বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ওপর পুলিশের অ্যাকশন

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জের শিকার হলেন বিরোধী আইনজীবীরা। মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আইনজীবীরা ঢাকা বারের সামনে থেকে পদযাত্রা নিয়ে ডিসি অফিসের সামনের রাস্তার দিকে যেতে গেলে এ ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকা জেলা বারের সামনে জড়ো হয়ে ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্টের আইনজীবীরা স্মারকলিপি দেয়ার জন্য যাচ্ছিলেন। এ সময় সাদা পোশাকধারী দুই/তিন জন পুলিশ তাদের ওপর অতর্কিতে লাঠিপেটা শুরু করেন। এতে আইনজীবীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। লাঠিচার্জে অন্তত ৫০ জন আইনজীবী আহত হয়েছেন বলে ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আহতদেরকে প্রথমে ঢাকা বার ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে গুরুতর বেশ কয়েকজনকে জজ কোর্টের পাশে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একাধিক নারী আইনজীবীকে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের দাবি, পদযাত্রার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে প্রধান সড়কে যাওয়ার আগেই ঢাকা বারের গলির মুখে পুলিশ আইনজীবীদের ওপরে অতর্কিত হামলা চালায়।

এ সময় নারী আইনজীবীদের ওপরে পুরুষ পুলিশ সদস্যরা নির্বিচারে হামলা চালিয়েছেন। এমনকি নারী আইনজীবীদের গায়ে পর্যন্ত হাত দিয়েছেন। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে নারী আইনজীবীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তারা বলেন, মিছিলটি মেইন রোডের সামনে আসলে আমরা তাদেরকে রাস্তায় আসতে বারণ করি। কিন্তু তারপরেও তারা চলে আসেন। আমাদের ওপরে তারা হামলা করেন। এতে আমাদের ৪/৫ জন পুলিশ আহত হয়। হামলার পর বারের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন আইনজীবীরা।

আইনজীবীদের অভিযোগ

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহীন সুলতানা খুকী, হাশেমী, লাকী, শাহীন সুলতানা খুকী, মার্জিয়া হীরাসহ প্রায় ২৫ জন আইনজীবী লাঠিপেটার শিকার হন। তারা ঢাকা বারের ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন। শাহীন সুলতানা খুকী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নারী আইনজীবীরা পদযাত্রার সামনে ছিলাম। ঢাকা বার থেকে ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনের রাস্তায় যাওয়ার আগেই পুরুষ পুলিশ সদস্যরা মারধর ও অতর্কিতভাবে লাঠিচার্জ করে। এ সময় পুরুষ পুলিশ সদস্যরা শ্লীলতাহানি করেছে। নিয়ম অনুযায়ী নারীদের ক্ষেত্রে নারী পুলিশ সদস্যরা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তা না করে সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা আমাদের শ্লীলতাহানি করেছে। এ সময় তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, পদযাত্রা করা কী অপরাধ? আমরা আইনজীবী, এর বিচার চাই।

এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট বার ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, সাদা পোশাক পরা পুলিশ অতর্কিতভাবে হামলা করে। এ সময় আমাদের ২০/২৫ জন নারী আইনজীবীকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেছে। এবং সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা নারী আইনজীবীদের গায়ে হাত দিয়েছে। শ্লীলতাহানিও করেছে। নারী আইনজীবীরাও আজ পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায় নাই।

বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রতিবাদ সমাবেশে বলেন, আজকে পুলিশের আক্রমণ জঙ্গির মতো। নির্বিচারে তারা আইনজীবীদের পিটিয়েছে। তারা আইনজীবী বোনদের টর্চার করেছেন। গায়ে হাত দিয়েছেন। সবাই এডিসি হারুন হতে চায়। অর্ধশতাধিক আইনজীবীকে বেধড়ক পিটিয়েছে। পুরুষ পুলিশ সদস্য নারী আইনজীবীদের গায়ে হাত দিলো কার কথায়?

বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল তার বক্তৃতায় বলেন, এটা আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশে আজ পুলিশ বাহিনী আইনজীবীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গণতন্ত্রকামী আইনজীবীদের ওপর এ হামলা আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর হামলা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির নির্দেশে আইনজীবীদের ওপর এ হামলা করা হয়েছে। আমরা এই হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। আইনজীবীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যতদিন পর্যন্ত সরকারের পতন না হবে ততদিন তারা ঘরে ফিরে যাবে না।

যেভাবে ঘটনার শুরু

দুপুর ১২টার আগে থেকেই পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি সফল করতে বিরোধী আইনজীবীরা ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্টের ব্যানারে ঢাকা বার ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকে। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আইনজীবী সমিতির সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রাটি আদালতের সামনের প্রধান সড়কে এলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে আইনজীবীরা প্রতিবাদ করেন। এসময় পুলিশ ও আইনজীবীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।

একপর্যায়ে আইনজীবীরা পুলিশি বাধা অতিক্রম করে মেইন রোডে আসতে উদ্যত হলে প্রথমে সাদা পোশাকধারী পুলিশ লাঠিচার্জ করেন বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। লাঠিচার্জ উপেক্ষা করেই আইনজীবীরা প্রধান রাস্তায় এলে পুলিশ সংগঠিত হয়ে বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। বেশ কয়েকজন আইনজীবীও ফেস্টুনের লাঠি দিয়ে পুলিশকে আঘাত করলে পুলিশ আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এ সময় বেশ কয়েকজন নারী আইনজীবী পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন।

সিনিয়র আইনজীবী নেতারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। একপর্যায়ে আইনজীবীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে সিএমএম আদালতের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এসময় তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখান দিয়ে সিএমএম আদালতে ঢুকতে গেলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। কিছুক্ষণ সেখানে ধাক্কাধাক্কি হয়। এরপরে পুলিশ প্রধান ফটক খুলে দেয়। আইনজীবীরা সিএমএম আদালতের সামনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ অবস্থান করে তারা সেখান থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে আসেন। তারা সেখানে এসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। পরে বিকালে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর স্মারকলিপি দেন।

ইউএলএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পুলিশের লাঠিচার্জে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহ-সম্পাদক মাহবুবুর রহমান খান, আইনজীবী দেওয়ান রিপন, মোজাহিদুল ইসলাম সায়েম, কে এম মিরাজ হোসেন, সাইদুর রহমান সোহাগ, কে এম বরকত সবুজ, মাহবুব আলম আক্তার, শফিকুল ইসলাম, জহিরুল ইসলাম, মো. মহসীন, কাজী পনির, মু. কাইয়ুম, এস এম হুমায়ূন কবির, নার্গিস আক্তার মুক্তা, আকলিমা আলোসহ কমপক্ষে ৫০ জন আইনজীবী আহত হয়েছেন।

আইনজীবী মাহবুবুর রহমান খানের হাঁটুতে আঘাতের কারণে রক্ত বের হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া আইনজীবী মু. কাইয়ুমের ডান হাত ভেঙে গেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। এ ছাড়া আহত আইনজীবীরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের গণমাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক একেএম এহসানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে তাদের অনেক আইনজীবী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী আইনজীবীও রয়েছেন।

দুই চিফ ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর স্মারকলিপি

বিকালে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) বরাবর স্মারকলিপি দেন বিএনপি সমর্থক বিরোধী আইনজীবীদের মোর্চা ল’ইয়ার্স ফ্রন্ট। সিএমএম ও সিজিএম তাদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ল’ইয়ার্স ফ্রন্টের আহ্বায়ক এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, কো-কনভেনর এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, এডভোকেট মামুন মাহবুব, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, এডভোকেট মোহাম্মদ আলী, এডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী প্রমুখ। স্মারকলিপিতে অবিলম্বে সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিচারিক হয়রানি থেকে মুক্তি প্রদান করে বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রতা রক্ষা ও উপরোক্ত বিষয়গুলোর ওপর কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। – মানবজমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *