পাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ সদস্যদের দেখা গেছে। এছাড়া নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিক উল্টো পাশে সারিবদ্ধভাবে অবস্থান করতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র‍্যাব কিংবা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি, কিংবা কঠোর কোনো নিরাপত্তা বলয়ও ছিল না এই কর্মসূচি ঘিরে।

একই দিন যুগপৎ ভাবে কর্মসূচি পালন করে সমমনা কয়েকটি দল। বেলা এগারোটায় বিজয়নগর পানির ট্যাংকের সামনে থেকে মিছিল করে এলডিপি। সাড়ে ১২টায় একই জায়গায় মিছিল করে ১২ দলীয় জোট।

বেলা একটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মিছিল করে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। অন্যদিকে বেলা সাড়ে ৩ টায় মতিঝিল নটরডেম কলেজের উল্টো দিক থেকে মিছিলে অংশ নেয় গণফোরাম ও পিপলস পার্টি।

আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচি

গত প্রায় এক বছর ধরে বিএনপি আন্দোলনের যে সব কর্মসূচি পালন করেছে তার বিপরীতে একই দিন একই সময় নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

২৮ অক্টোবরের তিন মাস পর শনিবার বিএনপি কালো পতাকা নিয়ে মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করলে এর বিরুদ্ধে পাল্টা শান্তি সমাবেশ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এই কর্মসূচির ঘোষণা করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দুপুরের পর থেকেই আসতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এ সময় বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের জবাব দেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, “ভারত-চীন ও রাশিয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়নি। তারা কেবল বন্ধু রাষ্ট্র। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ”।

এসময় মি. কাদের বলেন, “বিদেশিদের ভয় দেখায়। ৪১ দশমিক ৮ পার্সেন্ট ভোটারের ভোটে শেখ হাসিনা সরকার নির্বাচিত হয়েছে। এটা জনগণের সরকার। কোনও বিদেশিদের সরকার নয়”।

বিএনপির কর্মসূচির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “তারা কালো পতাকা মিছিল করে। কালো পতাকা মানে কী, শোকের মিছিল। কালো পতাকা ভুয়া। বিএনপির নেতাকর্মীরা হতাশ। তারা আর তারেকের ফরমায়েশি কথায় কান দেয় না। খেলা একটা হয়ে গেছে, নির্বাচনের খেলা শেষ। এখন খেলা হবে রাজনীতির”।

দ্রব্যমূল্য শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেও প্রত্যাশার কথা জানান মি. কাদের।

আগামী ৩০ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন বিএনপির কর্মসূচির বিপরীতে একই সময় পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেন ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক।

তিনি বলেন, “আগামী ৩০ জানুয়ারি বিএনপি কালো পতাকা মিছিল ডেকেছে। সেদিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রস্তুত থাকবেন। সারাদেশে লাল সবুজ পতাকা নিয়ে শান্তি ও গণতন্ত্র মিছিল করা হবে”। – বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *