বৃটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের ঐতিহাসিক অভিষেক

যুক্তরাজ্য সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

৬ মে ২০২৩ শনিবার ছিল বৃটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক। লন্ডন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে জড়ো হয়েছিলেন গ্রেট বৃটেনের হাজার হাজার মানুষ। অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন প্রায় ১০০টি দেশের সরকার প্রধান সহ ২০৩টি দেশের প্রতিনিধি।

উৎসবমুখর পরিবেশে যুক্তরাজ্যের সিংহাসনে আনুষ্ঠানিকভাবে আরোহণ করলেন কিং চার্লস। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরসূরী হিসেবে তিনি হচ্ছেন বৃটেনের ৪০তম রাজা। ৭০০ বছর আগে তৈরি সিংহাসনে বসানো হয় তাকে। তারপর ১৬৬১ সালে তৈরি সেন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়।

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক হয়েছিল ১৯৫৩ সালে । ৭০ বছর পর আরেকটি নান্দনিক অভিষেক উপভোগ করেছেন বৃটেনসহ বিশ্ববাসী।

রেডব্রিজ বারার সেভেন কিং থেকে স্টার্ডফুড হয়ে গ্রীনপার্ক স্টেশনে পৌছে দেখি এলাহি কান্ড। মানুষ আর মানুষ। ভোরের আলো ফোটার আগেই অসংখ্য মানুষ সেখানে হাজির হয়েছেন। সবার চোখেমুখে আনন্দ উচ্ছ্বাস। হাতে হাতে চার্লসের ছবি সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন আর বৃটেনের পতাকা।

জনতার স্রোত ছিল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে। বৃষ্টিস্নাত প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে মানুষের ঢল নেমেছিল। অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজা তৃতীয় চার্লসকে একনজর দেখার আকাঙ্খায় উন্মুখ জনতা সময়ের বহু আগেই সেখানে সমবেত হন। যে দিনটির জন্য গত ছয়মাস ধরে অপেক্ষায় ছিল গোটা জাতি।

কিং চার্লস এবং কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে শোভাযাত্রা করে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে এসে পৌঁছার দৃশ্য ছিল মুনমুগ্ধকর। ঐতিহ্যবাহী গাড়িতে চড়ে বেরিয়েছেন তারা। কয়েক মাইলের দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষমান উচ্ছ্বসিত জনতা হাত নেড়ে করতালি দিয়ে নতুন রাজা ও রানীকে শুভেচ্ছা জানান।

এতো মানুষের আবেগ ও ভালোবাসায় সিক্ত কিং চার্লসকে তখন বেশ উৎফুল্ল মনে হয়েছে। জনতার অভিবাদনের সময় তিনি হাত নেড়ে সবার উদ্দেশে শুভেচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রকাশ করেন।

মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল এগারোটায়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে এসে আসন গ্রহণ করেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, কমনওয়েলথ নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা আর সেবাকর্মে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অতিথিবৃন্দ।

বর্ণিল সাজে সাজানো হয় চারদিক, সড়ক ও পার্ক সমূহ। উৎসব আমেজে মুখরিত ছিল বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে ট্রাফালগার স্কোয়ার। লন্ডনের গ্রেড আই তালিকাভুক্ত বৃহত্তম রয়্যাল পার্ক। উত্তরে বেইসওয়াটার রোড। পূর্বদিকে পার্ক লেন। দক্ষিণে নাইট্সব্রিজ। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হাইড পার্ক কর্নার।

চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানকে স্বাগত জানানোর জন্য বিশ্বনেতাদের আগমনের কারণে লন্ডনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই জোরদার। সর্বত্র মোতায়েন করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক হাজার বাড়তি সদস্য। লোকদের প্রয়োজনে সহায়তার জন্য বিপুল পরিমান ভলেন্টিয়ার নিয়োজিত ছিলেন।

ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে ঐতিহাসিক ভাবে অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্যের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান। সাড়ে নয়শ বছর ধরে এখানেই রাজাদের অভিষেক হয়। সে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছিল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি। আগের রাত থেকে আলোয় আলোয় ঝলমল ছিল লন্ডন নগরি। রাজকীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সারা বৃটেন জোড়ে ছিল সাজো সাজো রব।

২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বৃটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ইহত্যাগ করেছেন। সেদিন থেকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছেন তারই বড় ছেলে। ৭৪ বছর বয়সী প্রিন্স চার্লস এখন কিং চার্লস। বৃটেন ছাড়াও কমনওয়েলথের আরও ১৪টি দেশের প্রধান হলেন তিনি। দেশগুলো হচ্ছে অ্যান্টিগা ও বারবুডা, অস্ট্রেলিয়া, দ্য বাহামাস, বেলিজ, কানাডা, গ্রেনাডা, জামাইকা, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি দ্বীপপুঞ্জ, সেন্ট কিটস ও নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনস, সোলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও তুভালু।
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয়েছে চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় এই অভিষেক।

৭০ বছর অপেক্ষা
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন ব্রিটেনের ইতিহাসে দীর্ঘতম রাজশাসক। ছোট্ট বয়সে মায়ের মাথায় রাজমুকুট উঠতে দেখেছিলেন প্রিন্স চার্লস। তার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি পরবর্তী কিং হওয়ার কথা। দীর্ঘজীবি মায়ের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৭০ বছর। এখন তিনি ক্ষমতায় আসীন হলেন। সেই মুকুট পরিয়ে দেয়া হল তার মাথায়।

ধর্ম বিশ্বাস
কিং চার্লস ধর্মবিশ্বাসে একজন প্রটেস্ট্যান্ট। তার ক্ষমতার সময়ে আইন এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডকে সমুন্নত রাখবেন বলে শপথ নিয়েছেন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে ধর্মগ্রন্থ গসপেলের ওপর হাত রেখে এই প্রত্যয় ঘোষনা করেন। এরপর তিনি এক্সেসন ডিক্লেয়ারেশন শপথ নেন। তখন চার্লস বলেন, ধর্মবিশ্বাসে তিনি একজন প্রটেস্ট্যান্ট।

গড সেভ দ্য কিং
কিং চার্লসের মাথায় সেইন্ট এডওয়ার্ডের ক্রাউন পরিয়ে দেন আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি জাস্টিন ওয়েলবি। রাজমুকুট পরানোর সাথে সাথে অনুষ্ঠান হলে এবং বাইরে ধ্বনিত হয় “গড সেভ দ্য কিং”। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির ঘণ্টা বাজিয়ে এই মূহুর্তটি উদযাপন করা হয়। তখন সারা দেশ জুড়ে তোপধ্বনি হয়। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে ১৩টি স্থান থেকে রাজাকে দেওয়া হয় গান স্যালুট। টাওয়ার অব লন্ডনে এবং রাজধানীজুড়ে, কার্ডিফ ক্যাসেলে, জিব্রাল্টায়, বারমুডায়, সমুদ্রে থাকা জাহাজগুলোতেও তোপধ্বনি দেয়া হয়।

বাকিংহাম প্রাসাদে জনতাকে অভিবাদন
অভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা শেষে কিং চার্লস এবং কুইন কনসর্ট ক্যামিলা একটি সোনালি স্টেট কোচে বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরে যান। রাজমুকুট পরিহিত চার্লস প্রাসাদের বারান্দায় এসে সামনে জড়ো হওয়া উৎসুক জনতাকে অভিবাদন জানান। এসময় রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও তার সাথে ছিলেন।

প্রিন্স উইলিয়ামের শ্রদ্ধা নিবেদন
পিতার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজা তৃতীয় চার্লসের বড় ছেলে প্রিন্স ইলিয়াম, ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি, উইলিয়ামের স্ত্রী কেট মিডলটন ও তাদের সন্তানরা। কিং চার্লসের শপথের পর নিয়ম অনুযায়ী রাজা ও পিতা তৃতীয় চার্লসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম। হাঁটু গেড়ে তিনি রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সর্বদা তার কাছে অনুগত থাকার শপথ নেন। এরপর রাজার মাথার মুকুট স্পর্শ করেন এবং রাজার চিবুকে চুম্বন দেন প্রিন্স উইলিয়াম।

সরাসরি সম্প্রচার
হাইড পার্কে বিশাল বিশাল স্ক্রিনে সরাসরি রাজ্যাভিষেক দেখানো হয়। নগরির অন্যান্য স্থানেও জায়ান্ট স্ক্রিনে অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা ছিল। সবখানেই বিপুলসংখ্যক মানুষ অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি বিশ্বজুড়ে সরাসরি সম্প্রচারে দেখেছেন আরো কোটি কোটি মানুষ।

মার্চপাস্ট ও কুচকাওয়াজ
বাকিংহাম প্যালেস থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে’র দূরত্ব ১.৩ মাইল। এই পুরো পথে মার্চপাস্ট ও কুচকাওয়াজ করেছে বৃটিশ সেনাদের বিভিন্ন চৌকশ দল। সে সময় রাস্তার উভয় ধারে অবস্থান নেন কয়েক লাখ মানুষ।

পবিত্র তেল
অভিষেক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় উপাদান সমূহ শক্তিশালী ছিল। রাজ্যাভিষেকে রাজাকে অভিষিক্ত করতে বিশেষ তেল ব্যবহার করা হয়েছে। যেটাকে পবিত্র জ্ঞান করা হয়। প্রতীকীভাবে রাজার মাথায়, বুকে এবং হাতে পবিত্র তেল দিয়ে স্পর্শ করা হয়।এই তেলের মধ্যে অলিভ অয়েলের সুগন্ধযুক্ত তেল, তিল, গোলাপ, জুঁই, দারুচিনি, নেরোলি এবং বেনজোইনের সাথে কমলা ফুলের মিশ্রণ রয়েছে বলে জানা গেছে।

আমিন আমিন ধ্বনি
রাজার অভিষেকে প্রার্থনা প্রবল ছিল। ‘আমিন’ প্রতিধ্বনি হয়েছে বারবার। বৃটেনে খিষ্ট্রিয় ধর্মের প্রধান আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি জাস্টিন ওয়েলবি ১২টা ২ মিনিটে রাজার মাথায় স্বর্ণমুকুট পরিয়ে দেন। এ সময় তিনি বলেন, গড সেভ দ্য কিং, ঈশ্বর রাজাকে রক্ষা করুন। তখন উপস্থিত সকলে বলেন, আমিন। শপথ অনুষ্ঠানে বাইবেল থেকে পাঠ করেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কথা
রাজপরিবার, বিশেষ করে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে রাজার মা প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের চলে যাওয়ার ছাপ বিদ্যমান ছিল। এই তো গত সেপ্টেম্বরে লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা নিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন রানী এলিজাবেথ।

শীর্ষ রাজনৈতিকদের সমারোহ
রাজ্যাভিষেকে উপস্থিত হয়েছিলেন বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সহ শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, বিরোধী লেবার দলের নেতা কিয়ের স্টর্মার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, লিজ ট্রাস, ডেভিড ক্যামেরন। শীর্ষ রাজনৈতিকদের সমারোহ ছিল খুবই উপভোগ্য এবং বিশ্ব নেতাদের সামনে গণতন্ত্রের জন্য মাইল ফলক।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসেননি
বৃটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেকে যোগ দেননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ সম্পর্ক। তারপরেও জো বাইডেন আসেননি। তবে তার স্ত্রী ফার্স্টলেডি জিল বাইডেন ও একটি কূটনৈতিক দল অংশ নিয়েছেন। ভবিষ্যতে কোনো এক সময় বৃটেনে এসে রাজার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন জো বাইডেন। অবশ্য কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কখনোই বৃটেনের রাজপরিবারের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেননি।

সিংহাসনে আরোহন
মুকুট পরিয়ে দেওয়ার পর সিংহাসনে বসেন কিং চার্লস। ক্যান্টারবারি ও ইয়র্কের আর্চবিশপ এবং সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা রাজাকে সিংহাসনের দিকে নিয়ে যান। এটাই ছিল রাজ্যাভিষেকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব। ১৯৫৩ সালে সেইন্ট এডওয়ার্ড মুকুটটি পরেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এটি ১৬৬১ সালে তৈরি করা হয়েছিল রাজা দ্বিতীয় চার্লসের জন্য। অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজা ও সেইন্ট এডওয়ার্ড দ্য কনফেসরের নামানুসারে মুকুটটির নাম করণ করা হয়েছে।

ক্যামিলার অভিষেক
একই দিনে কুইন কনসোর্ট হিসেবে রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা অভিষিক্ত হয়েছেন। তাকেও মুকুট পরিয়ে দেন আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি জাস্টিন ওয়েলবি।

হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সব কিছু সাজানো হয়েছিল। জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে অভিষেক সম্পন্ন হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *