বালিকার বিশ্বাস ও বৃষ্টি ।। মুসতাক আহমদ

লাইফ স্টাইল শিল্প-সংস্কৃতি
শেয়ার করুন

মরু অঞ্চলে এমনিতেই অনাবৃষ্টি, তারপর খরা। দুর্ভিক্ষ যেন অত্যাসন্ন। সবাই চোখে সরষে ফুল দেখছে। উপায়ান্তর না দেখে এলাকাবাসী সিদ্বান্ত নিলেন, কামেল পীর-মাশায়েখ এবং আলেমদের নিয়ে বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে সমবেত হবেন, আনুষ্ঠানিক দোয়ার ব্যবস্থা করবেন।

যেমন কথা তেমন কাজ। ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী নির্ধারিত দিনে এলাকার প্রধান কর্তা-ব্যক্তির বাড়িতে জমায়েত হলেন। তারপর মাঠের দিকে যাত্রা। কারো হাতে কিতাব, কারো কাছে জায়নামাজ। আর কেউবা তাসবীহর দানা সামলাচ্ছেন।

কর্তা-ব্যক্তি বারংবার এসে হালনাগাদ খবর জানিয়ে যাচ্ছেন- অমুক পীরে কামেল এসেছেন, তমুক শায়খুল হাদীছ এসে পৌঁছেছেন। বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন যাকে সচরাচর এলাকায় পাওয়া যায়না, বছরের উল্লেখযোগ্য সময় যিনি আকাশে ঘুরে বেড়ান। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষকে ঈমান-ইয়াকীন তথা ইসলামের বাণী শুনিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন, আল্লাহর খাস ফজলে তিনিও তাশরীফ এনেছেন।

এক অপূর্ব টান টান উত্তেজনা, কি গৃহাভ্যন্তরে, কি বাইরে! চর্মচক্ষুগুলো আল্লাহর কুদরতের নিশানা অবলোকন করতে যাচ্ছে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বাড়ি ছেড়ে মাঠের দিকে অগ্রসর হলেন। সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ শায়খের পাশে পাশে ৯ বছরের একটি বালিকা অনুগমন করছে।

ছোট্ট বালিকাটি তাদের কথাবার্তা নিবিষ্টমনে শুনে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর পরই শায়খের চেহারা মুবারকের দিকে উৎসুক নয়নে তাকাচ্ছে। তার চুখে-মুখে প্রত্যাশার ছাপ।

শায়খ বালিকাটির দিকে দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করলে সে হাতটি সযত্নে ধরলো, কোমল হাতের পরশে সম্মুখে এগিয়ে চললো। কিন্তু সহসা কোন-কিছু না বলে বালিকাটি দৌড়ে বাড়ির দিকে ফিরে যেতে লাগলো।

শায়খ একটু বিস্মিত হলেন, তবে পথ চলা অব্যাহত রইলো। খানিক্ষণ পরই শায়খ লক্ষ্য করলেন, বালিকাটি ফিরে আসছে। তার হাতে আছে একটি ছাতা।

বিদ্যুৎ ঝলকানীর মতো এক আধ্যাত্মিক বোধোদয়ের আলোক রেখা শায়খের হৃদয় মনে অঙ্কিত হয়ে উঠার পাশাপাশি শান্ত সৌম্য চেহারাটিতে কে যেনো লজ্জার বিবর্ণতা মেখে দিলো।

শায়খ অনুষ্ঠানের স্থলে পৌঁছালে যথারীতি মোনাজাত হলো। সমবেত আলেমরা বিভিন্ন দোওয়া ও তাসবীহ তাহলিলের উপর জোর দিলেন। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করলো। অনতিবিলম্বে মুষলধারে বৃষ্টি নেমে জমিনের বুক শীতল করে দিয়ে আল্লাহর কুদরাতের মহিমা প্রকাশ পেলো।

সবাই খুশিতে আত্নহারা, নানা জনের নানা কথা, নানারূপ মন্তব্য বেরিয়ে আসছে। কেউ বলছেন, ‘বিশ্বাসই হচ্ছেনা, কেমনে বৃষ্টি নেমে এসেছে’। আলেমদের কেউ কেউ হালকা উচ্চারণে, কেউ বা চুপিসারে বলছেন, ‘এরকম জানলে ছাতা সাথে করে নিয়ে আসতাম।’

কার দোওয়ার বরকতে বা কোন আলেমের কেরামতিতে বৃষ্টি এসেছে এনিয়ে কথা হচ্ছে সবার মুখে মুখে। বড় হুজুরের বিষয়ে মতবিরোধও দেখা দিতে লাগলো।

বৃষ্টিতে যখন সবাই ভিজে যাচ্ছেন, বালিকাটি তার ছাতা শায়খের মাথার উপর মেলে ধরার চেষ্টা করছে। ইত্যবসরে শায়খ সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে নাতিদীর্ঘ নসিহত পেশ করলেন।

শায়ক বললেন সম্মানিত উপস্থিতি, আপনারা দোওয়া এবং কারামত নিয়ে ভাবছেন! আর আমি এখানে আমাদের ঈমান ও ইয়াকিনের অবস্থা দেখে লজ্জায় হেট হয়ে আছি।

অদৃশ্যের খবর কেবল আল্লাহর হাতে। তবে আমার বিশ্বাস, আজ আমাদের সকলের প্রার্থনার চেয়ে আল্লাহর কাছে এই বালিকার বিশ্বাসটি প্রাধান্য পেয়েছে। আল্লাহর শক্তি এবং মহিমার প্রতি তার অকাট্য বিশ্বাসই (ইয়াকিন) প্রভুর রহমতের বারিধারাকে টেনে জমিনে নামিয়েছে।

আমাদের জীবনের সমস্ত জ্ঞান-সাধনা, পান্ডিত্য এই বালিকাটির সরল বিশ্বাসের দীপ্তির সম্মুখে ম্লান-মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হচ্ছে আমাদের ঈমান ও ইয়াকিন পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। আমরা সত্যি সত্যি এই বালিকার মত আল্লাহর ক্ষমতায় বিশ্বাস নিয়ে ঘর থেকে বের হইনি, আমরা যেনো আল্লাহর ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে এসেছি।

তারপর বালিকাটির ডান হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে শায়খ ছাতাটি বালিকার মাথার উপর তুলে ধরলেন এবং আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘এই ছাতাটি কেবল তোমার মাথায়ই শোভা পায়, মা।’

আর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে শায়খ বললেন, ‘আপনারা আল্লাহর ওয়াস্তে হৃদয়ের চক্ষুগুলো উম্মীলিত করুন। দেখুন মেয়েটিকে আর তাকান ছাতাটির দিকে। এটি নিছক একটি ছাতাই নয়, এতো মেয়েটির অন্তরের ইয়াকীন, সে ছাতা নিয়ে আসেনি, সে ইয়াকীন নিয়ে এসেছে। আর আমরা ইয়াকীন সাথে নিয়ে আসতে পারিনি। এখান থেকে ইয়াকিন কুড়াতে এসেছি।

কথাগুলো সবার হৃদয়ে রেখাপাত করলো। নির্বাক ও নিশ্চুপ জনতার চোখ ছলছল, আবেগে উচ্ছল। শায়খ মেয়েটিকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তারপর বলতে লাগলেন, ‘মাগো, বয়সের ভার বাড়িয়েছি, দাড়ির দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছি, কিন্তু ঈমানকে লম্বা করতে পারিনি, ইয়াকীনের ওজন বাড়াতে পারিনি।’

পীরে কামিল উপাধিভূষিত ব্যক্তিটি এগিয়ে এসে মেয়েটির হস্ত চুম্বনপূর্বক কাঁদতে কাঁদতে বললেন মাগো, লোকে খামাখাই আমাকে পীর বলে। আজ থেকে তুমি আমার মুর্শিদ আর আমি তুমার মুরিদ’।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসির ততক্ষনে পীরের পেছনে দাঁড়িয়ে বালিকাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আর আফসোস ভরা কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘মাগো, ঝর্ণাতলের নুড়ি-পাথরের মত সারাটি জীবন কিতাবের মধ্যেই ডুবে কাটালাম। কিন্তু কিতাবের রস তথা আসল শিক্ষা আহরণ করা হলো না। এই বলে তিনি জমিনে বসে পড়লেন।

বয়োবৃদ্ধ শায়খ তখন আকাশের দিকে দু-বাহু উত্তোলন করে দীর্ঘ মুনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর শোকরগুজারি করলেন। শেষ বাক্যটিতে শায়খ, ‘ইয়া আল্লাহ, আমাদেরকে এই বালিকার বিশ্বাস দাও’ বলার সাথে সাথে শতকণ্ঠে সমস্বরে ‘বালিকার বিশ্বাস, বালিকার বিশ্বাস’ বলে চতুর্দিক থেকে ধ্বনি উঠলো।

বায়ুমন্ডলের সীমানা পেরিয়ে ইথারের সেতারে সুর তুলে ক্ষনিকের জন্য যেনো হারিয়ে গেলো সবাই। সেই সুরলহরী স্বর্গপুরীর প্রাচীরে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার জমিনে ফিরে আসলো। বাড়ির পথে ফিরে যেতে যেতে সবার কর্ণকুহরে, ‘বালিকার ইয়াকীন, বালিকার ইয়াকীন’ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত, রণিত-অনুরণিত হয়ে চললো।

* মুসতাক আহমদ, ব্যারিস্টার অ্যাট ল, লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কাউন্সিলর এবং ওভারভিউ ও স্ক্রুটিনি কমিটির চেয়ারম্যান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *