বাবা-মা’র যত্ন ও সম্মান ।। ব্যারিস্টার মুসতাক আহমদ

প্রবন্ধ-কলাম সাম্প্রতিক
শেয়ার করুন

পিতা-মাতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব অসীম এবং অপার। তাদের যত্ন করা, শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, সান্নিধ্যে থাকা এবং তাদের জীবনে সুখের যোগান দেওয়া আমাদের একান্ত কর্তব্য।

বাবা-মা — এই শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অসীম ত্যাগ, মমতা এবং নিঃস্বার্থ ভালবাসার প্রতিচ্ছবি। তাদের প্রতি আমাদের সম্মান এবং যত্ন প্রদর্শন করা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং ভালবাসার প্রকৃত প্রমাণও বটে। আমাদের বয়স যত দ্রুত বাড়ে তত তাড়াতাড়ি আমাদের উপলব্ধি হয় যে, এই পৃথিবীতে তাদের উপস্থিতি কতটা মূল্যবান।

আমাদের প্রতিদিনের আচরণের মাধ্যমে পিতা-মাতার প্রতি সম্মান ও ভালবাসা প্রকাশ করার অনেক উপায় রয়েছে। তাদেরকে সঙ্গ দেয়া, তাদের সাথে হাসিমুখে একটুখানি কথা বলা এবং তাদের উপস্থিতির মধ্যে সময় কাটানো। এসব ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে আমরা পিতা-মাতাকে আনন্দিত এবং সম্মানিত করতে পারি।

পিতা-মাতার সাথে কথা বলার সময় মোবাইল ফোন স্ক্রলিং করা থেকে বিরত থাকুন। কথাবার্তা এবং আচরণে তাদের প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ (আনডিভাইডেড এটেনশন) দিন। তাদের বলা প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তাদের মতামতকে মূল্য দিন। যখন তারা কথা বলেন, তখন তাদের চোখে চোখ রেখে ভালোবাসা এবং সম্মানের দৃষ্টিতে তাকান। তাহলে জীবনটা ভালবাসায় ভরে যাবে। আল্লাহর রহমতের অপার শান্তি মিলবে।

সবসময় পিতা-মাতার প্রশংসা করুন। তাদের ভাল গুণগুলো তুলে ধরুন। তারা যে ভাল কাজগুলো করেছেন সেগুলো মনে রাখুন এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দিন। আপনার জীবনের সুখবর তাদের সাথে শেয়ার করুন, যাতে তারা আপনার সুখে অংশীদার হতে পারেন। বিশেষ করে আপনার বোনদের প্রতি ভালবাসা এবং যত্ন দেখান, কারণ এই কাজে আপনার বাবা-মা আপনার উপর অনেক খুশি হবেন। তাদের বন্ধু, আত্নীয় এবং প্রিয়জনদের সম্পর্কেও ভাল কথা বলুন।

বাবা-মা যদি একটি গল্প বারবার বলেন, তবুও তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। অতীতের বেদনাদায়ক স্মৃতিগুলি তাদের সামনে উত্থাপন করবেন না। আপনি বয়সে বা পদমর্যাদায় যত বড় হন না কেন, কখনো তাদের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বা পেছন ঘুরে বসবেন না। যখন আপনি তাদের পাশে বসবেন, তখন নিশ্চিত করুন যে আপনার বসার ভঙ্গি তাদের প্রতি সম্মানের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।

বাবা-মা’র অভিজ্ঞতাকে সম্মান করুন। তাদের মতামত এবং চিন্তাভাবনাকে হালকা ভাবে উড়িয়ে দেবেন না। তাদের কোন মন্তব্য নিয়ে সমালোচনা করবেন না। তারা কথা বলার সময় তাদের বাধা দিবেন না। তাদের সামনে তাদের নাতি-নাতনিদের শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। তাদের পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা গ্রহণ করুন বা না করুন কমপক্ষে সম্মানের সাথে শুনুন এবং ডিসমিসিভ হওয়া থেকে বিরত থাকুন। তাঁদেরকে বুঝতে দিন এখনো পরিবারে তাঁদের অথরিটি বহাল আছে। তাদের সম্মুখে নিজেকে বিরক্ত বা ক্লান্ত দেখাবেন না। কারণ আমাদের কষ্ঠে এবং অসুখে আমাদের বাবা-মা কষ্ট পান এবং অসুখী হয়ে উঠেন।

পিতা-মাতারা এই পৃথিবীর অমূল্য ধন। তারা আমাদের জীবনে থাকা অবস্থায়ই তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের ভালবাসা এবং ত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। তাদের ত্রুটি বা ভুলের উপর হাসবেন না এবং তারা কোন কিছু অনুরোধ করার আগেই তাঁদের প্রয়োজন সম্পন্ন করুন। নিয়মিত তাদের কাছে যান এবং তাদের সাথে কথা বলার সময় আপনার শব্দগুলো সাবধানে বেছে নিন। তাদের পছন্দের নামে ডাকুন এবং সব সময় তাদেরকে অগ্রাধিকার দিন।

নিশ্চয়ই বাবা-মা’র ভালবাসা নিঃস্বার্থ এবং সবসময় মধুর। আমাদের উচিত সেই ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটানো। চেষ্টা করুন সেই ছোট্ট শিশুটির মতো থাকার, যে তাদের স্নেহে এবং সুরক্ষায় বেড়ে উঠেছিল। আপনি তাদের প্রতি কখনো সেই পর্যায়ের যত্নশীল হতে পারবেন না যেমন তারা আপনার প্রতি ছিলেন। কিন্তু আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে তাদের চোখের জ্যোতি হয়ে উঠুন। যদি তারা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন তবে তাদের শোবার কক্ষে গিয়ে খাবার খাওয়ানোর এবং তাদের সাথে খাবার চেষ্টা করুন, যাতে তারা আপনাকে খাবার উপভোগ করতে দেখে আনন্দিত হন।

পিতা-মাতা এই পৃথিবীর বড় ধন এবং আপনাকে অবাক করে অনেক তাড়াতাড়ি সেই ধন মাটির নিচে চলে যাবে। আপনার পিতামাতাকে তাদের জীবিত অবস্থায়ই মূল্যায়ন করুন। যত্ন করুন এবং তাদের শ্রদ্ধা করুন। পিতা-মাতা আমাদের জীবনের প্রথম শিক্ষাগুরু, প্রথম বন্ধু, এবং সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। তাদের ভালবাসা আমাদের সকলের জন্য অমূল্য।

যাঁদের বাবা-মা পাশে নেই তাঁরা নিয়মিত ফোনে তাদের সাথে গল্প করুন। আর যাদের বাবা-মা ইতিমিধ্যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তাঁরা বাবা-মা’র জন্য বেশী করে দোয়া এবং দান সাদকাহ করবেন এবং তাঁদের প্রিয়জন যারা জীবিত রয়েছেন তাঁদেরকে ভালোবাসবেন, তাঁদের সাথে সুন্দর আচরণ করবেন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন, “তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতামাতার প্রতি সদয় হও। তাদের মধ্যে কেউ বা উভয়েই যখন তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে পৌঁছে যায়, তখন তাদের প্রতি উফ শব্দটিও বলো না, তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সাথে সম্মানজনকভাবে কথা বলো। তাদের সামনে বিনয় ও করুণা প্রদর্শন করে নত হও এবং বলো, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন।’” (সূরা আল-ইসরা)।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে এই মহান দায়িত্ব পালন করার সুযোগ এবং ক্ষমতা দান করুন।

* মুসতাক আহমদ ব্যারিস্টার অ্যাট ল, লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে কেবিনেট মেম্বার (জবস্, এন্টারপ্রাইজ, স্কিলস্ এন্ড গ্রোথ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *