বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীনে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে সীমাহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে এ বিষয়ে গঠিত জাতীয় কমিটি। রোববার (২ নভেম্বর) সচিবালয়ে বিশেষ বিধান আইনের অধীনে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় কমিটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।
প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর জাতীয় কমিটির প্রধান হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা পর্যালোচনায় বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে সীমাহীন দুর্নীতি, যোগসাজশ, জালিয়াতি, অনিয়ম পেলাম। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারদের সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা এগুলো পেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন। আগামী বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় আমরা আমাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেব।’
কমিটির প্রধান বলেন, ‘আপনারা জানেন, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা করা খুবই জটিল ও কষ্টকর কাজ। এজন্য প্রতিবেদন দিতে বেশি সময় লেগেছে। কারণ বিষয়টি তো টেকনিক্যাল—এটি বুঝতে হবে।’
মঈনুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ‘বিস্তারিত প্রতিবেদনে রয়েছে। আমরা লিখে দিয়েছি, এটি গোপনীয়। উপদেষ্টা মহোদয় যদি এটি প্রকাশ করে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেন, তাহলে আপনারা বিস্তারিত বুঝতে পারবেন, জানতে পারবেন।’
কমিটির সদস্য ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক (অর্থনীতি) মোশতাক হোসেন খান বলেছেন, ‘যে চুক্তিগুলো হয়েছে সেগুলো সার্বভৌম চুক্তি। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কোম্পানির চুক্তি সই হয়েছে। সার্বভৌম চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। যদি মনে হয় এখানে কোনো কারচুপি হয়েছে, আপনি ইচ্ছামত এটাকে বাতিল করতে পারবেন না। এটা বাতিল করলে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে আপনার ওপরে অনেক বড় জরিমানা আসবে। এজন্য আমাদের অনেক সময় লেগেছে যাতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা যায় প্রক্রিয়াগুলো কী ছিল, সেখানে কোথায় ব্যতিক্রম হয়েছে। আমরা যে বিষয়গুলো পেয়েছি, এর সব কিছু অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে নেই। কারণ কিছু কিছু জিনিস চলমান, সেজন্য আমরা সেগুলোকে প্রকাশ করিনি।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা আগামী মাস খানেকের মধ্যে আরও অনেক দুর্নীতির তথ্য পাবেন। এখানে ব্যাপক দুর্নীতি; এই দুর্নীতিকে আমাদের রোধ করতেই হবে। এটাকে মেনে নেওয়া বা সহ্য করা সম্ভব নয়।’
‘ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিদ্যুতের দাম আমাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে এই দুর্নীতির কারণে। সাবসিডিগুলো সরিয়ে দিলে এটা ৪০ শতাংশ হয়ে যাবে। আমাদের হিসেবে বিদ্যুতের এই দামে বাংলাদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো টিকতে পারবে না। তাই আমাদের এটাকে শুধরাতেই হবে। এটা যাতে না হয়, আমাদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
মোশতাক হোসেন খান আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেদনে আছে—কোথায় কোথায় ভুলগুলো করা হয়েছে যেখানে ইন্টারভেনশন (হস্তক্ষেপ) করা হয়েছে, ওপর থেকে হুকুম এসেছে। প্রশাসন যে সবসময় নির্দোষ ছিল তাও না; সেটারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মাশুলটা দিচ্ছে সাধারণ ভোক্তা, ক্রেতা ও করদাতারা। আমাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই যে বিশাল অংকের ঋণ ও বেশি দামের বিদ্যুৎ, এটা আমরা দেব। যারা এখান থেকে টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বুঝাতে হবে, আপনারা এটা থেকে পার পাবেন না। আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করছি; অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নেওয়া হবে ভবিষ্যতে যাতে এটা আর না হয়। এটা অনেক কঠিন কাজ। সবাইকে একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে, কারণ এটা তাড়াতাড়ি করার কাজ নয়। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হবে, আমরা সফল হব না। এজন্য আমাদের একটু দেরি হচ্ছে।’
বিদ্যুৎ চুক্তির অনিয়ম নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি রিট পিটিশন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম রিট পিটিশন করেছিলেন শাহদীন মালিক। দ্বিতীয় রিট পিটিশনের বিষয়ে পত্রিকায় সেভাবে আসেনি; সেটা আসা উচিতও নয়।
‘পত্রিকায় খবর এসেছে যে আদানির চুক্তির সঙ্গে অনেক দুর্নীতি ছিল। এই দুর্নীতি সম্পর্কে কেন কিছু করা হচ্ছে না? মাননীয় আদালত একটা রুলিং দিয়েছে—৬০ দিনের মধ্যে দুদকসহ যাদের নাম রিট পিটিশনে আছে, তাদের একটা তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট দিতে হবে। আমরা সেই কাজেও সহায়তা করছি। আমাদের বিশ্বাস, আপনারা মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ পাবেন এই দুর্নীতির।’
‘সেটা যখন হবে, তখন আদানি এবং আদানির সঙ্গে আরও কয়েকটি বড় বড় কোম্পানি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত—তাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া চালু করা হবে’, বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কমিটির আরেক সদস্য বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেনার জন্য যে চুক্তিগুলো ছিল, সেগুলো আমরা পড়েছি এবং এর পেছনে যে চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে, একটি চুক্তি করার ক্ষেত্রে যাদের মতামত নিতে হয়, সেই নথিগুলো আমরা দেখেছি। প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে নয়, বড় বড় কেসগুলোর ক্ষেত্রে।’
তিনি বলেন, ‘২০০৮-২০০৯ থেকে ২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সেগুলো আমরা রিপোর্টে বিশ্লেষণ করে দেখেছি; এই ডেটা থেকে কী ধরনের অনিয়ম চোখে পড়ে।’
২০১১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে জানিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কিন্তু অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ১ গুণ। এটি কোনো টেকনিক্যাল ফ্যাক্ট দিয়ে এক্সপ্লেইন (ব্যাখ্যা) করা সম্ভব নয়।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘আমরা ২০১১ সালে বিদ্যুতের জন্য ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছিলাম, সেটা ২০২৪-এ এসে বেড়ে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। কাদের টাকা পরিশোধ করেছে, এর বিপরীতে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ পাচ্ছি—সেই হিসাব মেলানো যায় না। সেটাই আমাদের মূল ফাইন্ডিং (অনুসন্ধানের মূল ফলাফল)। বিশেষ বিধান আইনের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হলো, আর বারবারই দায়মুক্তির পথ খুলে গেল।
‘এ ছাড়া আছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং অন্যান্য মিলে ওখানেও একটা সমস্যা আছে। এটা একদম চোখে পড়ে।’ তিনি বলেন, ‘যোগসাজশ শুধু সরকারের মধ্যে হয়েছে তা নয়; আমলা, সরকারি উচ্চ পদে, রাজনীতিবিদ যারা ছিলেন—সব মিলিয়ে যোগসাজশের মাধ্যমে হিসাবের গরমিলটা হয়েছে।
জাহিদ হোসেন, ‘আমরা যে সুপারিশ করেছি, তার মধ্যে একটি বিষয় হলো, ভবিষ্যতে রক্ষা করা। যাতে এ ধরনের চুক্তি আর না হতে পারে, সেজন্য একটা স্বাধীন সংস্থা থাকার কথা আমরা বলেছি।’ এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদানির চুক্তি সরকার বাতিল করতে যাচ্ছে কিনা—জানতে চাইলে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘মুখের কথায় বললেই চুক্তি বাতিল করা যাবে না। কারণ এটা আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে। কোনো কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে বড় ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চুক্তি বাতিল করার শর্ত চুক্তির মধ্যেই থাকে। আমরা জাতীয় কমিটির সঙ্গে কাজ করছি। চুক্তি অনুযায়ী যদি বাতিল করার কোনো কারণ থাকে, তবে আমরা এটি বাতিল করতে দ্বিধা করব না। তবে শুধু দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু করা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা হঠাৎ করে চুক্তি বাতিল করে সরকারকে আরও বড় একটা দায়ের মধ্যে ফেলতে চাই না।’ ইউএনবি

