ব্রিটেনে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন ।। সাঈদ চৌধুরী

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন বিশ্বজুড়ে বাংলাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা হিসেবে মর্যাদার আসন লাভ করেছে আমাদের ভাষা-সংগ্রামীদের অবদান ও আত্মদান। লেখার শুরুতে তাদের প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের ‘শহীদ দিবস’ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে অভিষিক্ত। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা – ইউনেস্কো (THE UNITED NATIONS EDUCATIONAL, SCIENTIFIC AND CULTURAL ORGANIZATION – UNESCO) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। ১৯৯৯ সাল থেকে ভাষা শহীদের সম্মানে এই দিবস পালন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পর ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয়। লন্ডনের ‘বাংলা টাউন’ ব্রিকলেন ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

পৃথিবীর প্রায় সকল প্রান্তেই এখন বাংলা চর্চা হয়। শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয়। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, মেলবোর্ন, শিকাগো, হাইডেলবার্গ, মন্ট্রিয়ল, টোকিও, বেইজিং সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার ব্যাপকতা লাভ করেছে।

ব্রিটেনের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে গুরুত্বের সাথে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। গবেষণা হয় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি (UNIVERSITY OF OXFORD)

শিক্ষা ও গবেষণা এবং একাডেমিক সিস্টেমের জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। ব্রিটেনের যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা হয় তার মধ্যে একটি হল অক্সফোর্ড। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মেধাবী শিক্ষার্থিদের মাঝে সেখানে একঝাক বাংলা ভাষার শিক্ষার্থির সরব পদচারণা না দেখে কেউ অনুভব করতে পারবে না।

অক্সফোর্ডে বেশ কিছু অধ্যাপক তাদের শিক্ষার্থিদের নিয়ে আধুনিক বাংলা চর্চা ও গবেষণা করেন। এছাড়া অক্সফোর্ড বাংলাদেশ সোসাইটি আমাদের স্বাধীনতা দিবস ও ভাষা দিবস সহ বিভিন্ন সময়ে বাংলায় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বাংলা কোর্স সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা, ভারতের অন্যতম সরকারি ভাষা এবং বাংলা দেশের জাতীয় ভাষা।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিকাশে লিখিত বাংলার গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়, অক্সফোর্ডে বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীরা একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। এতে শুধুমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাই অন্তর্ভুক্ত নয় বরং আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চাও হয়ে থাকে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে বাংলা ভাষার কোর্স রয়েছে। এছাড়া মডার্ন সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে এমএসসি বা এমফিলে শিক্ষার্থিদের জন্য একটি ভাষার বিকল্প হিসাবে বাংলা পড়ানো হয়।

লন্ডন কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি (QUEEN MARY UNIVERSITY OF LONDON)

বিশ্বব্যাপী পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাত লন্ডন কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলা হল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। যেখানে ২২৮ মিলিয়নের প্রধান ভাষা। আর দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে বাংলা ব্যবহার করেন ৩৭ মিলিয়ন মানুষ। তাই এটি একটি বিশ্বভাষা হিসাবে বিবেচিত।

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির বাংলা শিক্ষার্থিদের জন্য বাংলা মডিউলগুলি শিক্ষানবিস এবং প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু হয়। সারা বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে ২ ঘন্টা শ্রেণীকক্ষে বাংলা পাঠদান করা হয়। ইস্ট লন্ডনের মাইল এন্ড ক্যাম্পাসে বাংলা ভাষা বিশেষভাবে শেখানো হয়।

২০২৩-২০২৪ চলমান কোর্সে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ের সময়সূচী হল: ২২ সপ্তাহে (২৫শে সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে – ১২ এপ্রিল ২০২৪) ৪৪ শ্রেণীকক্ষ ঘন্টা এবং ১০৬ ঘন্টা স্বাধীন অধ্যয়ন।

সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন (SOAS University of London)

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ও আফ্রিকান স্টাডিজে (সোয়াস) বাংলা ভাষার চর্চা হয় বহু কাল ধরে। বাংলা ভাষার ব্রিটিশ পন্ডিত টমাস ওয়েলবোর্ন ক্লার্ক এক সময় সোয়াসের অধ্যাপক ছিলেন। তারপর ভারতের খ্যাতিমান ভাষাবিদ তারাপদ মুখোপাধ্যায় সেখানে শিক্ষকতা করেছেন।

তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র উইলিয়াম রাদিচে অক্সফোর্ড থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রি অর্জনের পর সোয়াস থেকে বাংলা শিখেছেন। সেখানে দীর্ঘকাল শিক্ষকতাও করেছেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান অনুবাদক ও গবেষক এই ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ। বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশন থেকে উইলিয়াম রাদিচের বাংলা বই ‘দীর্ঘ দুরূহ পথ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পাঁচটি বক্তৃতা’ প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের বরেণ্য লেখক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল সোয়াস থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে ১৯৬৯ সালে পিএইচডি করেছেন।

সোয়াস বাংলা কোর্সের লক্ষ্য হল ১০ সপ্তাহের প্রতি টার্মে যথার্থভাবে বাংলায় কথা বলা, শোনা, পড়া এবং লেখার উপর একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভিত্তি প্রদান করা। পাঠ্যক্রমের উপাদানগুলিতে আধুনিক সময়ের ভাষা এবং ভাষার বিভিন্ন উত্স গুরুত্বের সাথে শিক্ষার্থিদের শেখানো হয়।

কোর্সটি অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে, ভাষায় চ্যালেঞ্জিং পাঠ্য লিখতে এবং পড়ার জন্য আরও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি এবং শব্দভান্ডার বৃদ্ধির প্রয়াস চালানো হয়।

এই কোর্সের প্রথম তিন সপ্তাহ বর্ণমালার উপর খুব বেশি ফোকাস করা হয়। তাদের মতে, নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের জন্য বাংলা পড়ার ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেখার অগ্রগতি নিশ্চিত করতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হয়। নিয়মিত হোমওয়ার্ক দেয়া হয়।

২০২৪ সালের চলমান কোর্স ১৫ জানুয়ারী থেকে শুরু হয়েছে। ১০ সপ্তাহ মেয়াদের জন্য নির্ধারিত কোর্স শেষ হলে পরবর্তী ক্লাস শুরু হয় এবং ৩ সিমিস্টারে সমাপ্ত হয়।

লন্ডন কিংস কলেজ (KING’S COLLEGE LONDON)

শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সুবিধা সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি লন্ডন কিংস কলেজ। তাদের ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষার গুরুত্ব দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমেই প্রশ্ন করা হয়েছে- আপনি কি জানেন যে বাংলা সিয়েরা লিওনের সরকারী ভাষাগুলির মধ্যে একটি? এরপর বাংলাদেশের সরকারি ভাষা ছাড়াও বাংলা যে ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক কথ্য ভাষা সেকথাও উল্লেখ আছে।

কিংস কলেজের বাংলার শিক্ষকদের উচ্চ মানের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিস্তৃত জ্ঞান ব্যবহার করে শিক্ষার্থিদের শেখার অগ্রগতি এবং ভাষাতে উচ্চ স্তরের দক্ষতা বিকাশে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেন।

ডারহাম ইউনিভার্সিটি (DURHAM UNIVERSITY)

ব্রিটেনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা একটি ইন্দো আর্য ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এটি বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের কাছাড় জেলার সরকারি ভাষা।

১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এশিয়ায় বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যময় সাহিত্যের ঐতিহ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলা যুক্তরাজ্যের চতুর্থ সর্বাধিক সাধারণ অভিবাসীর ভাষা। এই ভাষায় যুক্তরাজ্যে বিদেশী ভাষা জানা পর্যটন, শিক্ষা এবং গবেষণায় বিভিন্ন কর্মজীবনের বিকল্প খুলে দেয়।

জিসিএসই এবং এ-লেভেলে বাংলা একটি ঐচ্ছিক বিদেশী ভাষা। বাঙালি সম্পর্কে জ্ঞান, বাঙালির সঙ্গে যোগাযোগ এবং বাঙালি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বুঝতে ডারহামে প্রমিত বাংলা শেখানো হয়।

এক্সট্রা-কারিকুলাম কোর্স হিসেবে সেখানে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কর্মী এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেক লেখক-সাধক বাংলায় গবেষণা করতে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।

কয়েকটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের কথা এখানে তুলে ধরা হল। যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষার্থিদের পাশাপাশি বিলেতে জন্ম নেয়া আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সমৃদ্ধ হচ্ছে। ব্রিটেনে আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন বা সংস্থার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা হয়।

আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যেও বাঙালি সমাজ উল্লেখযোগ্য। প্রবাসিদের কারণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও বাংলার কদর বেড়েছে। গ্রেট বৃটেনে প্রায় ৫লাখ বাংলাদেশির বসবাস। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাস করেন ৫০ হাজারের অধিক।

ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের চাষ শুরু হলে চা রফতানির কাজে সিলেটের মানুষ বিলেত যাত্রা শুরু করেন। এরপর জাহাজ শ্রমিক হিসেবে ব্যাপক হারে মানুষ বিলেত পাড়ি জমিয়েছেন। উচ্চতর পড়ালেখার জন্যও এসেছেন অনেকে।

ভ্রমণ, কর্মসংস্থান এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়েও হাজার হাজার মানুষ প্রবাসী হয়েছেন। উচ্চ শিক্ষিতরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত হলেও অসীম সাহসী সাধারণ মানুষ বিলেতে গড়ে তুলেছেন একের পর এক রেষ্টুরেন্ট।

গত শতকে বাংলাদেশিদের প্রতিষ্ঠিত প্রায় দশ হাজার রেষ্টুরেন্ট এখন ব্রিটেনের কারি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রেট ব্রিটেনের সর্বত্র বাংলা খাবার ও বাংলা ভাষার মানুষের সাথে শ্বেতাঙ্গ মানুষদের সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে।

বাঙ্গালির এসব অর্জন নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে। আমার (সাঈদ চৌধুরী) সম্পাদিত ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি, ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি, মুসলিম ইন্ডেক্স ও দৈনিক সময় এক্ষেত্রে ফ্লাগশিপ প্রকাশনা হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্যের নাম ঠিকানা ও ফোন নাম্বার সম্বলিত ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরির পর ব্রিটেনের সকল এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি। এতে প্রমাণিত হয়েছে এশিয়ান ১৮ হাজার রেষ্টুরেন্টের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি। ইতিপূর্বে এই তালিকা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ছিল। সঠিক হিসেব না থাকায় কমিউনিটি নেতারা অনুমান নির্ভর তথ্য দিতেন। এই ডাইরেক্টরির মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রমাণ সম্ভব হয়েছে। ব্রিটেনের মূল ধারায় ডকুমেন্ট হিসেবে এখন তা প্রযোজ্য।

এছাড়া ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ৫৭টি দেশের তত্ব ও তথ্য সমৃদ্ধ ডাইরেক্টরি ‘মুসলিম ইন্ডেক্স’ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। এই ইন্ডেক্স প্রকাশের সময় ২০০৯ সালের ২৯ এপ্রিল ওআইসি মহাসচিব প্রফেসর ড. একমেলেদ্দিন ইহসানগ্লর সাথে আমরা মতবিনিময় করেছি। এরপর ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আইডিবি’র কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় স্কলারদের সাথে মতবিনিময় করেছি। লন্ডনে বিভিন্ন দেশের এম্বাসি ও হাইকমিশন তাদের দেশের তথ্য সরবরাহে বিশেষ সহায়তা করেছে।

ব্রিটেনে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সভা সমূহে বাংলায় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভাষা চর্চা চলছে সমান্তরাল ভাবে।

বহুজাতিক সমাজের আবাসস্থল মাল্টিকালচারাল লন্ডন সিটিতে ১৩১টি স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। ভাষার দিক থেকে বাংলার অবস্থান এখন চতুর্থ। এভাবে বিলেতে বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে বসবাসের শতক অনেক আগেই পেরিয়েছে অভিবাসী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠি। ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৪জন এমপি রয়েছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আফসানা বেগম শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন।

হাউজ অব লর্ডসে আছেন পলা মঞ্জিলা উদ্দিন। হাউস অব লর্ডসের ইতিহাসে তিনিই প্রথম মুসললিম নারী এবং প্রথম বাংলাদেশী। ১৯৯৮ সালে এই মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী হাউস অব লর্ডসের সদস্য হিসেবে আল্লাহর নামে শপথ নেয়ায় তাকে নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।

ব্রিটিশ বাংলাদেশী কূটনীতিবিদ আনোয়ার চৌধুরী ব্রিটিশ হাই কমিশনার হিসেবে এবং আরো অনেকে সরকারি চাকরিতে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছেন।

লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে তৃতীয় বারের মতো নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিক লুতফুর রহমান। ব্রিটেনে ১৩ জন নির্বাচিত মেয়রের মধ্যে তিনি একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ এবং প্রথম মুসলিম ও প্রথম বাংলাদেশি মেয়র। অন্য সকলেই শ্বেতাঙ্গ। তার দায়িত্বে রয়েছে কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড বাজেটি এবং প্রায় ১১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।

ব্রিটেনের শীর্ষ পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফে সেরা ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মেয়র লুতফুর রহমান টানা ৩য় বারের মতো এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন কাউন্সিলে মেয়র ও কাউন্সিলর হয়েছেন বহু বাংলাদেশি।

মেয়র লুতফুর রহমান আমাদের মাতৃভাষার বিকাশ তথা কমিউনিটি ভাষা সার্ভিস পুনরায় চালু করতে টাওয়ার হ্যামলেট্স কাউন্সিলে কয়েক লক্ষ পাউন্ড বাজেট বরাদ্দ করেছেন।

ব্রিকলেন বাংলা টাউন বিলেতের মানচিত্রে একটা আইকনের মর্যাদা পেয়েছে। অভিবাসিদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ায় ব্রিটেনে বাংলা ভাষাও গুরুত্ব পাচ্ছে।

ইস্ট লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনের সাইনবোর্ডে বাংলায় স্বাগত জানানো হয়েছে। ট্রান্সফোর্ড ফর লন্ডন অথরিটির (টিএফএল) পক্ষ থেকে এই স্টেশনের নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা হয়েছে।

বাংলা টাউন থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় হয়েছে। মসজিদ, দোকানপাট, হাসপাতাল, পার্ক সবখানে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। নিউহাম, ওয়েস্টহাম, ক্যামডেন, বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার, কার্ডিফ ও নিউক্যাসলের মতো এলাকাগুলোতে অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নাম বাংলায় লেখা আছে।

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আলোচনা ও জাতীয় দিবসগুলো বাংলা চর্চার প্রধান অবলম্বন। বাংলা সংবাদপত্র এবং রেডিও-টেলিভিশন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

বাংলা ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রবাসী স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বিলেতে চলে এসেছেন।

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু স্কুল, ওসমানী স্কুল, কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল, বাংলাদেশ সেন্টার, বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, আলতাব আলী পার্ক, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ইত্যাদি বাঙ্গালি জাতি ও বাংলা ভাষার পরিচয় ধারণ করে আছে।

ড্রাইভিং টেস্টের থিওরি পরীক্ষায় এবং এনএইচএস হাসপাতালগুলো ভয়েস ডিরেকশনে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় নির্দেশনা চালু হয়েছে। স্থানীয় স্কুলগুলোতে স্বকীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ও সিলেটি ভাষা তালিকাভুক্ত হয়েছে। অসংখ্য লাইব্রেরিতে এখন বাংলা বই গুরুত্বের সাথে রাখা হয়।

বিলেতে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার শতবছর পুর্ণ হয়েছে। ১৯১৬ সালের ১ নভেম্বর পাক্ষিক ‘সত্য বাণী’ প্রকাশিত হয়। এরপর মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিকসহ বহু পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। রেডিও-টেলিভিশন এবং বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকাও সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে।

১৯১৩ সালে বাঙ্গালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই পুরস্কারটির জন্য তাকে ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস প্রস্তাব করেন। ইয়েটস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন এবং এই কবিতা সম্পর্কে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন। বিশ্বকবির নোবেল জয় বিদেশিদের বাংলা চর্চায় উৎসাহ যুগিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূর করার জন্য পরীক্ষামূলক পথ সন্ধানের স্বীকৃতি হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষুদ্রঋণের ধারণা প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের জন্য মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের জন্য বাংলার প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর লন্ডনের আলেক্সজান্ডার প্যালেসে আমাদের আয়োজনে ড. ইউনুসকে দেয়া সম্বর্ধনা সভায় বৃটিশ ও ইউরোপীয় এমপিসহ প্রায় ২ হাজার মানুষের উপস্থিতি ও ইউরোপীয় মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার এরই প্রমাণ বহন করে।

বিলেতে অধ্যয়ন শেষে অনেক বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। দেশ থেকেও অনেকে গিয়েছেন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার দেশে দেশে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছেন বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য। ফলে সেসব স্থানেও বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে নানাভাবে।

সাহিত্যিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও টেকনোলজিক্যাল গ্লোবালাইজেশন মানবজাতির ভাষাকেও বিশ্বায়িত করে তুলছে দ্রুতগতিতে। সম্প্রতি সিয়েরা লিয়ন বাংলা ভাষাকে তাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এভাবেই বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবীব্যাপী।

দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাসের ফলে অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মূলধারায় যুক্ত হয়েছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনীতি বা অর্থনীতিতে আপন কর্মদক্ষতা গুণে অনেকে লাভ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদ-পদবি। এতে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশি জাতির মর্যাদা বেড়েছে।

প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন, মানবাধিকারের পক্ষে জনমত গঠন, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি আয়োজন করে প্রবাসিরা বাংলা ভাষাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

আমরা জানি, বিলেতে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতা শত বছর পাড়ি দিয়েছে। বাংলা ভাষার প্রসারে বাংলা মিডিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।

বাংলা সংবাদপত্র সম্পর্কে এ যাবত প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ১৯১৬ সালের ১ নভেম্বর পাক্ষিক সত্যবাণী প্রকাশিত হয়। লন্ডন স্ট্রান্ডের মিলফোর্ড লেন থেকে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজিতে প্রকাশিত সত্যবাণী পত্রিকার লগো তিন ভাষায় ব্যবহার করা হতো।

১৯৪০ সালের ১৮ অক্টোবর শাহজাহান মসজিদ (সারে, ওকিং, ইংল্যান্ড) থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক জগৎ-বার্ত্তা। মুসলিম সোসাইটি ইন গ্রেট বৃটেনের উদ্যোগে এটি মসজিদ কেন্দ্রিক প্রকাশনা ছিল। ১৯৫০ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তানী খবর নামে পাকিস্তান হাই কমিশনের উদ্যেগে আরেকটি কাগজ প্রকাশিত হয়।

১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক তাসাদ্দুক আহমদের সম্পাদনায় হাতে লিখে প্রকাশিত হয় মাসিক দেশের ডাক। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যারিষ্টার আলী মোহাম্মদ আব্বাস কর্তৃক আমার দেশ নামে হাতে লিখা আরেকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তিন ভাষায় প্রকাশিত কাগজে বাংলায় ‘আমার দেশ’ সম্পাদনা করতেন আবুল হায়াত, ইংরেজিতে ‘আওয়ার হোম’ সম্পাদনা করতেন ব্যারিষ্টার আলী মোহাম্মদ আব্বাস এবং উর্দুতে ‘হামারা ওয়াতন’ সম্পাদনা করতেন আব্দুল ওয়াহিদ।

গত একশ বছরে লন্ডন থেকে মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক সহ বহু পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে সবচেয়ে আলোচিত কাগজসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমত, ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমা, ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত নতুন দিন, ২০০১ সালে প্রকাশিত ইউরো-বাংলা, ২০০৩ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট ও ২০০৪ সালে প্রকাশিত সময়। এর বাইরে খুব কম সংখ্যক সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে। বেশিরভাগই কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। তবে কয়েকটি রেডিও-টেলিভিশন এবং অনেকগুলো অনলাইন মিডিয়া সরব রয়েছে।

লন্ডনে গৌরবের সাথে এগিয়ে যাওয়া সংবাদপত্রের মধ্যে দীর্ঘজীবী হচ্ছে সাপ্তাহিক জনমত ও সাপ্তাহিক সুরমা। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় জনমত। প্রায় অর্ধশত বছর থেকে নিয়মিত বেরুচ্ছে। এটি বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। পত্রিকাটি ফজলে রাব্বি মাহমুদ, ওয়ালি আশরাফ, আনিস আহমদের হাত ধরে সৈয়দ সামছুল হক, নবাব উদ্দীন হয়ে এখন সৈয়দ নাহাস পাশার নেতৃত্বে ও সম্পাদনায় চলছে।

জনমত সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা কারি লাইফ ম্যাগাজিনেরও প্রধান সম্পাদক। তিনি লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের (সিজেএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট। মূলধারার গণমাধ্যমের সাথে সংযোগ থাকায় তার সাংবাদিকতায় এক ধরনের মুনশিয়ানা আছে। কমিউনিটির বিকাশ ও কারি ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নমূলক কর্মযজ্ঞে তিনি বেশ সক্রিয়।

লন্ডনে বাংলাদেশি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশনা শিল্প যাদের হাতে পেশাদারিত্ব অর্জন করেছে, তাদের মধ্যে সাপ্তাহিক সুরমার প্রতিষ্ঠাতা ডা. বশির আহমদের মেধাবী সন্তান তোফায়েল আহমদ, সারওয়ার আহমদ ও সারজমিন আহমদ কর্তৃক এথনিক মিডিয়া গ্রুপের প্রকাশনা এশিয়ান উইমেন ম্যাগাজিন, এশিয়ান ব্রাইট ম্যাগাজিন, এশিয়ানা ওয়েডিং ইত্যাদি, আমার (সাঈদ চৌধুরী) সম্পাদিত সংবাদ সংস্থা মিডিয়া মহলের প্রকাশনা মাসিক সময় (বর্তমানে দৈনিক), ইউকে-বাংলা ডাইরেক্টরি, ইউকে-এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি ও ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডাইরেক্টরি মুসলিম ইনডেক্স, বৃটিশ কারি এওয়ার্ডের প্রতিষ্ঠাতা এনাম আলী এমবিই‘র স্পাইস বিজনেস এবং সৈয়দ নাহাস পাশার কারি লাইফ ম্যাগাজিন ও কারি শেফ ম্যাগাজিন বাংলাদেশি মালিকানায় শীর্ষ প্রকাশনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

এদিকে বিলেতের বাংলা মিডিয়ায় একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রত্যয় নিয়ে জন্ম হয় নতুন দিন। ১৯৮৭ সালে একটি ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখা গেল, FREEDOM OF EXPRESSION তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। কিম্বা সত্যকে সাহসিকতার সাথে তুলে ধরার হিম্মতের অভাব। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার একটি প্রভাবশালী মহলের নিপীড়নমূলক আচরণে স্থানীয় সংবাদপত্র সাহসী ভূমিকা পালনে হিমশিম খাচ্ছে। তখন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মহিব চৌধুরীসহ প্রতিবাদের সাথে সংশ্লিষ্টরা এই প্রত্রিকা প্রকাশ করেন।

২০০১ সালে প্রকাশিত হয় বাই-লিঙ্গুয়াল (বাংলা ও ইংরেজি) সাপ্তাহিক ইউরোবাংলা। বাই-লিঙ্গুয়াল হওয়ায় নতুন প্রজন্মের কাছে এটি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। ফলে কাগজটি দ্রুত পাঠক প্রিয় হয়ে ওঠে। সাপ্তাহিক ইউরোবাংলা প্রকাশে আমার সাথে মিয়া মনিরুল আলম, কেএম আবু তাহের চৌধুরী, সলিসিটর এমএ মালিকসহ আমাদের সকল পরিচালকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্রিটেনের বর্তমান রাজা (তৎকালীন প্রিন্স) চার্লসকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোবাংলা প্রদান করি, যা ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমাদৃত হয়।

লন্ডনে বাংলাদেশী কমিউনিটির পাশাপাশি সংবাদিকদের একাধিক সংগঠন রয়েছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে এই সংগঠন সমুহের বিশেষ অবদান রয়েছে। সংবাদিকদের প্রধান সংগঠন ‘লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব‘। এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ‘নতুন দিন‘ সম্পাদক মহিব চৌধুরী একজন দৃঢ়চেতা সংগঠক ও সাহসী সম্পাদক। মিডিয়া জগতের বাইরে শিক্ষা ট্রাস্ট সহ বহুমুখী সেবাকর্মে সম্পৃক্ত। বিলেতের বিকাশমান কমিউনিটির ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলায় তিনি সামনের কাতারের সৈনিক। বৃটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির (বিবিসিসিআই) সাবেক ডাইরেক্টর জেনারেল মহিব চৌধুরী একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক ও সফল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি আমি বিলেত এসেছি। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে ২০০৩-৫ সালের নির্বাহী কমিটিতে যুক্ত হই। তখন মহিব চৌধুরী সভাপতি ও সৈয়দ নাহাস পাশা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই সময় আমরা প্রেস ক্লাবের সামগ্রিক উন্নয়নে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করি। ক্লাবের স্থায়ী সদস্য ও লাইফ মেম্বার বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি হয়। আজকে প্রেসক্লাবের যে বিশাল ফান্ড ও ভবন হয়েছে তার মুখ্য ভূমিকা আমাদের মুহিব-নাহাস কমিটির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

২০০৮ সালে আমি বিলেতে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন শীর্ষক একটি গবেষণা গ্রন্থের কাজে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে অনেক ঘাটাঘাটি করেছি। ব্রিটিশ লাইব্রেরির নিয়মিত সদস্য হিসেবে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাংবাদিকতা নিয়ে অনুসন্ধান কর্ম কতটা দুরূহ ব্যাপার তা হাতে কলমে টের পেয়েছি। আমি তখন এশিয়ান ১৮ হাজার রেষ্টুরেন্টের ঠিকানা সহ তালিকা প্রকাশ করি। এর মধ্যে সাড়ে নয় হাজার অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশী মালিকানা প্রমাণ করেছি। ব্রিটিশ লাইব্রেরী এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ ব্রিটেনের মূল ধারায় ডকুমেন্ট হিসেবে এখন তা প্রযোজ্য।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে ইস্ট লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল ও ব্রিকলেন নিয়ে ৬ মাসব্যাপী একটি গ্রুপ ওয়ার্ক করেছি। সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। শত বছরের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন বয়সের নানা বর্ণের লোকজনের সাথে প্রতিদিন কথা বলেছি। নোট নিয়েছি বা রেকর্ড করেছি। ২০ বছর ধরে এখানে সাংবাদিকতা করছি। তারপরও অনেক বিষয় অধরাই ছিল। ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন সম্পর্কে নতুন করে বহু কিছু জানা হলো। শতাব্দীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিলেতের কারী ক্যাপিটেল খ্যাত ব্রিকলেন ও ফাইনান্সিয়াল সিটি ক্যানারিওয়াফ এবং হোয়াইটচ্যাপেল কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম, আইরিশ, জুইসসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও প্রত্যাগমন এবং বাঙ্গালির ব্রিকলেন বিজয় ও বাংলা টাউন ঘোষণা মূল আলোচনায় স্থান পেয়েছে। বিলেতে বাংলা চর্চা ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন সম্পর্কেও আলোকপাত হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসন তথা হোয়াইটচ্যাপেল ও ব্রিকলেন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে উনাকিং পরাজিত ও জর্জ গ্যালাওয়ের বিজয়ী হওয়া এবং পরবর্তীতে রুশনারা আলী এমপি নির্বাচিত আর টাওয়ার হ্যামলেট্স কাউন্সিলে নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের মহা তরঙ্গ। আলতাব আলি হত্যাকাণ্ড, ক্রসরেল ও খুদিলার আন্দোলন অনেকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে আলোচনায় এসেছে।

শেষ দিনে পনের জন স্থানীয় স্টেকহোল্ডার, দুইজন বৃটিশ, একজন ইউরোপীয় এ একজন জাপানি সমাজ বিকাশ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির মন্তব্য রেকর্ড করলাম। পূর্ব লন্ডনের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংহতি নিয়ে মূলধারার এ কাজ অনেক দায়িত্বশীলতা, নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে করতে হয়। ইমিগ্রেশন থেকে বর্ণ-বৈষম্য, খোলা বাজার থেক আধুনিক অট্রালিকা, এলএমসি, রয়্যাল লন্ডন হসপিটাল, ক্রসরেল -এই সবই গবেষণা কর্মের অংশ। তবে প্রতিদিন আসল কাজের বাইরে আরো কিছু সময় দিতে হয়েছে। কমিউনিটির অনেকের সাথে দেখা ও তাদের যাপিত জীবন নিয়ে নানা কথা। মাঝে মাঝে বেশ মজার এবং স্মৃতিময় ঘটনাও ঘটেছে।

বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ২৯ কোটি লোকের ভাষা বাংলা। জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর ৭ হাজারের অধিক ভাষার মধ্যে এর অবস্থান সপ্তম, মাতৃভাষার দিক থেকে পঞ্চম। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। আরো ১২ কোটি বাস করেন ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে। বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে এ-ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা। ফলে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে এর চর্চা ও পঠন-পাঠন।

বিলেতের মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা শেখার দরকার পড়ছে সেদেশের নাগরিকদের। ক্রমবর্ধমান বাংলাভাষী মানুষের কারণেই এমনটি সম্ভব হচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চল এমনকি কানাডার কিছু এলাকার প্রধান ভাষা বাংলা।

বিবিসি বাংলা, ভয়েস অফ আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে, রেডিও জাপান, চীন আন্তর্জাতিক বেতার, মস্কো রেডিও, রেডিও ভেরিটাস, লন্ডনের বেতার বাংলা ও কানাডার বাংলা রেডিও চ্যানেল সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে বাংলা বই বিতরণসহ নানা রকমের কর্মকান্ড পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

এজন্য অবশ্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক। বাংলা ভাষা চর্চায় সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস যথাযথভাবে সংগ্রহ করা উচিত। প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের এম্বাসি ও হাইকমিশনে বিশেষ সেল। এ যাবৎকালে যে কিছু কাজ হয়েছে, তা ইতিহাসের প্রাথমিক স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।

লন্ডনে আমরা যখন কোন মৌলিক বিষয়ে কাজ করি বা গবেষণা করি, তখন রিসার্চ কাজে অসংখ্য রেফারেন্স বুক ও জার্নাল পাওয়া যায়। তথ্যসূত্র (সাইটেশন) উল্লেখ পূর্বক আমরা তা কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু আমাদের ভাষা, সাহিত্য কিংবা সাংবাদিকতা নিয়ে তেমন কোন মৌলিক কাজ না থাকায় রেফারেন্স যোগাড় সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

এটা অবশ্য সত্য যে, মৌলিক কাজের জন্য প্রয়োজন সময়, মনোযোগ এবং পরিশ্রম। সেই সাথে কৌতূহল বা জানার আগ্রহ। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ ও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে তা নিয়ে বেশি দূর এগুনো যায়না। তবে সমাজের সুশীল অংশ যদি এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেন তাহলে মঞ্জিলে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতার স্বর্ণতোরণে পৌঁছে দিয়েছে।

বাংলাভাষী মানুষ বিশ্বায়নের এ যুগে যেখানেই সমাজবদ্ধ হয়েছেন, সেখানেই মুখরিত হয়েছেন নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চায়। এভাবেই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বিশ্বময় বাংলাভাষা।

* সাঈদ চৌধুরী সময় সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *