বিচারপতি আবদুর রউফ ছিলেন একজন মানবিক মানুষ, জাতির বিবেকের কন্ঠ

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

সাঈদ চৌধুরী

একজন মানবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ ছিলেন জাতির বিবেকের কন্ঠ। আজ রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) সকাল ৯টা ৫০মিনিটে রাজধানীর মগবাজার ইনসাফ আল বারাকা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাহি রা-জিউ‘ন। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।

মরহুমের প্রথম জানাজা আজ বাদ আসর গুলশানে গাউসুল আযম মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় জানাযা হবে আগামীকাল বাদ যোহর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। এরপর বাদ মাগরিব ময়মনসিংহের জন্মমাটি দাপুনিয়া গ্রামে তৃতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ ছিলেন একজন মানবিক মানুষ। মানবতা ও মানবিকতার বিকাশে তার কীর্তিগুলো বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, যেখানে তিনি ছিলেন অনেক বড় এক স্তম্ভ। দেশে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার ও জনগণের ন্যায্য ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একজন অগ্রগণ্য পথিকৃৎ হিসেবে তার অবদান অপরিসীম।

বিচারপতি রউফ দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় সমন্বয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে আজীবন সংগ্রাম করেছেন।

জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ফুলকুঁড়ি‘র সভাপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। আজকের শিশু আগামীতে ফুটবে ফুল হয়ে। আপন রঙে রাঙিয়ে দিবে এই পৃথিবীকে। ফুলের সৌরভে বাগানে নেমে আসবে খুশির জোয়ার। সমাজ থেকে দূর হবে অজ্ঞানতা, কুসংস্কার আর অশিক্ষার অন্ধকার। হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ ও ঘৃণা নয়; বরং বিজয় হবে সত্য, ন্যায় ও ভালোবাসার। এমন দীপ্ত শপথেই ফুলকুঁড়ি আসরের জন্ম। এই বাগানে তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা।

মানবপ্রেমী আবদুর রউফ হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ (ওয়াক্ফ) বাংলাদেশের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবেও সেবাকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এবং প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শরিয়াহ উপদেষ্টা হিসেবে ভঙ্গুর অবস্থান থেকে সেগুলো সফল পথপরিক্রমায় শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে বিরাট অবদান রেখেছেন।

মোহাম্মদ আবদুর রউফ ময়মনসিংহের দাপুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। প্রাইমারী ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তি পেয়ে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন, আনন্দ মোহন কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি ডিগ্রী করেন। তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ও এমএ ইন এডুকেশন ডিগ্রী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এমএ ও এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন।

মোহাম্মদ আবদুর রউফ ১৯৬২ সালে কর্মজীবন শুরু করেন একজন মানবতাবাদী আইনজীবী হিসেবে। ঢাকা হাইকোর্ট থেকে আইন পেশা শুরু করে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৮২ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক ও ১৯৯৫ সালে আপীল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন। বিচারপতি হিসেবে তিনি আইন অঙ্গনকে আলোকিত করেছেন। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে অনাচার হয়, বেঞ্চ গঠনের ক্ষেত্রে এমনকি প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যেভাবে পক্ষপাত হয়, সে বিষয়ে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন।

হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি পদে থাকাকালে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ তাকে ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনের পদ ত্যাগ করেন। ১৯৯৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

বিচারপতি আবদুর রউফ ছিলেন একাধারে লেখক, গবেষক ও সমাজ সংস্কারক। সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ দেখে অনেক মুগ্ধ হয়েছি। গনমুখি, নান্দনিক ও রোমান্টিক এই মানুষটি খুব সহজেই অন্যকে ভালোবাসতেন। আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে তিনি ও কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন আমাদের বিশেষ আকর্ষণ।

২০২২ সালে প্রকাশিত ‘সৃজনতরঙ্গ সাঈদ চৌধুরী সংখ্যা’র তিনি একজন লেখক। সেখানে আমাকে নিয়ে বিচারপতি আবদুর রউফের লেখাটির বেশ অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। ২০২৩ সালের একুশে বই মেলাকে সামনে রেখে এটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ সমন্বয়ে শিল্পবোদ্ধা ব্যক্তিত্বগণ। সৃজনতরঙ্গ’র উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী, দৈনিক ইত্তেফাকের দীর্ঘকালীন সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদী ও দৈনিক সংগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কবি ও ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান।

সৃজনতরঙ্গ’র সম্পাদনা পরিষদের প্রধান ছিলেন কবি ও কথাশিল্পী জাকির আবু জাফর, নির্বাহী সম্পাদক কবি ও গবেষক ড. ফজলুল হক তুহিন, সম্পাদনা পরিষদ সদস্য কবি ও প্রাবন্ধিক আশরাফ হাসান, কবি ও গীতিকার আজরা পারভীন, লেখক ও প্রকাশক নাজমুস সায়াদাত, কবি ও ছড়াকার মালেক ইমতিয়াজ, সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার ফাহিম ফয়সাল, লেখক ও ব্যাঙ্কার আমিনুল ইসলাম, লেখক ও প্রকাশক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল, কবি ও আবৃত্তিকার মামুন সুলতান এবং সাংবাদিক ও কন্ঠশিল্পী আবিদ আজম।

৮৬৪ পৃষ্ঠার ব্যতিক্রমী এই প্রকাশনায় রয়েছে বাংলাদেশের শীর্ষ লেখক-বুদ্ধজীবী এবং সমকালের অনেক শক্তিমান কবি-সাহিত্যিকের মূল্যায়ন। আছে লন্ডনের আলোকিত প্রবাসী ব্যক্তিত্ব এবং বৃটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স নেতৃবৃন্ধের হৃদয়প্রসারী মতামত ও স্মৃতিচারণ। আরো আছে নিবেদিত কবিতা ও ছড়া এবং বিশেষ সাক্ষাৎকার। এতে বাংলা ভাষায় কালজয়ী কবি ও কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদ, বাংলা একাডেমি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত গণমানুষের কবি দিলওয়ার, ষাটের দশকের শক্তিমান কবি অধ্যক্ষ আফজাল চৌধুরী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল কে কে পাল চৌধুরী প্রমুখের লেখা সংকলিত হয়েছে।

বিচারপতি আবদুর রউফ লিখেছেন, ‘‘প্রবাসী কবি ও কথা সাহিত্যিক সাঈদ চৌধুরীর ‘আলোক ঝরনাধারা’ গল্পগ্রন্থটি ২০২২ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। এতে রয়েছে ৮টি গল্প । ১. আলোক ঝরনাধারা ২. সৌভাগ্যের স্বর্ণ সুড়ঙ্গ ৩. শুভ্র সাদায় আচ্ছাদিত ৪. নির্বাক মুগ্ধতায় ৫. বাসকিউল্স ভূত ৬. ভুতের অট্টহাসি ৭. মানবিকতা ৮. হাতপাখা ও পাখির ছানা।

গল্পগ্রন্থের প্রকাশক সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক নাজমুস সায়াদাত এটি আমাকে দিয়েছেন। বৈচিত্রময় ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ লেখায় গ্রন্থটি বেশ সুখপাঠ্য হয়েছে। গল্পের কাহিনীর মধ্যে পাঠক হয়ত নিজের জীবনকেই প্রত্যক্ষ করবেন।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ও কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদ ২০১৫ সালে লেখক সাঈদ চৌধুরী সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ছায়াপ্রিয়া নামের জীবনঘনিষ্ঠ এক উপন্যাসের রচয়িতা সাঈদ চৌধুরী। ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা, বিষয়ের অভিনবত্ব আর ঘটনার ঘনঘটায় লেখাটিতে দারুণ গতির সঞ্চার করেছে। স্বচ্ছ আর সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলেছে পরিণতির দিকে। ভাষার সারল্য আর বিষয়ের ঐশ্বর্য্য ছায়াপ্রিয়াকে করে তুলেছে মহিমান্বিত।’

১৯৯৫ সালে ছায়াপ্রিয়া’র প্রকাশক অধ্যক্ষ কবি আফজাল চৌধুরী লিখেছেন- সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা, শিক্ষা এবং সমাজসেবা এই সকল ক্ষেত্রেই সাঈদ চৌধুরী একজন সম্ভাবনাময় নেতৃপুরুষ। …নতুন মাত্রায় জীবনের খন্ডচিত্র অনবদ্য কবিতার মতো অংকিত হয়েছে এই গ্রন্থে। একটি বৈশিষ্ট্য এই উপন্যাসের উজ্জ্বল দিক আর তা হলো এই যে, এই উপন্যাসের নায়ক নায়িকারা খুবই আধুনিক কিন্তু শাশ্বত মূল্যবোধ অস্বীকারকারী নয়। …এক পরম মনোমুগ্ধকর কমেডি ট্রাজেডিতে রূপান্তরিত হয়েছে। নতুন মাত্রায় কবিতার মতো উপন্যাসেও সাঈদ চৌধুরীর এই অভিযাত্রা সফল হোক এই কামনা করি।’

‘আলোক ঝরনাধারা’ একনজর দেখে মনে হল, ছোটো গল্পে লেখক বেশ নতুনত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন। এই গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘আলোক ঝরনাধারা’। এতে লন্ডন ও সিলেটের চালচিত্র নান্দনিকতার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি আমাদের সামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। হান্নানার ভালোবাসা আর ভুল ধারণা দুটোই সমাজে বিদ্যমান। যে কোন বিষয়ে অনাহুত ভুল ধারণা লালন করা যে সমীচীন নয়, লেখক গল্পের ভেতর তা চমৎকার ভাবে প্রকাশ করেছেন।

‘সৌভাগ্যের স্বর্ণ সুড়ঙ্গ’ গল্পে নায়ক ‘আনাস মনে করে বাংলাদেশ এক সময় মধ্যপ্রাচ্যের মত হবে। আরবের মাটির সাথে সিলেটের মাটির মিল রয়েছে। হয়রত শাহ জালালের মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির তাকে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন, স্বাদে বর্ণে গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাবে, সেখানে বসতি স্থাপন করবে। তিনি সিলেটে আরবের মাটির সুঘ্রাণ পেয়েছেন। তাই তিনি সেখানেই আস্তানা স্থাপন করেন। এটি খুবই তাৎপর্যবহ। এই অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের আবিষ্কারে তা প্রমাণিত হয়েছে।’

‘শুভ্র সাদায় আচ্ছাদিত’ গল্পের নায়িকার পরিবার মোটামোটি ধর্মপ্রাণ ও আধুনিক। কোন ধরণের লোভ বা সম্পদের মোহ তাদের নেই। তার বাবা সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সক্রিয় এবং নিজের সীমিত বৈধ রোজগারে সন্তুষ্ট ছিলেন। এখন তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি জানতেন স্রষ্টা তাদের যত্ন নেবেন এবং একমাত্র কন্যাটি মানবিক মানুষ হবে।

ছোটগল্প ‘নির্বাক মুগ্ধতায়’ সিঙ্গল নারিদের চেয়ে বিবাহিত নারিদের অধিক সুখ ও সুবিধার বিষয়টি উন্নত বিশ্বের গবেষণার আলোকে দেখানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বিবাহ মানেই হচ্ছে, স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। দিন শেষে নিজের ঘরই মানুষের শান্তির ঠিকানা। …দাম্পত্য জীবনের সুখ নিয়ে যাদের ধারণা অপ্রতুল তারাই কেবল বিবাহিত জীবনের প্রতি ভীতি ছড়িয়েছে। সত্যিকারের মানবিক সম্পর্কের মাঝেই আসল সুখ নিহিত- একথাটি অনেকেই অনুভব করতে সময় লাগে। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর ধরে একটি গবেষণা হয়েছে। ওই জরিপে ৭০ থেকে ৭৫ বছর বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে হ্যাপিনেস বা সুখের সংজ্ঞা জানতে চাওয়া হয়। গবেষণা শেষে নানা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষকরা জানান, হ্যাপিনেস হচ্ছে জেন্যুইন হিউম্যান রিলেশনশিপ বা সত্যিকারের মানবিক সম্পর্ক। সে ব্যক্তির অর্থবিত্ত থাকুক বা না থাকুক, তার সঙ্গে তারা সুখী।

‘বাসকিউল্স ভুত’ গল্পে লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজে ভুতের কান্ডকারখানার কথা রয়েছে। গল্পে ভুতের বিষয়টি সব সময় রোমাঞ্চকর! তবে ‘ভুতের অট্টহাসি’ গল্পে শুধু শিরশিরে অনুভুতি নয়, শিক্ষনীয় বিষয়ও রয়েছে। পুনর্জন্মবাদের ধারণা ও পুনরুত্থান প্রসঙ্গটি চমৎকার। মৃত্যুরপর কবরে শান্তি বা শাস্তি, পুনরুত্থান ও হাশরের ময়দানের আনুষ্ঠানিকতা, পাপ-পুণ্যের হিসাব-নিকাশ, হাউজে কাউসার, পুলসিরাত এবং জান্নাত বা জাহান্নাম প্রাপ্তির বর্ণনা ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী পাঠক শ্রেণীকে অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করবে।

‘মানবিকতা’ গল্পে গ্রাম বাংলার আবহ দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে। শহরে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে গ্রামে। ছোট ছোট ঘর আর বড় বড় উঠোন পেরিয়ে কৃষি জমি। নয়নাভিরাম সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য। পুকুরে ঝাঁক ঝাঁক হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক শব্দে মনটা ভরে যায়।

‘হাতপাখা ও পাখির ছানা’ গল্পে পাঠককে শেকড়ের সাথে সম্পৃক্ত করে। ‘ছোট বেলায় আমরা যখন বাড়িতে ছিলাম, চৈত্র-বৈশাখের গরমে স্বস্তির পরশ বোলাতে সবাই হাতপাখা ব্যবহার করতেন। সুগন্ধি কাঠের তৈরি পাখা ছিল আমাদের। …আমাদের প্রধান সিন্দুক ছিল দাদাছাবের পালং। সেগুন কাঠের তৈরী পালংয়ের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ ও সখের জিনিস রাখতেন। তিন চার মাসে একবার এসব খুলে নতুন করে গুছিয়ে নিতেন। চামড়ার জুতা, ব্যাগ ও গয়নাপত্র আলাদা করে রাখতেন। …পালংয়ের বিছানার উপর আব্বা নরম ও মনোরম শীতলপাটি ব্যবহার করতেন। …শীতলপাটির কদর সিলেট থেকে বিলেত পর্যন্ত। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে আরাম জুড়াতে এর বিকল্প নেই। এখনো প্রবাসী আত্মীয় স্বজনকে সোনা-গয়না দেয়ার চেয়ে একটা ভাল শীতলপাটি দিলে বেশি খুশি হন। সিলেটের শীতলপাটি জগতখ্যাত। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।’

এসব বর্ণনা সাঈদ চৌধুরীর অবশ্যই সৃজনশক্তি ও লেখক সত্তার শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ। বাংলা ছোটগল্পে লেখক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রতিটি গল্প। ইউরোপীয় গল্পের আদলে নির্মান শৈলী, বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকে মুক্তচিন্তার প্রকাশ ঘটেছে।

গ্রাম গঞ্জের মাটির গ্রাণ যেমন আছে, তেমনি ঐতিহ্য চিন্তা ও আধুনিক জীবনাচারের সমন্বয় ঘটেছে গল্পসমূহে। বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সামাজিক জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটলেও সাঈদ চৌধুরী একেবারে বদলে যাননি। প্রবাস কিংবা নগরকেন্দ্রিক ভোগবাদী মানসিকতা তাকে গ্রাস করেনি। বরং গল্পের চরিত্রে ভোগবাদী মানসিকতার বিপরীতে সেবা ও পরোপকার প্রাধান্য পেয়েছে।

আমার মনে আছে, আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে কবি আল মাহমুদের ৮২তম জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেছিলাম ২০১৭ সালের ১২ জুলাই। আয়োজনে ছিলেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ চৌধুরী। জন্মদিনে শুভাকাক্ষীদের ভালবাসা ও ফুলের শুভেচ্ছায় সিক্ত হলেন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদ। এ উপলক্ষে সাহিত্যিক ও সুহৃদরা কবিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। ঘরোয়া আয়োজনে সেই সঙ্গে যুক্ত হয় আলোচনা, কবিতা পাঠ ও কেক কাটা। ভক্ত ও অনুরাগীদের পদচারণ মুখরিত ছিল মগবাজারে কবির বাসভবন।

কবিকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে, ভালোবাসা জানাতে সকাল থেকেই বাসায় আসেন তাঁর ভক্ত ও অনুরাগীরা। নতুন পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরানো হয় অশীতিপর এ কবিকে। কবি আসাদ চৌধুরী, ছড়াকার সালেহ চৌধুরী, কবি জাকির আবু জাফর, আবৃত্তিকার নাসিম আহমদ, কবি আবিদ আজম প্রমুখ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কবিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। নিজের অনুভূতি বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন কবি আল মাহমুদ। বলেন, ‘কবির কাজ হলো মানুষকে স্বপ্ন দেখানো এবং সত্য ও সুন্দরের পথের আহ্বান জানানো। সারা জীবন মানুষকে আমি স্বপ্ন দেখিয়েছি, ভালোবাসার কথা বলেছি। সত্য ও সুন্দরের পথে নিজে চলেছি, মানুষকেও চলতে বলেছি। আমি কবি হতে চেয়েছিলাম, আর কিছু হতে চাইনি। মানুষ আমাকে কবি হিসেবে জানে। আমার আর কোন অতৃপ্তি নেই।’

আমি আশা করি আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম অনাদিকাল যাবৎ অব্যাহত থাকবে। অবশেষে বলি, লেখক সাঈদ চৌধুরীর গল্পের কাহিনী বর্ণনায় অনেক চমক রয়েছে। নিবিড়ভাবে পাঠ করলে যে কোন পাঠক তা টের পাবেন। ‘আলোক ঝরনাধারা’ পাঠক মনে আলো ছড়াক, এটাই কাম্য।

বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোট (আপীল বিভাগ)

সাবেক সিইসি আবদুর রউফের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।

গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরাতে বিচারপতি রউফের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশর গণতান্ত্রিক পথচলার ক্ষেত্রে বিচারপতি রউফ বার বার উদাহরণ হয়ে আসবেন। তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।”

প্রফেসর ইউনূস আরো বলেন, “বিচারপতি রউফ ছিলেন নাগরিক সমাজের একজন বড় স্তম্ভ। ভোটাধিকার, সংস্কার এবং গণতন্ত্রের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, যা জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।”

বিচারপতি আব্দুর রউফের মৃত্যুতে বিচারকাজ দুপুরের পর থেকে বন্ধ

আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফের মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকাজ দুপুরের পর থেকে বন্ধ থাকবে। তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকাজ অর্ধ দিবস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. আজিজ অহমদ ভূঞা স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে আজ দুপুর ২টা থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের গভীর শোক প্রকাশ

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুর রউফ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় সমন্বয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এবং জাতীয় শিশু সংগঠন ফুলকুঁড়ির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আইন ও আদালত অঙ্গনে তার দীর্ঘ আইনগত পেশা জীবনে পেশাদারিত্ব, স্বচ্ছতা এবং দায়িত্ববোধের যে উদাহরণ স্থাপন করেছেন তা একেবারেই বিরল। আমার জানা মতে, সত্যিকারের মজলুমদের পাশে দাঁড়াতে তিনি কখনো কারো সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির পরোয়া করেননি। অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে আইনি সহযোগিতা প্রদান করেছেন। মজলুমানের পক্ষে তার এ লড়াই ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মজলুমদের পক্ষ থেকে আমি তাকে গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি।’

জামায়াত আমির বলেন, ‘তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকাকালে ১৯৯১ সালে জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিয়েছিলেন; যে নির্বাচন দেশ-বিদেশে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। তার নিরপেক্ষতা, সততা ও যোগ্যতা ছিলো প্রশ্নাতীত। দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিজমের পর বর্তমানে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে তার মতো একজন প্রতিভাবান অভিভাবকের বড় প্রয়োজন ছিল। তার ইন্তেকালে জাতি একজন অত্যন্ত আদর্শবান, দেশপ্রেমিক, উদার গণতন্ত্রমনা, আইন বিশেষজ্ঞ, ন্যায় বিচারক ও একজন ইসলামী ব্যক্তিত্বকে হারাল। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার সকল ভুলত্রুটি মাফ করে দিন, তার নেক আমলসমূহ কবুল করুন এবং তাকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন।’

ডা. শফিকুর রহমান আরো বলেন, ‘আমি তার শোকাহত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহকর্মীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং দোয়া করছি আল্লাহ তাদের এ বিরাট শোক সহ্য করার তাওফিক দান করুন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *