বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যা, কী ঘটেছিলো পাঁচ বছর আগে

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে পাঁচ বছর আগে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। সেই সাথে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এটি তখন শিরোনাম হয়েছিলো বিবিসিসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

এর জের ধরেই তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। এবার আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠেছিলো সেখানেও আন্দোলনকারীদের মিছিল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও শ্লোগানে আবরার ফাহাদের নাম উঠে এসেছে বারবার।

আওয়ামী লীগের পনের বছরের শাসনের সময় যে কয়েকটি ঘটনায় দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলো আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডকে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অনেকে। একই সঙ্গে আবরার হয়ে ওঠেন ‘ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী’ আন্দোলনের একটি প্রতীকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, আবরার হত্যাকাণ্ড জাতির ইতিহাসের একটি ‘বাক পরিবর্তনকারী’ ঘটনা। কারণ এর জের ধরেই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয়েছে এবং এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠছে।

“আবরার হত্যাকাণ্ড একটি মাইলফলক ঘটনা, যে ঘটনার কারণে ক্ষমতাসীনদের প্রতি তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির প্রতি চরম বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো। তখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠেছিলো তাতে পুরো জাতির সমর্থন প্রকাশ পাচ্ছিলো। এ থেকেই ঘটনাটির গুরুত্বের গভীরতা আঁচ করা যায়। ভারত বিরোধিতার বিষয়টি আছে কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হলো এটি সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন রোবায়েত ফেরদৌস।

প্রসঙ্গত, ওই হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তীব্র বিক্ষোভের জেরে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আটক করে মামলা দেয়া হয়েছিলো। পরে ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিলো ঢাকার একটি আদালত। তবে রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আপিল দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে। সবশেষ চলতি বছর তেসরা সেপ্টেম্বর আবরার ফাহাদের পরিবারকে দশ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট।

হত্যাকাণ্ডটি যেভাবে হয়েছিলো

২০১৯ সালের ৬ই অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ।
তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ওই ঘটনার পর বিবিসির কাছে ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিলো যে সেদিনই কুষ্টিয়ার বাড়ি থেকে বুয়েটে এসে শেরে বাংলা হলে নিজের ১০১১ কক্ষে এসেছিলেন আবরার।

ফেসবুকে ভারত বিরোধী একটি পোস্টের জের ধরে রাত আটটার দিকে তাকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। পরে রাত তিনটার দিকে জানা যায় যে আবরারকে হত্যা করে একতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি ফেলে রাখা হয়েছে। পরে জানা যায় আবরারকে ‘শিবির আখ্যা’ দিয়ে দুই দফায় দুটি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয় এবং পরে বুয়েট মেডিকেলের ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর মধ্যে খবর পেয়ে রাত দুইটার দিকে টহল পুলিশের একটি দল হল গেইটে গেলে তাদের হলে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে চারটার দিকে পুলিশ আবার হলে যায়। এরপর ডাক্তার মৃত ঘোষণার পর তারা মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় যে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

পরে ঘটনাটির তদন্ত শেষে তখনকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সে সময় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন যে, আবরার ফাহাদকে শিবির হিসেবে সন্দেহ করার বিষয়টি হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।

“অভিযুক্তদের সমীহ করে সালাম না দেয়ার বিষয়টিও আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ। তারা র‍্যাগিং-এর নামে আতংক তৈরি করেছে। হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তরা আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে অন্যদের মাঝেও আতঙ্ক তৈরি করতে চেয়েছিল, যাতে করে অন্য শিক্ষার্থীরাও তাদেরকে সমীহ করে এবং সালাম দেয়। অভিযুক্তরা বুয়েটে ‘ভয়ের রাজত্ব’ কায়েম করার ধারাবাহিকতায় আবরার ফাহাদের উপর হামলা করে,” মি. ইসলাম সেই সময় বলেছিলেন।

পরে মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছিলো যে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের সাথে ১১ জন সরাসরি সম্পৃক্ত এবং বাকিরা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মামলার এজাহারে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ প্রথমে উনিশ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তবে তদন্তের পরে আসামীর সংখ্যা দাঁড়ায় পঁচিশ জনে।

অন্যদিকে ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি আল নাহিয়ান জয় তখন বিবিসিকে বলেছিলেন, “অনেক সময় অতি উৎসাহী কিছু নেতা-কর্মী ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এ ধরনের কার্যক্রমে লিপ্ত হন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এ ধরনের কার্যক্রম কোনোভাবে সমর্থন করা হবে না।”

প্রসঙ্গ: ভারতীয় আগ্রাসন

হত্যাকাণ্ডের দুইদিন আগে পাঁচই অক্টোবর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আবরার ফাহাদ, যার বিষয়বস্তু ছিলো বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক।
তিনি লিখেছিলেন,

১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২.কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩.কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। ……”

তার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অনেকেই দাবি করেন যে মূলত এই পোস্টের কারণেই আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। পরে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনও ‘ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী’ হিসেবে আবরার ফাহাদকে উল্লেখ করেন।

বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবরার হত্যাকাণ্ড

আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে। কয়েকটি গণমাধ্যমে ঘটনার পর যে তুমুল ছাত্রবিক্ষোভ হচ্ছিলো তার খবরও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি এ বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করেছিল। বিবিসি নিউজে ২০১৯ সালের ৯ই অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিলো যে চার ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে।

তখন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছিলো ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পানি চুক্তির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়’।

ওই রিপোর্টে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়। আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর প্রকাশ করেছিলো গালফ নিউজ। আর গার্ডিয়ানে আবরারের বাবার বক্তব্য ও ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হয়।

ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাগুলোতেও আবরার হত্যা ও এর পরের ছাত্র বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হয়েছিলো। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ঘটনার পর এই হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা হবে বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছিলেন সেই খবরও প্রকাশ করা হয়। – বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *